আমাদের কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা

সেই ১৯৯৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার সময় ভর্তি সহায়ক পুস্তিকায় এবং কোচিং সেন্টারের প্রশ্নপত্রে নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন ছিলো—জাতিসত্তার কবি কাকে বলা হয়? তখন থেকে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার নামের সাথে চেনাজানা আমার। পরে ২০১৪ সালের পর কোনো এক সময় কক্সবাজারে তাঁর সাথে পরিচয়। ধ্যানী ও জ্ঞানী মানুষ তিনি। কবিতার জন্য উজাড় করে দিয়েছেন সারাটা জীবন। বিপুল বৈষয়িক স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে কবিতার সাথে থেকেছেন। পেতেছেন অভাবের সংসার শুধু কবিতার সাথে। যাঁরা কাছ থেকে তাঁকে দেখেছেন তাঁরা জানেন নির্লোভ, নিরহংকার, সদালাপী, কবিতার স্বপ্নে বিভোর এই অসামান্য মানুষ কত সহজ ও সরল জীবন যাপন করেন।

পঞ্চবিংশতি তরুণের চেয়েও দৃপ্ত তারুণ্য ধারণ করেন তিনি। অসম্ভব পরিশ্রমী এবং উদ্যমী সৃজনশীল এই মানুষটি সম্প্রতি দেশের গর্বের এক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন। এর আগে দীর্ঘদিন তিনি বাংলা একাডেমিতে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন। সর্বশেষ পরিচালক পদ থেকে অবসরে যান ২০০৭ সালে। শিল্প-সাহিত্য চর্চাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেবার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে যে গুটিকয়েক ব্যক্তির নাম উল্লেখ করা যায় মুহম্মদ নূরুল হুদা তাঁদের অন্যতম। বাংলা একাডেমিতে পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তাঁর উদ্যোগে তরুণ লেখক প্রকল্প এখনো শিল্প-সাহিত্য অঙ্গনে আলোচিত হয়।

সংগঠক হিসেবে তিনি অদ্বিতীয়। বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবকে একক নেতৃত্বের মাধ্যমে দীর্ঘকাল তিনি ক্রিয়াশীল রেখেছেন। এছাড়াও সারা দেশে অসংখ্য আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ের শিল্প-সাহিত্যের সংগঠন, সভা-সমিতি তাঁর আশীর্বাদ ও পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে আসছে। তিনি দেশে-বিদেশে কবিতা, মেধাসত্ব আইন ও শিল্প-সাহিত্যবিষয়ক অসংখ্য কর্মশালা আয়োজন করেছেন যেগুলোর মাধ্যমে অসংখ্য নবীন লিখিয়ে নিজেদেরকে সমৃদ্ধ করবার সুযোগ লাভ করেছেন।

এই শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে তিনি প্রতি বছর আয়োজন করে আসছেন আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন এবং কবিতার শান্তি যাত্রা। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ এই অস্থির পৃথিবীতে শান্তির পরশ বুলিয়ে দিতে কবি কবিতার ওপর পরম নির্ভরতা প্রচার করে আসছেন শান্তিবাদী এক ঋষি হয়ে। তাঁর এই প্রয়াস আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও অর্জন করেছে। ভারতে 'ওয়ার্ল্ড থিঙ্কারস অ্যান্ড রাইটার্স পিস মিট-২০১৫' এর সমাপনী অধিবেশনে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদাকে 'বিশ্ব শান্তি সম্মাননা' প্রদান করা হয়। 'ধর্ম ও সংস্কৃতির বন্ধনে শান্তি' ছিলো কলকাতার রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত সেই সম্মেলনের প্রতিপাদ্য বিষয়। এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের কয়েকটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় ভারতের 'ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর ইন্টার-কালচারাল স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চ' ছিলো সেটির আয়োজক প্রতিষ্ঠান। কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার রয়েছে ব্যতিক্রমী বিশ্ববীক্ষা। পৃথিবীতে তিনি দেখতে পান শুধুই 'সুন্দর'। যা কিছু অসুন্দর বা কম সুন্দর তা তিনি পালটে দিতে চান। এই অভীপ্সা থেকেই আমরা দেখি ব্যক্তি, বস্তু, প্রতিষ্ঠান, স্থান প্রভৃতির নতুন নতুন নামকরণ করছেন তিনি। পাবনার দূর চরাঞ্চলে কবি মজিদ মাহমুদের আমন্ত্রণে সেখানে গিয়ে 'চর গড়গড়ি'কে তিনি মুহূর্তেই নাম দিয়ে ফেলেন 'চর নিকেতন'। কবির দেওয়া নামেই এখন সেই চর পরিচিত। জন্মজেলা কক্সবাজারকে তিনি ডাকেন 'দরিয়ানগর'। নিজেকে 'দরিয়ানগরের' ভূমিসন্তান হিসেবে পরিচয় দিতে বড় ভালোবাসেন। চাকরিসূত্রে কক্সবাজারে অবস্থানকালে কবিকে কাছ থেকে দেখেছি। কবির হৃদয়ে দরিয়ানগর আর দরিয়ানগরের জনমানুষের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা আর আবেগ লক্ষ করেছি। যেকোনো অজুহাতে ছুটে যেতেন কক্সবাজারে। পিতৃভিটা এখন প্রায় বিরান। তবুও সেখানে সবুজের চাষাবাদ করেন কবি গভীর মমতায়।

দীর্ঘ কয়েক দশক যাবত কবি মুহম্মদ নূরুল হুদাকে 'জাতিসত্তার কবি' হিসেবে অভিহিত করা হয়ে আসছে। কেউ আপত্তি করেছে বলে জানা নাই আমার। এই অভিধার আর কোনো দাবিদারকেও এই দাবি নিয়ে সামনে আসতে দেখিনি। বিভিন্ন কবি-সাহিত্যিকের বিভিন্ন উপাধি বা অভিধার কথা আমরা জানি। 'নাগরিক কবি', 'বিশ্বকবি', 'পল্লিকবি', 'বিদ্রোহী কবি', 'সব্যসাচী লেখক', 'প্রথাবিরোধী লেখক', 'কবিশ্রেষ্ঠ'। সবাই মেনেও নিয়েছে এগুলো। তাই বলে কি শুধু নজরুলই বিদ্রোহী কবিতা লিখেছেন? কার কেউ লেখেননি? পল্লি নিয়ে শুধু জসিমউদদীনই কবিতা লিখেছেন। আর কেউ লিখেননি? নাগরিক জীবন নিয়ে সমর সেনই শুধু লিখেছেন? আর কেউ লিখেননি? সেসকল অভিধার ক্ষেত্রে কেউ কখনো কোনো আপত্তি তুলেছেন কি? অভিধা বা উপাধি নামের মতোই। এর যৌক্তিকতাও নামের মতোই। সৈয়দ শামসুল হকই কি বাংলা সাহিত্যের একমাত্র সব্যসাচী লেখক? রবীন্দ্রনাথও নন? কই সব্যসাচী উপাধি নিয়ে তো কারো সেরকম তুমুল আপত্তি দেখলাম না? এই যে আমরা আমাদের রবীন্দ্রনাথকে 'বিশ্বকবি' বলি, শেক্সপিয়ার কি বিশ্বজুড়ে পঠিত হন না? হোমার? গ্যেটে?

কবি মুহম্মদ নূরুল হুদাকে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক পদে দেখতে পেয়ে অনেকেরই অসূয়া জাগতে পারে। এসব মুহম্মদ নূরুল হুদাকে বিচলিত করতে পারে না। তাঁর নিকটজনেরা জানেন ভালো করে। কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা জন্মেছেন ১৯৪৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার জেলার পোকখালী গ্রামে। তাঁর পিতার নাম হাজি মোহাম্মদ সেকান্দর। মাতার নাম—আঞ্জুমান আর বেগম। অসম্ভব মেধাবী কবি ১৯৬৫ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় অখ্যাত ঈদগাহ হাই স্কুল থেকে সমগ্র কুমিল্লা বোর্ডের মধ্যে সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিলেন। ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধশেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ছাত্রাবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে 'অধোরেখ' নামে একটি সংকলন সম্পাদনা করেন। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত হয় তার কবিতাগ্রন্থ 'শোণিতে সমুদ্রপাত'। একই সময় তিনি সম্পাদনা করেন 'হে স্বদেশ' এবং 'বহুবচন'। এরপর ১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমিতে যোগ দেন সহকারী পরিচালক হিসেবে। সেখানেই কাটে তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবন। আজ তিনি এই প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক। কর্মজীবনের মতো সাহিত্য জীবনেও তিনি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সুনাম ও সুখ্যাতি অর্জন করেছেন। দেশে যেমন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, একুশে পদক লাভ করেছেন, তেমনি বহির্বিশ্ব থেকেও অর্জন করেছেন অসংখ্য সম্মাননা এবং স্বীকৃতি। এই স্বীকৃতি এবং তাঁর বিশ্বময় পরিচিতি পাওয়া যায়।

তাঁর আয়োজনে কবিতার শান্তি যাত্রায় ভারত, চীন, নেপাল, থাইল্যান্ড, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র ইত্যাদি দেশ থেকে কবি ও শিল্পীদের অংশগ্রহণ দেখে। কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা প্রতি বছর ৩১ ডিসেম্বর 'আন্তর্জাতিক লেখক দিবস' উদযাপনের প্রচলন করেন এদেশে তাঁর 'বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের মাধ্যমে। সংগঠক হিসেবে কবি যে অসামান্য এক ব্যক্তিত্ব তাঁর পরিচয় পেয়েছি আমার প্রথম কবিতাগ্রন্থ 'রোদ বুনি ছায়াপথে' যখন প্রেসে যাচ্ছিলো ২০১৮ সালে। প্রেসের এক মুদ্রাক্ষরিক বলছিলেন 'মুহম্মদ নূরুল হুদা' না থাকলে কমপক্ষে পাঁচশত কবি লেখক এদেশে লেখালিখির জগতে আসতেন না। কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা সব সময় অনুজদের প্রেরণার এক বিরাট উৎস। আমাদের সকল দুঃসময়ের আশা-ভরসার স্থল। আমার সৌভাগ্য যে তাঁর মতো একজন বটবৃক্ষের ছায়া লাভ করেছি।

কবি মুহম্মদ নূরুল হুদাকে আমরা জাতিসত্তার কবি নামে ডাকি। এতকিছু থাকতে 'জাতিসত্তার কবি' কেন? এর প্রেক্ষিত নিয়ে অন্য এক দিন আলোচনা করব। আজ শুধু এতটুকু বলে রাখি কবি মুহম্মদ নূরুল হুদাই এই কথা উচ্চারণ করেছেন—'যতদূর বাংলা ভাষা, ততদূর এই বাংলাদেশ'।

কেবল তিনিই বলেছেন—

'রোদ্দুরে নেয়েছি আর বৃষ্টিতে বেড়েছি
সহস্র শতাব্দী দিয়ে নিজেকে গড়েছি
আমরা তামাটে জাতি, আমরা এসেছি।'

আজ জাতিসত্তার কবির জন্মদিন। জন্মদিনে কবিকে জানাই শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। কবি যেন আরো দীর্ঘকাল তাঁর সৃজনশীল লেখনী চালু রাখেন, যেন বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য সর্বোপরি বাঙালি জাতিসত্তা উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে তাঁর অসাধারণ কথা ও কবিতায়। শুভ জন্মদিন প্রিয় কবি!