জীবন্ত শিল্পকর্ম ‘বনসাই’

ব্যালকনিতে রাখা ছোট্ট টবে যদি ঝুরি নামিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বট গাছ, তবে কেমন হয়? ইচ্ছে হলে জারুল বা তেঁতুলের মতো গাছও দিব্যি পাকাপোক্ত আসন গাড়বে আপনার বারান্দায়। হ্যাঁ, বলা হচ্ছে বনসাই শিল্পের কথা। নান্দনিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ বনসাই যেন এক জীবন্ত শিল্পকর্ম। শক্ত কাণ্ডের গাছকে সুনিপুণভাবে খর্বাকৃতি করার এ শিল্পে যদি আপনি পারদর্শী হয়ে থাকেন, তবে পছন্দমতো গাছে সাজবে বাড়ির আঙিনা। পারদর্শী না হলেও ক্ষতি নেই। যত্নআত্তি সম্পর্কে ঠিকঠাক জেনে কিনে নিয়ে আসতে পারেন বনসাই। পাথুরে অট্টালিকার কোণায় সজীবতা ছড়াবে শখের গাছটি।

 

বনসাইয়ের ইতিহাস
বনসাই একটি জাপানি শব্দ। এর অর্থ অগভীর পাত্রের গাছ। বড় প্রজাতির গাছকে বিশেষ ধরনের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ছোট অগভীর পাত্র বা টবে ছোট আকৃতিতে রূপান্তর করে রাখাই হলো বনসাই। চীনা শব্দ ‘পেনজাই’ থেকে জাপানি ‘বনসাই’ শব্দের উৎপত্তি। বনসাই করতে ব্যবহৃত ট্রের মতো যে পাত্র ব্যবহার করা হয়, তাকেই সাধারণভাবে ‘বন’ বলা হয়। পাশ্চাত্যে পাত্রে ক্ষর্বাকৃতির গাছ বলতে ‘বনসাই’ বোঝায়।

প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় পাত্রে বা টবে গাছ বা বিভিন্ন ধরনের গাছের চারা উৎপাদনের কথা জানা যায়। ৪০০০ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দের রাজনৈতিক নথিপত্র থেকে পাথর কেটে তৈরি করা পাত্রে গাছ চাষের হদিস পাওয়া যায়। প্রচুর মন্দিরে তৃতীয় ফারাও রামেসেস পাত্রে লাগানো জলপাই, খেজুর এবং অন্যান্য গাছের বাগান দান করেছিলেন। প্রাচীন ভারতে ঔষধ আর খাবারের জন্য টবে বা পাত্রে গাছ লাগানোর প্রচলন ছিল।

প্রথম প্রথম জাপানিরা পাত্রে জন্মানো বামনকৃত গাছ ঘরবাড়ি আর গাছ সাজাতে ব্যবহার করতো। পরবর্তীতে বিস্তৃর্ণ বাগান তৈরি বিশেষ গুরুত্ব পায়। ধনীদের অবসরে বিনোদনের মাধ্যম হয়ে ওঠে আজালিয়া এবং ম্যাপলের মতো গাছ পালন করা। বামনকৃত গাছ পাত্রে পালন করাও জনপ্রিয় ছিল। মোটামুটি ১৮০০ সালের দিকে জাপানিরা তুলনামূলকভাবে কম গভীর পাত্রে ক্ষুদ্র গাছ পরিচর্যা করার সাথে সাথে চৈনিক ‘পেনজাই’ শব্দের উচ্চারণ পরিবর্তন করে ফেলে।

নিজেই তৈরি করুন বনসাই
যদি থাকে ধৈর্য ও ইচ্ছা, তবে আপনিও তৈরি করে ফেলতে পারেন চমৎকার বনসাই। চারা সংগ্রহের পর ১০ সেন্টিমিটার উচ্চতার টবে মাটি তৈরি করে রোপণ করুন সেটা। সাধারণত মোটা কাণ্ডের যেসব গাছ খুব ধীরে বাড়ে সেগুলোই বনসাই তৈরির জন্য উপযুক্ত। বট, তেঁতুল, নিম, অশ্বথ, অর্জুন, শিমুল,  কৃষ্ণচূড়া, করমচা, দেবদারু, বকুল গাছ নির্বাচন করতে পারেন বনসাই তৈরির জন্য। আবার লাল গোলাপ, কনকচাপা, বাগানবিলাস কিংবা মেহেদি গাছের বনসাইও বেশ দেখাবে।

বনসাইয়ের পরিচর্যা

  1. গাছকে নিয়মিত খাবার দিতে হবে। আলো বাতাস চলাচল করে এমন জায়গায় রাখতে হবে।
  2. অতিরিক্ত রোদ বা পানি থেকে দূরে রাখুন।
  3. গাছের আকৃতি ঠিক রেখে ডাল পাতা ছাঁটতে হবে।
  4. এক বছর পর পর টবের মাটি বদলাতে হবে।
  5. আগাছা জন্মানো মাত্র তুলে ফেলুন। 

গৃহসজ্জায় বনসাই
বনসাই ইন্টারিয়র ডিজাইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। শখের বসে গৃহকোণে বনসাই রোপণ করতে চাইলে প্রথমেই সঠিক জায়গাটি নির্বাচন করতে হবে। বসার ঘরের জন্য সাধারণত বট বা ছাতিম গাছের বনসাই বেশি মানানসই। দুই সোফার মাঝে একটি কাচের বা মার্বেল পাথরের টেবিলের উপর সুদৃশ্য পাত্রে বনসাই সাজিয়ে রাখা যায়। তবে সেটি যেন অবশ্যই আই লেভেল বরাবর হয়। সবুজ রঙের বনসাইয়ের পেছনের দেয়ালটা যদি লাল, কমলা বা নীল হয় তবে দেখতে চমৎকার লাগবে। বনসাইয়ের স্থানে যদি সিলিং থেকে একটি স্পটলাইট লাগানো যায় তবে আলো ছায়ার খেলায় এক মোহনীয় পরিবেশ সৃষ্টি হবে। বসার ঘরের পাশাপাশি অন্যান্য যেকোনো ঘরেও বনসাই রাখা যায়। তবে যে ঘরেই রাখা হোক না কেন সবসময় এমন জায়গা বেছে নিতে হবে যাতে সেখানে পর্যাপ্ত আলো বাতাস থাকে এবং স্থানটি শুধু বনসাইয়ের জন্যই হবে। সেখানে ভারি আসবাবপত্রের বাহুল্য থাকবে না। এসব জায়গায় বটের পাশাপাশি তেঁতুল, করমচা বা কুকেন ট্রির মত বিদেশি গাছের বনসাই রাখা যায়। বারান্দায় ছাদের সজ্জায় ঝুলানো আকৃতির বা লম্বা পাত্রে বনসাই রাখা যায়।

বনসাইয়ের বাণ্যিজ্যিক গুরুত্ব
বনসাইয়ের বাণ্যিজ্যিক গুরুত্বও কম নয়। শুধু শখ পূরণ নয় আজকাল অর্থ আয়ের উদ্দেশ্যেও অনেকেই বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এর চাষাবাদ শুরু করেছেন। শুধু বাড়ি নয় আজকাল অফিস, শপিং কমপ্লেক্স সাজাতেও বনসাই ব্যবহার করা হচ্ছে। তাই এর প্রচুর বাণিজ্যিক চাহিদা রয়েছে। এছাড়াও কখনও কখনও দুর্লভ প্রজাতির বনসাই বিক্রয় করা হয়। এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে এর দাম হয় লক্ষাধিক টাকা।