তিন.
তাঁর উপন্যাসে ভিন্ন সম্প্রদায় অর্থাৎ মুসলিম চরিত্রের দেখা মেলে সামান্যই। কিন্তু সম্প্রদায়গত স্বাতন্ত্র্য খুব স্পষ্টভাবেই ভাষারীতিতে প্রতিফলিত হতে দেখা যায়। সম্প্রদায়গত স্বাতন্ত্র্যের সাথে অসাম্প্রদায়িকতার এক অসাধারণ মেলবন্ধন দেখা যায়, যা কি না ইতোপূর্বে কেবলমাত্র কাজী নজরুল ইসলামে পরিদৃষ্ট হয়েছিল। বলা বাহুল্য, জীবনানন্দ দাশ প্রথম জীবনে তাঁর দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত ছিলেন।
‘বাসমতীর উপাখ্যান’ উপন্যাসে জাহাজের বাটলাররূপী গফুর চরিত্রটির ক্ষণকালীন আবির্ভাবে পূর্ববঙ্গীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের ভাষা ও সংস্কৃতির কিয়দংশের পরিচয় পাওয়া যায়। স্বাভাবিকভাবেই মুসলিম বাটলারের ভাষায় আরবি-ফারসি-উর্দু-তুর্কি প্রভৃতি ভাষার শব্দ ভাণ্ডার থেকে অসংখ্য শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। গফুরের সংলাপে ইংরেজি শব্দেরও বিচিত্র ব্যবহার দেখা যায়। সম্ভবত জাহাজে চাকুরি করার সুবাদে নানা দেশি-বিদেশি যাত্রীর সংস্পর্শে এসে তার এই মিশ্র ভাষার উদ্ভব। এছাড়া পূর্ববঙ্গীয় আঞ্চলিক উপভাষার প্রভাবে ধ্বনিগত পরিবর্তন তো রয়েছেই।
বাটলার গফুরের ভাষায় খাঁটি দেশি শব্দ এবং স্বতন্ত্র বিশিষ্ট শব্দগুচ্ছের ব্যবহার দেখা যায়। যেমন: আঠালির ঠাল, চাক্কিভাঙা, ব্যাসকম, চ্যাগাইয়া চ্যাগাইয়া, উটকাল চ্যাঙ, ট্যাডন, পাছড়াপাছড়ি, ফ্যারে ফেলা, জাইক্কুর দেয়া, ঘেটি।
এছাড়াও রয়েছে বিশিষ্টার্থে প্রয়োগ, প্রবাদ-প্রবচন এবং বাগধারা। যেমন: প্যাডে প্যাডে কাছিমের লাহান; আণ্ডা পাইলেই হইল, কাক কাইত্তরে ঠ্যাহেনা; ভেটকি মাইরা পাছাড় খাইব; জৈবন ফারাক যাওয়া; বিলশা কাঁটার ইলশা গোদার ফুটানি; ফুটানি মারা; কথার মুড়া পাওয়া; পাছা দিয়া ভেটকি মারা; দর কচকচি করা; ফরমান দেওইন্যা মানুষ।
এ তো গেল ভাষার উপরিভাগের অতিসামান্য আলোকপাত। বাটলারের কথার দুটি প্রসঙ্গে সম্প্রদায়গত পরিচয় এবং সম্প্রদায়হীন মানবতাবোধের বিষ্ময়কর উপলব্ধি প্রকাশিত হয়। বাটলার গফুর মিয়া স্টিমার যাত্রী প্রভাসবাবুর কাছে নিজ রান্নার দক্ষতা সম্পর্কে অতি আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে নিজেকে জাহির করতে গিয়ে জানায় যে তার মতো পাঙাশ মাছ রান্না করে দিতে না পারলে সেই বিবিকে তালাক দেয়ার উপক্রম করবে যে কোন ভদ্রলোক। উল্লেখ থাকে যে, বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে এখনো বহুল প্রচলিত যে, মৌখিক তিন তালাকের মাধ্যমেই স্ত্রী বিচ্ছেদ ঘটানো যায়। স্ত্রীকে তালাক দেবার ক্ষমতার যে ধর্মীয় আইন, সেই ক্ষমতার যথেচ্ছ ব্যবহার তাদেরই অপসংস্কৃতির অংশ বলে ধরে নেয়া যায়। বাটলারের কথায় একই সাথে মুসলিম নারীর অবরুদ্ধ অপদস্থ জীবনের ছবি ফুটে ওঠে, আবার তালাকের মতো স্পর্শকাতর বিষয়টি ঐ সম্প্রদায়ের ভেতর কতখানি ঠুনকোভাবে বিরাজমান তা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়।
অন্যত্র সে কৌতুকের ভঙ্গিতে অদ্ভুত এক কথা বলে, ‘মোছলমানের বাচ্চা হইয়া আল্লাহতায়ালার নাম না কইয়া কইলাম ধম্মো- মাসুদ চাচা হুনলে- যাতে চ্যাগাইয়া হাটতে হয় হেই ব্যবস্থা করত। ... মাসুদ চাচার মাটির উপর তাল-নাইরকোল গজাইব, হেইয়ার পিডা আর লাড়ু খাইব তামাম দেশ, চাচা কোথায় তখন?’ (পৃ: ৩১) অনুপস্থিত মাসুদ চাচার মনোভাব তৎকালীন দেশ বিভাগোত্তর উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আর বাটলারের অদ্ভুতুড়ে সব উপমার ব্যবহারে শেষ পর্যন্ত খুঁজতে খুঁজতে লালনের সর্বজাতিক অবিমিশ্র অনুভূতির রাস্তাটা পেয়েই যাই।
‘সুতীর্থ’ উপন্যাসের নায়ক নগর কলকাতার ফুটপাথে হেঁটে বেড়ায় নিশিগ্রস্তের মতো। হাঁটতে হাঁটতে যেন স্বপ্নের ঘোরেই দেখা হতে থাকে ছেলেবেলার বন্ধুদের সাথে। দেখা হয় হারান নামের এক পকেটমার ছেলের সাথে যার বাবার নাম একই সাথে শোভান ঘোষ ও সোভান মিয়া। দেশের ভাঙন, সম্প্রদায়ের ভাঙন অথবা সম্প্রীতির ভাঙনের চেহারা আরো ব্যাঙ্গাত্মক হয়ে ফুটে ওঠে এই দ্ব্যর্থবোধক দ্বি-নামকরণের মধ্য দিয়ে।
চার.
স্বীকার করতেই হবে, অসম্পূর্ণ এই আলোচনা। প্রকৃতপক্ষে, এত স্বল্প পরিসরে জীবনানন্দ রচনার ভাষা সম্পর্কে আংশিক গভীরে যাওয়াও অসম্ভব। বড়জোর এক ঝলক নজর বুলিয়ে নেয়া যায়। তাঁর উপন্যাসে, কবিতার মতই উপমা-প্রতীক-পরিভাষা-বিশিষ্ট শব্দগুচ্ছের সুবিশাল ভাণ্ডার রয়েছে। যদিও কবিতাতেই তিনি উপমা-প্রতীকের সৌজন্যমূলক আব্রুকে ছিড়েঁ-ফেঁড়ে দিয়েছিলেন।
মানুষেরি হাতে তবু মানুষ
হতেছে নাজেহাল
পৃথিবীতে নেই কোন বিশুদ্ধ চাকরি-
(সৃষ্টির তীরে/সাতটি তারার তিমির)
‘চাকর’ কোন গ্রামীণ বা লোকজ শব্দ নয়। কোন প্রতীকও নয় অথচ এই প্রচলিত কেজো শব্দটি কবিতায় ঢুকিয়ে দিলেন তীরন্দাজের ভঙ্গিতে, অগ্র-প্রশ্চাৎ বিবেচনা ছাড়াই।
তবুও, অগণিত লোকজ শব্দের ব্যবহার সত্ত্বেও কবিতায় এক ধরণের মনোজগৎকেন্দ্রিক স্বপ্নচারী ভূবন সৃষ্টি হয়। সেই ভূবন থেকে গদ্যের কোলাহলমুখর জনারণ্যে প্রবেশ করতে গিয়ে তিনি Classified social dialect এর পথ ধরে এগিয়ে যান। এতে উপন্যাসের পটভূমিতে ভাষার বহুস্তর বিশিষ্ট Polyphony সৃষ্টি হয়েছে। তবুও শেষ পর্যন্ত কথাসাহিত্যে তাঁর নিজস্ব Dominant voice এর প্রভাব এড়াতে না পারলেও বিরূপাক্ষ অথবা গফুর মিয়ারা ‘ঘন বাইষ্যার খানালোর ব্যাঙের মতন জাইক্কর দিয়া কথা’ বলে উঠেছে।
নোয়াম চমস্কি কথিত ভাষার ‘অনন্ত সম্ভাবনা’ অবিরলভাবে তাঁর রচনায় পরিদৃষ্ট হয়। প্রায়-বিচ্ছিন্ন স্ত্রীর কাছে নায়ক মাল্যবানের আবেগী সংলাপ প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এলে নিজের মুখাবয়বকে ‘চিড়িয়াখানার বানরের আকচার ছোলা ভাজা চিবোবার মত’ মনে হয়। রুগ্ন, অবহেলিত কন্যাশিশুটির উপমা ‘মিঠাইয়ের দোকানের খানিকটা বাসি পরিত্যক্ত ময়দার মত যেন কারা যে পিষতে-পিষতে ফেলে দিয়ে চলে গেছে। ... দাঁড় কাকের ঘাড়ের ভিজে রোমের মত কতকগুলো কালো পাতলা চুল। (কারুবাসনা/পৃ: ৫৩)
ভাষার এমনই মর্মস্পর্শী অথচ নিরুত্তাপ প্রকাশ, ঠিক যেন তাঁর ঝকঝকে চোখের অর্ন্তভেদী হাসিটি।
কবি আলতাফ হোসেন আমাদের ভাষিক-অভ্যেস সম্পর্কে বলতে গিয়ে জীবনানন্দীয় ভঙ্গিতেই বিদ্রুপের বরফ-বুলেট ছুড়েঁ মারেন। -‘জীবনানন্দ জানতেন আমরা এখনো প্রিমিটিভ সাইন ল্যাঙ্গুয়েজেই কথা বলি, যদিও পঞ্চাশ বছরে বাংলা সাহিত্যে পঞ্চাশ হাজার বছরের পথ পেরিয়েছে তবুও আমরা ল্যাংচাতে আজো হেঁটে যেতে থাকি রসুলপুরের হাটে, কিংবা হরিদাসপুরে?’
জীবনানন্দ দাশ- শুদ্ধতা প্রত্যাশী বৈয়াকরণদের দ্বারা সমস্ত জীবনভর নিগৃহীত হয়েছেন যিনি। তাঁর কবিতার ভাষালক্ষণ নিয়েই আজো পাঠক-সমালোচক-গবেষকগণ বিস্মিত-বিমূঢ় হয়ে আছেন। একথা সর্বজনবিদিত যে, কোন কবিই শেষ পর্যন্ত তাঁর প্রভাববলয়মুক্ত থাকতে পারেন না। জীবনানন্দ দাশ যখন প্রথম পর্বের উপন্যাস লিখছেন, তখন কল্লোলীয় কথাশিল্পীদের রচনা প্রকাশিত হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু তাঁর উপন্যাসে কল্লোলীয় কথা সাহিত্যের প্রভাব কোথায়? তাঁর কবিতাতেও ‘কল্লোল প্রভাব সেভাবে ছিল কি? সালাহউদ্দীন আইয়ুব এই প্রশ্নের সমাধান দিয়ে দেন তাঁর উপন্যাসকে ‘নিজস্ব চারিত্র্য-চিহ্নিত’ রূপে উল্লেখ করে। তাতে আদৌ সমাধান মেলে কি? ‘নিজস্ব চারিত্র্যচিহ্নিত’ নয় কোন শিল্পী-কবি-রচনাকার, যাঁরা ইতিহাসের পাতায় মুদ্রিত হয়েছেন (অথবা হননি)?
আসলে সম্পূর্ণ প্রস্তুতিবিহীন জনপদে তাঁর সৃষ্টির পদধ্বনি দুঃসাহসী উচ্চাকাঙ্খাই ছিল। এ প্রসঙ্গে ‘দুর্মুখ’ হিসেবে খ্যাত নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর বক্তব্যই অনুসরণযোগ্য।
‘যেমন সূর্যোদয়ে প্রসন্ন বা সূর্যাস্তে বিষণ্ন হবার ভাগ্য সকলের ঘটে না, তেমনি কবিতা পাঠকদেরও সকলের জন্যই জীবনানন্দ নন।’
অথবা,
‘উত্তরের জন্য যাঁরা কবিতা পড়েন জীবনানন্দের কবিতা তাঁদের জন্য নয়।’
এইসব দুঃসাহসিক মন্তব্য তাঁর সকল রচনার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ভাষা বিষয়ে জীবনানন্দ দাশেরই স্ব-ভাষ্যে দু ছত্র তুলে দিয়ে শেষ করা যাক।
মানুষের ভাষা, তবু অনুভূতিদেশ থেকে আলো
না পেলে নিছক ক্রিয়া; বিশেষণ;
এলোমেলো নিরাশ্রয় শব্দের কঙ্কাল
জ্ঞানের নিকট থেকে ঢের দূরে থাকে।
(১৯৪৬-১৯৪৭/শ্রেষ্ঠ কবিতা)
আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন-