রফিক আজাদ কবেই যেন পৌঁছে যান ওসব সদর দরোজা পেরিয়ে অনেক খোলা মাঠে। বিস্তর প্রান্তরে—গ্রাম ছেড়ে একদিন ঢাকায়, রমনায়, বাগ-বাগিচায়। পুরো মগজে কবি। পুনর্গঠিত প্রকৃতি। পুনরায় পুনরুক্তি। উৎসবের হাওয়ায় দোলানো জীবনের গান। তখন তো বিরূপ সময়—কিন্তু তার বিপরীতে স্বকণ্ঠ হন। দ্রোহ রয় চিত্তে। আরও অধিক দ্রোহ। পেরুনোর জন্য। প্রতিক্রিয়া জানানোর জন্য। ঠিক সোজা সত্যে। উপায়হীনের উপায় হয়ে। নিষ্কম্প্র রথে। দুলতে দুলতে অধিক হাওয়ায় মেখে। তপ্ত পিপাসায় মেদহীন মদালসে মত্ত তা। স্যাড—স্যাডিস্টদের বিপরীতে। টুকরো টুকরো গ্রাম—নদী, হাওয়া-হাওর-বিরিশিরি কাতো কী! নির্মমতায় ভেজা মমতায় ছাওয়া খুব আনন্দঘন নস্ট্যালজিক জীবন। কতোটুকু কৃত্রিম তা নয়—সারল্যের সার্বভৌমেই সবটুকু গড়া। টুকটুক তুচ্ছতুচ্ছ আনন্দ। প্রত্নচোখ, প্রত্নমায়া—প্রায়শ তীব্র হুংকার... হারামজাদা নইলে... ক্ষেদ, কষ্ট কিন্তু সরলতাও; অধিক মায়ায়—দ্রোহটুকুও ওই মায়াকে ঘিরেই। হাঁটেন কবি। হাটেরও কবি। মানুষের কবি। গণ-মানুষের না হলেও অধিক অনেক মানুষের। ততোধিক জীবনের। সুখের। আতপ্ত সুখের। এ সুখ না সওয়া সুখ। যে সুখ অতুল্য। তাই মা দাঁড়িয়ে থাকেন সন্তানের জন্য—কলাপাতার ছাওয়া ছায়ায়, কবিতায়—রফিক আজাদের কবিতায়। সবুজের সংসার আছে কবির। সে সবুজের সবটুকু এদেশের, এই ইতিহাসের। প্রত্ন চোখের, মায়ার। জীবনানন্দ সবুজ ঘাসের দেশ দেখেন রফিক আজাদ সবুজেই হয়েছেন নিঃশেষ। সবুজ সংসারে তিনি কেমন ছিলেন? কিংবা এখনও এই মৃত্যুর পরে আছেন কেমন? ইতিহাসে-ঐতিহ্যে-প্রত্ন-পুরাণে-প্রকৃতিতে-মাতৃকায়। দরোজায়, ভিটেতে, সমীরণে তুমুল মাদল বাজিয়ে—কবি দুই পাথরের গল্প বলেন। ‘তোমার আমার মনের মধ্যে/ পাথর বেড়ে ওঠে : পাথর তোমার নিরেট গদ্যে,/ পাথর তোমার ঠোঁটে’। খুব আশ্চর্য কবিতা। পাথরকেই শুধু নয়—রাত, স্পর্শ, কথা, নর্তকী, বাদক, গাধা, মানুষ, নারী, চোখের জল কতোকিছুই তার কাছে স্পর্শাতীত হয়ে ওঠে। নিজস্ব হয়ে ওঠে। অধিক সুন্দর হয়ে ওঠে। নতুন হয়। সে সবের ভেতর দিয়ে পথ কাটা চলে। আবেগের রসে মৈথুন চলে। গড়ে সুখানুভূতি। তবে তা ইন্দ্রিয়প্রবণ নয়। ইন্দ্রিয়াতীত। আর তা বলেই এর ভেতরে বিস্তর আনন্দ প্রলুব্ধময় হয়। চাঞ্চল্য দানা বাঁধে। ঢেউ খেলে। আক্রান্ত করে। স্বপ্ন ও সাঁতোয়া চাঁদমারির কল্পকথা যেন। মিথ ও পুরাণকথাও তার আয়োজনের বিরাট বহর। ওটাও উপভোগ্য, করুণাময়, কারুণ্যশীল। কারুবাসনার রূপের অধঃক্ষেপ। কবি তাই বলেন :
নদী ও নারীর মতো
গভীরতাময়
কোনো জলাশয়ে নেমে
খর কিংবা সুকোমল জলের বারতা
করেছি ঘোষণা দ্রুত—এই আমি নগরে বন্দরে;
সাফল্যে ও ব্যর্থতায়, ক্রমে ক্রমান্বয়ে,
মৃত্তিকার স্তরে-স্তরে, পাথুরে গুহার খাঁজে খাঁজে
মানবিক অভিজ্ঞতা এইভাবে সম্পন্ন হয়েছে।
সময় ধেয়ে আসে বা বসন্তের দিনগুলি ধরনের কবিতায় জীবনের কলরোলের অবতার হয়ে ওঠেন তিনি। কার জন্যে? কীসের এ প্রত্যয়? আহ্বান ও উৎসবের উল্লম্ফন। কবিতা দিয়ে জীবন উপভোগ বা উদ্যাপন যার পর নাই সে তো জীবনেরই বংশধর। সে সবকিছুর শ্রেয়তর উৎস। শ্রেয়োশীলতাই তার কর্ম। কিন্তু তা গ্রহণের বা আলিঙ্গনের উপায় কী? সেখানে রফিক আজাদ উল্লাসকে বেছে নেন। ইমেজে গড়েছেন কতো অন্তিম মুহূর্ত! অবিনাশী গানের ছবক আর মিলনের খাঁটি অনুরণনে তিনি নিজেই কেন্দ্র হয়ে ওঠেন—কেন্দ্রেই তিনি সতত—ফলে তাতে অনেক অনেকান্ত ধারাজল গড়ে ওঠে, নবজন্ম সৃজন করে, গর্ভে আর ঔরসে কায়েম হয় ‘আমি’ নামের পুলকময় ভৈরবী, সেটি বিদায়ের নয়—চিরবসন্তের। নবপত্রমায়াজালের। পল্লবময় আনুকূল্যের জারণ। একটি অবিনাশী কবিতা এমন উল্লাসে পড়া যায় :
স্বপ্নে ভেতরে দেখা বাড়ি
নদীতীরে নাকি প্রশস্ত রাস্তার পাশে
অবস্থিত আমার তা মনে নেই মোটে!
শুধু মনে পড়ে : গভীর ঘুমের মধ্যে
একটি বাড়ি জেগে আছে, স্বপ্ন সমুজ্জ্বল।
কবি রমণে তৃপ্তি চান। সেটি শুধু ইন্দ্রিয়জ নয়। কিংবা বিপরীত আকর্ষক ভোগপ্রবণতায় নয়। কোনো শরীরেও নয়। নির্ধারিত বস্তুও নয়। তা মনে ও অমরত্বে। ইান্দ্রয়াতীতে। যে ফেনমেনা নিরন্তর বাস্তবিক ও মহত্বের। আদৃতও। যা কবিতায় ব্যক্ত হয়েছে—তাতেই তার ভোর। স্থায়ীত্ব অনুসারী। সেটি কবি প্রকাশ করেন এক পরিবেশনায়। যা আলোয় ও বিপদ অতিক্রমী প্রবণতা সিদ্ধিজাত। এ পরিবেশনাটি প্রসৃতিজাত। অবশ্যই তা মুখপাত্রও। এভাবেই কবি তার ঝড়জলরোদের প্রতিপাদ্য কায়েম করেন। গড়ে দেন—ঘাসফড়িং, অসংখ্য সহোদর কিংবা লতাগুল্মময় বনচ্ছায়া সবকিছুই কবির অপরিসীম আয়োজন, জীবনভর ভরন্ত মায়ার দোলনী। তাইতো কবি গান :
এই সিঁড়ি নেমে গেছে বঙ্গোপসাগরে
সিঁড়ি ভেঙে রক্ত নেমে গেছে
স্বপ্নে স্বদেশ ব্যেপে
এভাবেই স্বদেশের-প্রেয়সীর প্রেমপ্রবণতার, আলেখ্যসমূহ গড়ে ওঠে। ইতিহাস অনুসৃত রকমের তো বটেই। কবিতার এ আয়োজনটুকুতেই রফিক আজাদ নতুন ও চিরায়ুষ্মতি। সে লক্ষ্যেই তার উদগ্র চলা।
কবি নির্বাসন পান নি তাই। প্লেটোকুলরা পরে অসত্যকেই সত্য করে, সত্যকে অসত্য করে। আসলে সত্য-মিথ্যার ওপারে ছিলেন বলেই নির্বাসনের প্রশ্নটি এসেছিল; তিনিও তা বলে গেছেন—অন্তিম সময়ে। কার্যত, নির্বাসন দেওয়ার ফলেই সাহিত্যতত্ত্বে কবিদের আসন আরও পাকাপোক্ত হয়েছিল। সে নিয়ে তার যুগেই বৈপরীত্যটি ও স্থায়িত্ব হয়। তাই নির্বাসিতদের কথা বলে আমরা রফিক আজাদে পূর্ণ সমাসীন করেছি। তাইতো তাতে প্লেটো অধিক পুনর্বাসিতও হন এবং অন্যরা ততোধিক স্নিগ্ধ মায়ায় নিজের প্রতিষ্ঠায় প্রসিদ্ধির যৌক্তিকতায় পৌঁছান। তাই বোধ করি একজন বড় কবির পূর্ণ সত্য জীবন্ত। প্রসঙ্গত, রফিক আজাদের অন্য অনেক দিক আছে—সেগুলো আপাতত থাক, শুধু তাঁকে চিরায়ত কবিই বলি, হাঃ হাঃ হাঃ। জয়তু রফিক আজাদ।