লটকন বাগানে একদিন

থোকা থোকা লটকন যেন পরম মমতায় জড়িয়ে রেখেছে গাছকে। গাছের প্রায় আগা থেকে শুরু করে শাখা ছাড়িয়ে উপশাখা জুড়ে লটকে আছে লটকন! বেশিরভাগ লটকনই পেকে লাল হয়ে যাওয়া। হাতের নাগালেই ঝুলে থাকা থোকা ভর্তি লটকন থেকে লটকন ছিঁড়ে খাওয়ার অনুমতি পেয়ে গেলাম বাগান মালিকের কাছ থেকে। আর পায় কে আমাদের! বাগান ঘুরে, ছবি তুলে, লটকন খেয়ে বেশ কাটিয়ে দিলাম দুপুরটা।

এইরকম সাজানো গোছানো পথ ধরে যেতে যেতেই চোখে পড়বে লটকন গাছের সারি
গিয়েছিলাম নরসিংদীর লটকন বাগান দেখতে। ১০ বন্ধু মিলে একটি মাইক্রো নিয়ে সকাল সকাল রওনা দিলাম নরসিংদীর উদ্দেশে। শিবপুর উপজেলার জয়নগরসহ বেলাব উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রামের লটকন বাগান দেখাই আমাদের লক্ষ্য। পৌঁছতে পৌঁছতে বেজে গেল সাড়ে ১০টা। কিন্তু লটকনের গাছ তো চোখে পড়ে না! তবে কি ভুল পথে এলাম নাকি? স্থানীয় লোকজনদের জিজ্ঞেস করে করে এগুচ্ছি। হঠাৎ এক বন্ধুর চিৎকার, ‘ঐ যে লটকন ধরে আছে গাছে!’ হ্যাঁ, ব্যাপারটা বেশ রোমাঞ্চকরই বটে। যারা এর আগে গাছে ঝুলে থাকা লটকন দেখেননি তাদের জন্য আনন্দময় একটি অভিজ্ঞতা সন্দেহ নেই।

গাছ ভর্তি লটকন

ঝটপট গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়লাম আমরা। এটি কোনও বাগান নয়, একজনের বাড়ির আঙিনায় জন্মানো লটকন গাছ। ছোট-বড়, কাঁচাপাকা লটকনে ঝমঝম করছে গাছ। আমরা মুগ্ধ। একটি গাছে এত লটকন হতে পারে আমাদের কারোরই জানা ছিল না। পাতার চাইতে যেন লটকনই বেশি গাছে! প্রাথমিক উচ্ছ্বাস শেষ হলে আমরা আবারও গাড়িতে উঠে পড়লাম বড় লটকন বাগানের খোঁজে।

লটকন বাগান
চলছে জিজ্ঞেস করে করে এগিয়ে যাওয়া। হঠাৎই মুগ্ধতা পরিণত হলো বিস্ময়ে। সাজানো গোছানো পথের দুপাশে যতদূর চোখ যায় কেবল লটকন গাছ! প্রতিটি গাছেই হাজার হাজার লটকন ঝুলছে পরম নিশ্চিন্তে। গাড়ি থামিয়ে ঢুকে পড়লাম একটি বাগানে। কড়া রোদের দুপুরেও সেখানে বেশ ছায়া ছায়া আবহ। বিশাল সব লটকন গাছ আড়াল করে রেখেছে রোদ। কিছু গাছের লটকন পাকলেও বেশকিছু গাছের লটকন এখনও রয়েছে পাকার অপেক্ষায়।

9আমাদের সাড়াশব্দ পেয়ে বাগানের পাশের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন মালিক আফরোজা বেগম। জানালেন, ছেলে ও ছেলের বউ চাকরি করে। বাগান দেখার লোক নেই। তাই এই ফলনের মৌসুমে তিন লক্ষ বিশ হাজার টাকায় বিক্রি করে দিয়েছেন লটকন বাগান। সেটা কীভাবে? আফরোজা জানান, এই বছরে যত লটকন ফলবে, সবই পাবেন বাগান যিনি কিনেছেন সে। ফলন শেষ হলেই আবার গাছের মালিক তিনি। পাশের বাগানটি তার দেবর সোলেমানের। সোলেমান অবশ্য নিজেই যত্ন নেন বাগানের। লটকন বিক্রি করেন স্থানীয় বাজারে।

10

আকার অনুযায়ী লটকন প্রস্তুত করা হচ্ছে বিক্রির জন্য
ঘুরতে ঘুরতে দেখা পেলাম মোহাম্মদ সালামের। বাগানে মাদুর বিছিয়ে লটকন ওজন করছিলেন তিনি। তার সঙ্গে আরও কয়েকজন কর্মী ব্যস্ত। সালাম জানালেন, লটকন বাগানটি কিনেছেন এক বছরের জন্য। পরিচর্যা থেকে শুরু করে বাগানের সব কাজ তিনি নিজেই করেন। আকার অনুযায়ী লটকন আলাদা করে প্যাকেট করেন ১০ কেজি করে। সেই প্যাকেট স্থানীয় বাজার থেকে শুরু করে চলে যায় ঢাকায়। স্থানীয় বাজারে প্রতি কেজি ৭০ টাকায় বিক্রি করেন লটকন। ঢাকায় বিক্রি হয় ১০০ টাকা কেজি। আবার মৌসুমের শেষের দিকে এই দাম বেড়ে যায়। তখন ঢাকায় ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত কেজি বিক্রি হয় প্রতি কেজি।3

5

বেশ কয়েকটি লটকন বাগান ঘোরা শেষ করে ফেললাম আমরা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে। একটি বাগান দেখা শেষ করে গাড়ির দিকে এগুচ্ছি, এমন সময় একজন অনুরোধ করলেন তার বাগানটি ঘুরে দেখার জন্য। জিজ্ঞেস করলাম, লটকন বিক্রি করবেন? ‘যত ইচ্ছা বাগান থেকে নিয়া খান, বেচুম না’- তার সাফ জবাব। জানলাম মালিকের নাম আলতাফ। কেবল এটি নয়, তার আরও একটি বাগান রয়েছে। দুই বাগানে ৩০০টিরও বেশি লটকন গাছ রয়েছে। বারো লাখ টাকায় বাগান বিক্রির সুযোগ পেয়েছিলেন আলতাফ, কিন্তু বিক্রি করেননি। বললেন, ‘নিজের বাগানে নিজেই ঘুরি, ইচ্ছা মতো খাই। সবাইকে খাওয়াই। বাকিগুলা পাইকারি বেচি। বাগান বিক্রির ইচ্ছা নাই।’ আলতাফ জানালেন, প্রতি গাছে ১২ থেকে ১৫ মন লটকন হয়। বিদায়বেলায় হাত ভর্তি করে লটকন দিয়ে দিলেন তিনি।

নিজ বাগানের সামনে আলতাফ
কেবল গাছে ধরে থাকা লটকন দেখেই মুগ্ধ হইনি, মুগ্ধ হয়েছি বাগান মালিকদের আতিথেয়তায়ও। খুব খুশি হয়েই তারা অনুমতি দিয়েছেন বাগান ঘুরে দেখার, ফল ছিঁড়ে খাওয়ার। ফেরার সময় ব্যাগভর্তি লটকন নিয়ে ফিরেছি, যার সবই ভালোবেসে দিয়েছেন মালিকরা।

11

জেনে নিন
লটকন বাগান ঘুরে দেখতে চাইলে আপনাকে নরসিংদী যেতে হবে। নিজস্ব গাড়ি না থাকলে বাসে চলে যান। পাঁচদোনা মোড়ে নেমে সিএনজি নিয়ে নিন মরজাল পর্যন্ত। ঢাকা-সিলেট হাইওয়ে থেকে শিবপুরের দিকে যেতে দেখবেন বেশ কয়েকটি শাখা রোড ঢুকে গেছে। এর যেকোনও একটি ধরে চলতে শুরু করুন। চোখে পড়বে সারি সারি লটকন গাছ। কিলোমিটারের পর কিলোমিটার লটকন বাগান। মালিকের অনুমতি নিয়ে ঢুকে পড়ুন ইচ্ছে মতো। বেশি করে লটকন কিনে আনতে চাইলে মরজাল বাজার কিংবা সৃষ্টিগড় বাজার থেকে কিনে নিন। উয়ারি বটেশ্বর থেকে ঘুরে আসতে পারেন চাইলে। হাতে আরও কিছুটা সময় থাকলে চলে যান ভৈরব, চমৎকার কাটবে বিকেলটা। 
সাবধানতা
বাগান দেখতে গিয়ে নষ্ট করবেন না বাগান কিংবা ফল। মালিকের অনুমতি নিয়ে তবেই গাছ থেকে ফল ছিঁড়বেন।