বাংলার বিলুপ্তপ্রায় নৌকা নিয়ে প্রদর্শনী

সারি সারি নৌকা। একপাশে নৌকা বানানোর কাজ করছেন দু’জন কাঠমিস্ত্রী, সঙ্গে কাঠ ও লোহার নানা সরঞ্জাম। কৌতূহলী হয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই বুঝলাম প্রদর্শনী চলছে। গুলশান ২-এ অবস্থিত সুপারশপ ইউনিমার্টে  চলছে এই প্রদর্শনী।

5

সামনেই রাখা ছিল ঐতিহাসিক ময়ূরপঙ্খী নৌকার একটি মিনিয়েচার সংস্করণ। নিখুঁত হাতের কাজ, যেন এখনই নদী পাড়ি দিতে প্রস্তুত! বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মোট ১২টি নৌকা প্রদর্শিত হচ্ছে এখানে। নামগুলোও অদ্ভুত সুন্দর; শুলুক, বালাম, সাম্পান আর চাঁদ নৌকা হচ্ছে সমুদ্রপথের নৌকা আর করপাই, বজরা, ময়ূরপঙ্খী, পাতাম, মালার, হরোঙ্গা, ঘাসি আর গয়না নদীপথের। এর মধ্যে বজরা, গয়না, এবং ময়ূরপঙ্খী হাউজবোট বা বসবাসযোগ্য নৌকা। প্রতিটি নৌকার সাথে লেখা আছে সেটি কোন অঞ্চলের, বড় নৌকার মাপ এবং বর্তমান অবস্থা, অর্থাৎ বিলুপ্ত নাকি এখনোও নদী বা সমুদ্রে চলে। অবাক হয়ে লক্ষ করলাম যে মাত্র ৩টি নৌকা ছাড়া বাকি সবগুলোই এখন বিলুপ্ত! 

6

আয়োজকদের সঙ্গে কথা হলো এই প্রদর্শনী নিয়ে। বেসরকারী সংস্থা ‘ফ্রেন্ডশিপ’ এর ব্যানারে এর সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ ‘কালারস ফ্রম দ্য চরস’ এই আয়োজনের উদ্যোক্তা; এর টিমলিডার আলভিন কোলিন জানালেন, ‘এই আয়োজনের উদ্দেশ্য দুইটি। আমাদের দেশের হারিয়ে যাওয়া এই হাজার বছর পুরোন ঐতিহ্যটাকে মানুষের কাছে তুলে ধরা এবং রেপ্লিকা নৌকা তৈরি করে এটাকে সংরক্ষণ করা।’

1
‘ফ্রেন্ডশিপ’-এর ‘কালচারাল প্রিজারভেশন’ বা ‘সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ’ বিভাগ থেকে পরিচালনা করা হয় নৌকা তৈরি এবং সংরক্ষণের এই কাজ। নৌকার সঙ্গে এই প্রদর্শনীতে আর আছে হাতে তৈরি শাড়ি এবং স্কার্ফ।

7
গাইবান্ধা কিংবা কুড়িগ্রামের প্রত্যন্ত চরগুলোতে নেই জীবনযাত্রার ন্যুনতম সুবিধা। দুর্গম এই চরগুলোর সুবিধাবঞ্চিত নারীদের কর্মসংস্থান করতে গিয়েই ‘ফ্রেন্ডশিপ’ সেখানে গড়ে তুলেছে কাপড় বুনন কেন্দ্র। শ’খানেক সুবিধাবঞ্চিত নারী কাপড় বুনছেন বাংলার ঐতিহ্যবাহী তাঁতে। সামাজিক উন্নয়নের অংশ হিসেবেই গত এক দশকে দুর্গম চরের সুবিধাবঞ্চিত প্রায় হাজারখানেক নারীকে কাপড় বোনার প্রশিক্ষণ দিয়েছে ‘ফ্রেন্ডশিপ’। তাদের বানানো পোশাক নিয়েই ‘কালারস ফ্রম দ্য চরস’-এর নামকরণ এবং যাত্রা।

4

প্রদর্শনীর একাংশে লাইভ ওয়ার্কশপে কাঠমিস্ত্রীদের একজন বানাচ্ছেন নৌকার কাঠামো, আরেকজন ছই আর পাল। কথা হলো তাদের সঙ্গে। একজন ভোজন চন্দ্র সূত্রধর এবং অন্যজন মোঃ ফজলুল হক। ভোজন চন্দ্র সূত্রধর এই পেশায় এসেছেন তার বাবা বৈদ্যনাথ চন্দ্র সূত্রধরের হাত ধরে। ভোজনের ভাই কার্তিক চন্দ্র সূত্রধরও ছোটবেলা থেকে এই নৌকা বানানোর পেশায় জড়িত পৈতৃক সূত্রেই। দু’জন এই প্রদর্শনীতে এসেছেন ‘ফ্রেন্ডশিপ’ এনজিও’র মাধ্যমে। এই এনজিও’র সঙ্গে তারা সরাসরি কাজ করছেন ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে। জানালেন, লাইফ সাইজ বোট বা আসল বড় নৌকা বানাতে যে সকল কৌশলের প্রয়োজন হয় ঠিক একই কৌশলেই বানানো হয় এই রেপ্লিকা নৌকাগুলো। ডিজাইনভেদে সময় লাগে দু’সপ্তাহ থেকে দেড় মাস পর্যন্ত।

3

আয়োজনে প্রদর্শনীর সঙ্গে পণ্য বিক্রিও হচ্ছে। জিগ্যেস করাতে নৌকার দাম পাঁচ সংখ্যার শুনে মোটামুটি আঁতকে উঠলাম। এবং পরমূহুর্তে যেন একটু লজ্জাও পেলাম মনে মনেই। এগুলো তো আসলে একেকটি শিল্পকর্ম, আর শিল্পকর্ম কি আর মূল্য দিয়ে যাচাই করা যায়! 

2    

গত ১৩ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া এই প্রদর্শনী এবং বিক্রয়কেন্দ্র খোলা থাকবে আগামী ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। প্রতিদিন সকাল ১১টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত চলবে বাংলার নৌকার এক অসাধারণ সংগ্রহের এই প্রদর্শনী।
ফ্রেন্ডশিপ সম্পর্কে

ফ্রেন্ডশিপ একটি প্রয়োজনীয়তাভিত্তিক বেসরকারী সংস্থা (এনজিও) যা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে কাজ করে। ২০০২ সালে রুনা খান কর্তৃক ফ্রেন্ডশিপ প্রতিষ্ঠিত হয় একটি ভাসমান হাসপাতালের উদ্ভাবনী ধারণা দিয়ে। তারপর ফ্রেন্ডশিপ ক্রমাগতভাবে তার স্বতন্ত্র সমন্বিত সামাজিক উন্নয়ন মডেল তৈরি করে প্রত্যন্ত এলাকায় নিয়মতি কাজ করে যাচ্ছে। যার মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, সমন্বিত নাগরিকত্ব, স্থায়ী অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ।

বিস্তারিত দেখতে পারেন এখানে-www.facebook.com/events/284261792185864/?event_time_id=284261818852528