মুক্তিযুদ্ধের গল্প জানতে মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্সে

muktijuddho smriti complex (15)

চমৎকার একটি আম বাগান। আম্রকাননটির মালিক ছিলেন কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের ভবের পাড়ার জমিদার বৈদ্যনাথ বাবু। বৈদ্যনাথ বাবুর নামানুসারেই যায়গাটির নাম হয়ে যায় বৈদ্যনাথ তলা। আম বাগান বা বৈদ্যনাথতলাতে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল প্রথম অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। শপথ গ্রহণ করেন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার, পাঠ করা হয় বাংলাদেশ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। শপথগ্রহণ এবং ঘোষণাপত্র পাঠের পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ একটি বিবৃতি পাঠ করেন এবং বৈদ্যনাথতলার নাম রাখেন মুজিবনগর। সেই থেকে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার নাম হয় মুজিবনগর। সেদিন মুজিবনগরকে অস্থায়ীভাবে বাংলাদেশের রাজধানী ঘোষণা করা হয়। দেশ স্বাধীন হলে বঙ্গবন্ধু জায়গাটি সঠিকভাবে সংরক্ষণের নির্দেশ দেন। তার নির্দেশনার পর মুজিবনগর সরকারকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ১৯৭৪ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবসের দিন মুজিবনগর স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়।

মূলত, মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ নির্মাণের মূল কাজ শুরু হয় ১৯৮৭ সালে। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ মুজিবনগরকে গুরুত্ব দিয়ে স্বাধীনতার স্মৃতি ধরে রাখতে ২৩ স্তরের স্মৃতিসৌধ গড়ে তোলেন। মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ উদ্বোধন হয় তারই হাতে। স্মৃতিসৌধের নকশা স্থপতি তানভীর করিম। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা মুজিবনগর কমপ্লেক্স নির্মাণ কাজে হাত দেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম স্মরণীয় স্থান মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ তথা মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্স নিয়েই গল্প।
 

আম্রকানন

দুই
ভোরের কুয়াশা চারদিকে। আমরা কুষ্টিয়া মেহেরপুর হয়ে মুজিবনগর এসেছি রাতে। রাতেই বলা ছিল ভোরে বের হবো। কথামতো বের হলাম। গন্তব্য মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ। বেশি দূরে নয়, আমাদের বাংলো থেকে ৫ মিনিটের পথ। আবু জাফর আর শাহেদ ভাইকে ডেকে বের হতে যাবো, দেখি অজয় সরকারও চোখ কচলে আমাদের সঙ্গী হয়ে গেছে। পথে নামতেই ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাপটা গায়ে এসে লাগলো। আহা কি অসাধারণ সুন্দর চারদিক! আবেশে আচ্ছন্ন হতে থাকলাম। একটু এগিয়েই পেয়ে গেলাম আমবাগান। এটাই বিখ্যাত আম্রকানন। সূর্যের সমস্ত আলো সে সময় আমবাগানকে আলোকিত করে রেখেছে। চোখে শুধু অনাবিল মুগ্ধতা। সে মুগ্ধতা নিয়ে আরও মিনিট খানেক হেঁটে চলে এলাম মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধের কাছে। সেই সাত সকালে একজন সেবক পুরো স্মৃতিসৌধ ঝাড়– দিয়ে চলেছেন। আমার মুখ থেকে বের হবার আগেই আবু জাফর বলল আরে সুভাষ মল্লিক যে! সংবাদপত্রের মাধ্যমে সুভাষ মল্লিকের কথা আমাদের সবার জানা। সাদা মনের মানুষ হিসেবে খ্যাত সুভাষ মল্লিক পরিচ্ছন্নতাকর্মী নন। তবুও স্মৃতিসৌধ নির্মাণের পর থেকেই নিয়মিত ঝাড়ু দিয়ে পরিস্কার করেন। থাকেন কাছেই ভবের পাড়ায়। নিজের তাগিদেই প্রতিদিন স্মৃতিসৌধ পরিস্কার করেন। তবে দৈনিক পত্রিকায় ফিচার লেখা হলে তার জন্য বেতন ধার্য করা হয় ৫০০ টাকা। যা দিনে দিনে বেড়ে হয়েছে ২০০০ টাকা। সংসার চালানোর জন্য পর্যাপ্ত নয়। তবু এ নিয়ে তার কোনও আক্ষেপ নেই। স্মৃতিসৌধ প্রতিদিন পরিচ্ছন্ন করতে পারাতেই তিনি তুষ্ট।

সুভাষ মল্লিক স্মৃতিসৌধ পরিষ্কার করছেন

স্মৃতিসৌধ পরিষ্কার শেষ হলে আমরা সুভাষ মল্লিকের সঙ্গে কথা বলি। তিনি আমাদের বলে চলেন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি। মুজিবনগরে শপথ গ্রহণের স্মৃতি। মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ নির্মাণ ও স্মৃতি কমপ্লেক্সের কথা। তারপর বলেন, ‘এই যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, সেই যুদ্ধে অগণিত শহীদের অবদান ও আত্মত্যাগ। আমি তো কিছুই করতে পারিনি। তাদের স্মৃতিঘেরা এই যায়গাটুকু পরিস্কার রাখার চেষ্টা করি। একটু ময়লা দেখলে আমার কষ্ট হয়!’ আমরা মুগ্ধ হয়ে তার কথা শুনি। তারপর স্মৃতিসৌধ হয়ে পুরো মুক্তিযুদ্ধ কমপ্লেক্স ঘুরে দেখি।

এক নজরে মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ কমপ্লেক্স
প্রায় ৮০ একর জায়গার উপর দাঁড়িয়ে আছে মুজিবনগর কমপ্লেক্স। আম্রকাননের জায়গার পরিমাণ প্রায় ৪০ একর। এখানে আম গাছ রয়েছে ১৩০০। তিনটি ধাপে ছয় স্তর বিশিষ্ট দুটি গোলাপ বাগান। বাগান দুটিতে গোলাপ আছে ২২০০। এখানে আছে বঙ্গবন্ধু তোরণ, অডিটোরিয়াম, শেখ হাসিনা মঞ্চ, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকেন্দ্র, মসজিদ, হেলিপ্যাড, ২৩টি কংক্রিটের ত্রিকোণ দেয়ালের সমন্বয়ে উদিয়মান সূর্যের প্রতিকৃতিকে প্রতীক করে মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ, প্রশাসনিক ভবন, টেনিস মাঠ, পর্যটন মোটেল, স্বাধীনতা মাঠ, স্বাধীনতা পাঠাগার, বিশ্রামাগার, পোষ্ট অফিস, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, শিশুপল্লী, ডরমেটরি ও মুক্তিযুদ্ধের সেক্টরভিত্তিক বাংলাদেশের মানচিত্র।

বাংলাদেশের মানচিত্র
মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধের পাশাপাশি এখানে রয়েছে বাংলাদেশের মানচিত্র। আমাদের যুদ্ধকালীন অবস্থার রূপক এটি। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী মহান মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টরকে ভাগ করে দেখানো হয়েছে মানচিত্রে। মানচিত্রের উত্তর দিকটা উঁচু থেকে ক্রমান্বয়ে দক্ষিণ দিকটা ঢালু করা হয়েছে। এবং সমুদ্র তীরবর্তি অঞ্চলসমূহকে দেখানো হয়েছে পানির ওপর ভাসমান। মুজিবনগর কমপ্লেক্সের মাষ্টার প্ল্যান করেছে স্থাপত্য অধিদপ্তর। মানচিত্রের ডিজাইন বিআরটিসির। বুয়েট আর্কিটেক্টদের সংগঠন বিআরটিসি।

কমপ্লেক্সের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় ভাস্কর্য। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ, ঐতিহাসিক তেলিয়া পাড়া সম্মেলন, মুজিবনগর সরকারের শপথ অনুষ্ঠান, পাকবাহিনীর আত্নসমর্পণ, রাজাকার আল বদর, আল সামস এর সহযোগিতায় বাঙ্গালী নারী পুরুষের ওপর পাক হানাদার বাহিনীর নির্যাতনসহ খেতাব প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ভাস্কর্যের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে।

মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ
স্মৃতিসৌধের মূল নকশা স্থপতি তানভীর করিমের। এটি বাংলাদেশের অন্যতম স্থাপত্য নিদর্শন। স্মৃতিসৌধ স্থাপনার মূল বৈশিষ্ট্য ১৬০ ফুট ব্যাসের গোলাকার স্তম্ভের উপর মূল বেদীকে কেন্দ্র করে ২০ ইঞ্চির ২৩টি দেয়াল। দেয়ালগুলো উদিয়মান সূর্যের প্রতীক। ৩০ লক্ষ শহীদের স্মৃতি স্মরণীয় করে রাখার জন্য স্মৃতিসৌধের মেঝেতে ৩০ লাখ পাথর বসানো হয়েছে। স্মৃতিসৌধের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে লাল মঞ্চ, ২৩টি স্তম্ভ, বুদ্ধিজীবীর খুলি, ৩০ লক্ষ শহীদ, রক্তের সাগর এবং ঐক্যবদ্ধ সাড়ে সাত কোটি জনতা।

স্বাধীনতার রক্তাক্ত  সূর্যের মাধ্যমে লাল মঞ্চকে তুলে ধরা হয়েছে, সেখানে দাঁড়িয়েই অধ্যাপক ইউসুফ আলী স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেছিলেন। ২৩টি স্তম্ভ হল ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত পাকিস্তানের শাসন নিপীড়নসহ বাঙ্গালীর স্বাধীকার আন্দোলন ও স্বাধীনতার প্রতীক। স্মৃতিসৌধের মূল বেদীতে গোলাকার বৃত্তের মাধ্যমে শহীদ বুদ্ধিজীবীর খুলি বোঝানো হয়েছে। স্মৃতিসৌধের মূল বেদীতে ওঠার জন্য মোট ১১টি সিড়ি ব্যবহার করতে হয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন সারাদেশে মুক্তিযোদ্ধারা যে ১১টি সেক্টরে ভাগ হয়ে যুদ্ধ করেছেন ১১টি সিড়ি সেই ১১টি সেক্টরের প্রতীক। আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনের প্রতীক হলো স্মৃতিসৌধের মূল ফটক ধরে এগিয়ে চলা পথটি। পথটি শেষ হয়েছে রক্তের সাগর নামক ঢালু প্রান্ত ছুঁয়ে। স্বাধীনতার লাল মঞ্চ থেকে যে ২৩টি দেয়াল স্মৃষ্টি হয়েছে, সে সব দেয়ালের ফাঁক-ফোঁকর বন্ধ করার জন্য অসংখ্য নুড়িপাথর ব্যবহার করা হয়েছে। এই নুড়িপাথর গুলো সাড়ে সাত কোটি ঐক্যবদ্ধ জনতার প্রতীক।

শেষ কথা
কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের মুজিবনগরে অস্থায়ী মুজিবনগর সরকারের শপথ নেওয়ার কথা ছিলো না। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল ভারতের আগরতলায় এক সভায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীমুক্ত কুষ্টিয়া জেলার মহকুমা চুয়াডাঙ্গাকে বেছে নেওয়া হয় এবং ১৪ এপ্রিল অস্থায়ী সরকার শপথ গ্রহণের তারিখ চূড়ান্ত হয়। কিন্তু শপথ গ্রহণের তারিখ সে সময় আকাশবানী কলকাতা কেন্দ্রে প্রচার হলে বিদেশি সাংবাদিকসহ পাকহানাদার বাহিনী ঘটনা জেনে ফেলে। চুয়াডাঙ্গার ওপর পাকবাহিনী আক্রোশে ফেটে পড়ে। ব্যাপক বোমা হামলা চালিয়ে পাকহানাদার বাহিনী চুয়াডাঙ্গা দখল করে নেয়। হার্ডিঞ্জ সেতু উড়িয়ে দেবার জন্য গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। চুয়াডাঙ্গা দখল ও পাকহানাদার বাহিনীর দ্বারা হার্ডিঞ্জ ব্রীজ আক্রান্ত হলে শপথ অনুষ্ঠানের সময় ও যায়গা পাল্টে যায়। পরবর্তীতে শপথ অনুষ্ঠানের জন্য ভারত সীমান্তবর্তী বৈদনাথতলা বা মুজিবনগরকে বেছে নেওয়া হয়। এবং শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়।
 

২০১১ সালের জুন মাসে মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্স জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করার কথা থাকলেও আজ পর্যন্ত কাজ শেষ করে তা উন্মুক্ত করা সম্ভব হয়নি। তারপরও দর্শনার্থীর ভিড়ে জায়গাটি প্রতিদিন সরগরম থাকে। মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্স আমাদের মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত ইতিহাস। চাইলে বিজয়ের মাস ডিসেম্বরেই সবাই মিলে ঘুরে আসতে পারেন এখান থেকে।  

ছবি: লেখক
 

/এনএ/এফএএন/