জর্জ অরওয়েলের শৈশব

জর্জ অরওয়েল বা এরিক আর্থার ব্লেয়ার ১৯০৩ সালের ২৫ জুন ভারতের মোতিহারীতে জন্মগ্রহণ করেন; তার পিতা রিচার্ড ওয়ালমেসলে ব্লেয়ার ছিলেন ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের আফিম বিভাগের সাব-ডেপুটি এজেন্ট।

অরওয়েলের মা ইডা মেবেল লিমোজিন বার্মার মৌলমেইনে বেড়ে ওঠেন। ইডার পিতা সেখানে কর্মরত ফরাসি বংশোদ্ভূত ছিলেন।

অরওয়েলের দুই বোন। জ্যেষ্ঠ বোন মার্জোরি তার পাঁচ বছরের বড় এবং পাঁচ বছরের ছোটো বোনের নাম এভ্রিল।

অরওয়েলের বয়স যখন এক বছর তখন তার মা তাকে এবং মার্জোরিকে নিয়ে ইংল্যান্ডে ফিরে যান। তারা অক্সফোর্ডশায়ারের হেনলি-অন-টেমসে বসবাস শুরু করেন।

ইডা ব্লেয়ারের একটি ডায়েরি থেকে অরওয়েলের শৈশব সম্পর্কে জানা যায়। এছাড়া তার মায়ের কোনো চিঠিপত্র বা কাগুজে প্রমাণ নেই। ডায়েরির অংশগুলো পাঁচ বা ছয় শব্দের টীকাসদৃশ, সর্বাধিক দশ বা বারো শব্দের। শিশু অরওয়েল প্রতিদিন যা যা করত তার উপর ভিত্তি করে লেখা। ডায়েরি থেকে ইডার স্বভাব এবং এরিক তথা অরওয়েলের স্বাস্থ্য বিষয়ে কিছু তথ্য পাওয়া যায়:

সোমবার, ৬ ফেব্রুয়ারি : বাচ্চাটি মোটেও ভালো নেই, তাই আমি ডাক্তারকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম, তিনি বললেন তার ব্রংকাইটিস হয়েছে...

বৃহস্পতিবার, ৯ ফেব্রুয়ারি : বাচ্চাটি এখন প্রতিদিন একটু একটু করে উন্নতি করছে।

শনিবার, ১১ ফেব্রুয়ারি : বাচ্চা অনেক ভালো। জিনিসপত্রকে ‘বিস্টলি’ বলে ডাকছে।

বোঝা যায় বড়দের কেউ হয়ত জিনিসপত্রকে ‘বিস্টলি’ বলে ডেকে থাকতে পারে। আর এই কারণেই সম্ভবত ২ বছর বয়সী একটি শিশু শব্দটি শুনে এর পুনরাবৃত্তি করতে পারে।

রবিবার, ২৬ ফেব্রুয়ারি : ভয়ংকর দিন, মোটেও বাইরে বের হয়নি।

এবং শুধুমাত্র ৬ মার্চ : এক মাসেরও বেশি সময়ের পর বাচ্চা আজকে প্রথমবারের মতো বাইরে গিয়েছিল।

জুন মাসে এরিক তার ‘কৃতিত্ব’ দেখানোর জন্য ড্রয়িং-রুমের জানালা দিয়ে বাগানে নেমে গিয়েছিল। সেই সময়ে টুনব্রিজ ওয়েলসে তার মা এক রাউন্ড তাসের ব্রিজ এবং টেনিস খেলার জন্য বন্ধুদের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন, এরপর উইনচেস্টারের কারাগারে মিসেস ক্রুকশ্যাঙ্কের সাথে চা পান করতেও গিয়েছিলেন। আগস্ট মাসে ফ্রিন্টন-অন-সি শহরে শিশু অরওয়েল প্রথমবারের মতো জলক্রীড়া করেন এবং সেটি উপভোগ করেন। অবশেষে অসুস্থ হয়ে পড়লে তড়িঘড়ি বাড়ি ফিরে তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান ইডা। আবার নভেম্বরে এরিককে একদফা ডাক্তারের কাছে যেতে হয়। তাই ছোটোবেলা থেকে ফুসফুসের দুর্বল অবস্থার কারণে অরওয়েলকে নিয়ে ইডা বেশ উদ্বিগ্ন থাকতেন।

সেই সময়ে অরওয়েলের পিতা তার বেতনের অধিকাংশই পরিবারের ভরণপোষণের জন্য ইংল্যান্ডে পাঠাতেন। ফলে পরিবারটির ঐশ্বর্য না থাকলেও সচ্ছল ছিল। এক্ষেত্রে সুশীল দারিদ্র্যের উপর ‘দ্য রোড টু উইগান পিয়ার’ গ্রন্থে অরওয়েলের নিজস্ব করুণ সুর মনে করা যেতে পারে। এটি তার শৈশবের অনুভূতি সম্পর্কে প্রাথমিক প্রমাণ হিসেবে অগ্রহণযোগ্য হলেও একজন লেখক কীভাবে সাহিত্যিক এবং বিতর্কিত প্রভাবে তার স্মৃতিকে দক্ষতার সাথে রূপায়ণ করতে পারেন তার প্রমাণ হিসাবে গ্রহণ করা যেতে পারে।

১৯৪৬ সালে লেখা ‘কেন আমি লিখি’ প্রবন্ধে তিনি স্মরণ করেছেন বা স্বীকার করেছেন তার প্রথম স্মৃতি:

“আমার চার বা পাঁচ বছর বয়সে আমি প্রথম কবিতা লিখেছিলাম, আমার মা শুনে শুনে সেটি লিখে দিয়েছিলেন। এখন কবিতাটি সম্পর্কে আমার কিছুই মনে নেই, শুধু মনে আছে সেটি একটি বাঘ বিষয়ে ছিল। সেই কবিতায় উল্লেখযোগ্য একটি বাক্যাংশ ছিল- ‘বাঘের ছিল চেয়ারের মতো দাঁত’। তবে আমি মনে করি কবিতাটি উইলিয়াম ব্লেকের ‘টাইগার টাইগার’-এর অনুকরণ করে লেখা হয়েছিল।”

তবে এই প্রবন্ধটি তার গড়ে ওঠার পেছনের প্রভাবসমূহকে আরও সুনির্দিষ্টভাবে বয়ান করেছে:

“আমি ছিলাম তিন ভাই-বোনের মধ্যে মধ্যম সন্তান। বড় বোন এবং ছোটো বোনের সাথে যথাক্রমে আমার বয়সের দূরত্ব ছিল পাঁচ বছর। আর আমার আট বছর বয়সের আগে আমি বাবাকে খুব কমই কাছে পেয়েছি। এই কারণসহ অন্যান্য আরো কিছু কারণে আমি কিছুটা নিঃসঙ্গ বোধ করতাম। শীঘ্রই আমি অপ্রীতিকর আচরণ করতে শুরু করে দিলাম। এর ফলে আমার স্কুলের দিনগুলোতে আমি অনেকের কাছে অপ্রিয় হয়ে উঠলাম। নিঃসঙ্গ শিশুদের মতো আমার বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলা এবং কাল্পনিক ব্যক্তিদের সাথে কথোপকথনের মতো অস্বাভাবিক অভ্যাস রপ্ত হল। আমি মনে করি শুরু থেকেই নিজেকে অন্যদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন এবং অবমূল্যায়িত হওয়ার অনুভূতি মিলে আমার সাহিত্যিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাগুলি মিশ্রভাবে গড়ে উঠেছে।”

“আমি জানতাম আমার কাছে রয়েছে শব্দের ভাণ্ডার, আর রয়েছে অপ্রীতিকর ঘটনাসমূহের মুখোমুখি হওয়ার ক্ষমতাও। পাশাপাশি আমি অনুভব করেছি যে, এর ফলে আমার এক ধরনের নিজস্ব জগৎ তৈরি হয়েছে যেখানে আমি দৈনন্দিন জীবনে আমার ব্যর্থতায় নিজেকে ফিরে দেখতে পারি।”

১৯৩০-এর দশকের অসফল লেখকের ব্যর্থতার তীব্র অনুভূতি থেকে পাওয়া ব্যর্থতাবোধ, যেটি তিনি তার ছোটোবেলায় পেয়েছিলেন। সেটি ছিল পুরোপুরি এক ভিন্ন বিষয়।

অরওয়েলের ৫ বছর বয়সে তার বড় বোন মার্জোরি এবং ছোটো বোন এভ্রিলের মতো হেনলির একটি ছোটো অ্যাংলিকান কনভেন্ট স্কুলে ভর্তি হন। তিনি নিজে কোথাও কখনই এটি উল্লেখ করেননি। তবে তিনি অবশ্যই একটি ক্র্যাক প্রিপ স্কুলে বৃত্তির জন্য সুপারিশকৃত ছাত্র হয়ে উঠেছিলেন। অরওয়েলের ছোটো বোন এভ্রিলকে মার্জোরি ডাকিন নামের একজন পড়তে এবং লিখতে শেখাতেন, যার ভাই হামফ্রে ডাকিন পরে অরওয়েলের বড় বোন মার্জোরি ব্লেয়ারকে বিয়ে করেন। ডাকিন এবং ব্লেয়ার পরিবার একে অপরের কাছাকাছি ছিল।

শৈশবের কিছু অদ্ভুত স্মৃতি ঘটনাক্রমে জর্জ অরওয়েলের প্রবন্ধসমূহে আচমকা উপস্থিত হয়েছে : “প্রথম দিকের গানটি আমি মনে করতে পারি, সেটি অবশ্যই ১৯০৭ বা ১৯০৮ সালের ‘রোডা হ্যাড এ প্যাগোডা’, এটি একটি অর্থহীন গান হলেও তখন খুব জনপ্রিয় ছিল।”

“এই সময়ে আমি প্রায় লিঙ্গহীন অবস্থায় ছিলাম, যা সেই বয়সের ছেলেদের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক। তাই আমি একইসঙ্গে জানার এবং না-জানার অবস্থানে ছিলাম যাকে জীবনের সত্য বলা হত। পাঁচ বা ছয় বছর বয়সে অন্য অনেক শিশুর মতো আমিও যৌনতার একটি ধাপ অতিক্রম করেছি। রাস্তার উপরে থাকা প্লাম্বারের বাচ্চারা ছিল আমার বন্ধু। আমরা মাঝে মাঝে অস্পষ্ট কামুক ধরনের একটি খেলা খেলতাম। বলা হতো ‘ডাক্তার-রোগি খেলা’, এবং আমার মনে আছে একটি ছোটো মেয়ের পেটের ওপর স্টেথোস্কোপ দিয়ে পরীক্ষার ঢংয়ে একটি খেলনা ট্রাম্পেট ধরে রাখার স্মৃতি থেকে একটি ম্লান অথচ নিশ্চিত আনন্দদায়ক রোমাঞ্চ পেয়েছি। প্রায় একই সময়ে আমি যে কনভেন্ট স্কুলে পড়তাম সেখানকার এলসি নামের একটি মেয়ের গভীরভাবে প্রেমে পড়ি। সেই প্রেমের চেয়ে অধিক প্রার্থনাধর্মী প্রেম আমি আর কখনো কারো জন্য অনুভব করিনি। সে বড় হয়ে গেছে বলে আমার কাছে মনে হতো। তখন নিশ্চয়ই তার বয়স পনেরো হবে। এর পরে সমস্ত যৌন অনুভূতি বহু বছর ধরে আমার অস্তিত্বের বাইরে চলে গেছে বলে অনুভূত হয়।”

তবে স্থানীয় সংবাদপত্রে ‘সানিল্যান্ডস’-এর বিজ্ঞাপনের উপর নির্ভর করলে দেখা যাবে, অ্যাংলিকান নানরা শুধু ‘পাঁচ থেকে এগারো বছর বয়সী’ বাচ্চাদের ভর্তি নিয়েছিল। শিশুরা বয়স অনুমানে খুব একটা ভালো হয় না। সে হয়ত গ্রামের মেয়ের বয়সের চেয়ে বেশি ছিল এবং ছুটির দিনে বা সপ্তাহান্তের বিকেলে এরিককে হাঁটানোর জন্য কয়েক পেন্স পারিশ্রমিক পেয়েছিল। অন্যদিকে জর্জ অরওয়েল কুশলী হয়ে ওঠেন, তিনি ভাবতেন, বয়স, নাম বা ঘটনাস্থলের সামান্য পরিবর্তনের মাধ্যমে ছদ্মবেশের আড়ালের প্রকৃত মানুষকে ধারণ করাই পরিমিতির জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনীয়।

স্বল্প পরিচিত আত্মজীবনীমূলক আরেকটি অংশেও ৬ বছর বয়সে নিজেকে উল্লেখ করে আবারও তিনি দেখান যে স্পষ্ট স্মৃতিচারণে তিনি পারদর্শী। আর্তুরো বারিয়ার ‘দ্য ফোর্জ’-এর একটি পর্যালোচনাতে তিনি লিখেছেন:

“যখন আমি সেই শেষ বাক্যাংশটি পড়ি, ‘সিভিল গার্ডরা কখনই ভদ্রলোককে আক্রমণ করে না’, তখন আমার কাছে একটি স্মৃতি মনে পড়ে যা সম্ভবত পর্যালোচনার স্তরের নয়। তবে তা ইংল্যান্ডের মতো একটি দেশ এবং স্পেনের মতো একটি দেশের সামাজিক পরিবেশের পার্থক্যকে চিত্রিত করে। তখন আমার বয়স ৬ বছর বয়স। স্থানীয় একজন ধনী মদ প্রস্তুতকারক ছিলেন, তিনি ছিলেন একজন ম্যাজিস্ট্রেট পদমর্যাদার ব্যক্তি। তার সাথে আমার মা আর আমি আমাদের ছোট্ট শহরের একটি রাস্তায় হাঁটছিলাম। আলকাতরা মাখানো দেয়ালটি সাদা চক দিয়ে আঁকিবুকি করে ভরানো ছিল, এর কয়েকটি আমি নিজে এঁকেছিলাম। ম্যাজিস্ট্রেট মহোদয় থেমে যান, তার লাঠির মাধ্যমে অসন্তুষ্টির সাথে ইঙ্গিত করেন এবং বলেন, ‘আমরা এই দেয়ালে আঁকা ছেলেদের ধরতে যাচ্ছি এবং আমরা তাদের বার্চ বেত দিয়ে ছয়টি করে বেত্রাঘাত করার নির্দেশ দিতে যাচ্ছি।’ (পুরো বিষয়টিই আমার স্মরণে ছিল)। আমার হাঁটু ঠকঠক করে কাঁপছিল, আমার জিহ্বা তালুতে গিয়ে ঠেকল এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি এই ভয়ানক গুপ্ত তথ্যটি সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে সেখান থেকে কেটে পড়লাম। কিছুক্ষণের মধ্যে দেয়ালটির নিচে ত্রাসে আক্রান্ত হওয়া শিশুদের একটি দীর্ঘ সারি দৃশ্যমান হল। তারা সবাই তাদের রুমালে থুথু ফেলে আঁকিবুকিগুলো ঘষে তুলে ফেলতে শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু মজার বিষয় হল যে, অনেক বছর পরে সম্ভবত কুড়ি বছর পর আমার মন বলেছে যে, আমার সেই ভীতি ছিল একদম ভিত্তিহীন। কোনো ম্যাজিস্ট্রেটই আমাকে বার্চ বেত দিয়ে ছয় বেত্রাঘাতের শাস্তি দিতেন না, এমনকি দেয়ালে অঙ্কন করতে গিয়ে যদি হাতেনাতে ধরাও পড়তাম। এই ধরনের শাস্তি নিম্ন বর্গের লোকের জন্য সংরক্ষিত ছিল। সিভিল গার্ড শাস্তি দেয়, কিন্তু তারা কখনই ভদ্রলোককে আঘাত করে না।”

‘ত্রাসে আক্রান্ত হওয়া শিশুদের একটি দীর্ঘ সারি’ একটি গল্পকে অনেক দূরে টেনে নেওয়ার মতো শোনায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সিমন্স নামে একজন মদ প্রস্তুতকারী ছিলেন, তিনি ম্যাজিস্ট্রেটও ছিলেন। তিনি অরওয়েলের মায়ের বন্ধু। ইডা ব্লেয়ারের ডায়েরিতে লেখা আছে সিমন্সের মেয়েরা চা খেতে এসেছে এবং তাদের কথা এভ্রিলও মনে রেখেছে। এই ধরনের গল্প কখনোই মৌলিক উদ্ভাবনী হওয়ার সম্ভাবনা নেই।  

‘দ্য রোড টু উইগান পিয়ারে’ তিনি একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণির শিশুর মধ্যে শ্রেণিগত কুসংস্কারের একটি বিবরণ দিয়েছেন : ‘শ্রমিক শ্রেণির লোকেরা ছিল মূর্খ, অমার্জিত, অসংস্কৃত এবং হিংস্র। এর সংক্ষিপ্তসারে চারটি ভয়ংকর শব্দ যা আজকাল মানুষ সতর্কভাবে উচ্চারণ করছে কিন্তু ওগুলো আমার শৈশবে অবাধে বিনিময় চলতো। শব্দগুলোতে ছিল নিম্নবিত্ত শ্রেণির গন্ধ।’

‘এই শ্রেণির লোকেদের কোনো জমির মালিকানা ছিল না, কিন্তু তারা অনুভব করত যে তারা ঈশ্বরের দৃষ্টিতে জমির মালিক। তারা বাণিজ্য করার পরিবর্তে বিভিন্ন পেশা এবং যুদ্ধের পরিষেবাসমূহে গিয়ে একটি আধা-কুলীন দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখত... তাত্ত্বিকভাবে আপনি চাকরদের সম্পর্কে সমস্ত কিছু জানতেন এবং কীভাবে তাদের বখশিশ দেওয়া যায় তাও জানতেন। যদিও চলিত নিয়মে আপনার একজন বা সর্বাধিক দুইজন আবাসিক পরিচারক ছিল। তাত্ত্বিকভাবে, আপনি কীভাবে আপনার জামাকাপড় পরতে হবে এবং কীভাবে নৈশভোজের ফরমাশ দিতে হবে তা জানতেন, যদিও বাস্তবে আপনার কখনই একটি সম্ভ্রান্ত দর্জির কাছে বা একটি সম্ভ্রান্ত রেস্তোরাঁয় যাওয়ার সামর্থ্য নেই। তাত্ত্বিকভাবে, আপনি কীভাবে বন্দুক চালাতে হয় এবং ঘোড়ায় চড়তে হয় তা জানতেন, যদিও কার্যক্ষেত্রে আপনার চড়ার জন্য কোনও ঘোড়া ছিল না এবং গুলি করার জন্য এক ইঞ্চি মাটিও ছিল না।’

যাই হোক, যদিও সমাজতাত্ত্বিকভাবে তার পক্ষে এই কথাটি সত্য হতে পারে “আমি যে ধরনের জীর্ণ-ভদ্র পরিবারের কথা বলছি সেখানে দারিদ্র্যের চেতনা যে কোনও শ্রমজীবী পরিবারের চেয়ে অধিক কষ্টের স্তরের উপরে রয়েছে’, তবুও ‘জীর্ণ-ভদ্র’ তকমাটি ১৯১০ এবং ১৯২০ এর দশকে তার বাবার বার্ষিক ৪৩৮ পাউন্ড ১০ সেন্ট পেনশনভোগী তার নিজের পরিবারের সঠিক বর্ণনা ছিল না। এবং সুবিদিত ‘একটি জীর্ণ-ভদ্র পরিবার’ একটি রাস্তায় বসবাসকারী ‘গরীব শ্বেতাঙ্গদের’ পরিবারের মতো একই অবস্থানে যেখানে অন্য সবাই নিগ্রো।” যদি তিনি ব্লেয়ার পরিবারের সম্পর্কে এই উক্তি করে থাকেন তাহলে বিষয়টি হাস্যকর হবে।

তিনি প্রাণীদের খুব পছন্দ করতেন; কুকুর, বিড়াল, খরগোশ এবং গিনিপিগ প্রচুর পরিমাণে পুষতেন। পরবর্তী জীবনে তিনি যেখানেই বসতি স্থাপন করেছিলেন সেখানেই ছোটো ছোটো প্রাণী সংগ্রহশালা দেখতে পাওয়া যায়।

১৯০৫ সালের ডায়েরিটি তার ৭ বছর বয়সী বড় বোন মার্জোরির সামাজিক মেলামেশা, চায়ের নেমন্তন্নে অন্যদের আসা-যাওয়া এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগদানের বিবরণ থেকে বোঝা যায় ছোটোকাল থেকেই তিনি অনেক মানুষের মাঝে বড় হয়েছেন। এমনকি কিছু প্রমাণ ইঙ্গিত করে যে, স্কুলে যাওয়ার অনেক আগে লাজুক এবং একাকী স্বভাবের হওয়া সত্ত্বেও তিনি একাকী থাকার সুযোগ পাননি। ব্লেয়ার পরিবারের সবাই ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসত। যদি ইডা ব্লেয়ার স্বল্প সময়ের জন্যও কোথাও যেতেন তাহলে আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধব, বড় মেয়ে মার্জোরি বা স্থানীয় একটি মেয়ে শিশু অরওয়েলকে হাঁটাতে, পায়চারি করাতে জঙ্গলে বা নদীর তীরে বাস্তবিক অভিযানের খোঁজে নিয়ে যেত।

ফিরে আসার পর ইডা আরও উচ্চাভিলাষী ভ্রমণের আয়োজন করতেন। ঋতু অনুসারে সবকিছুই করতেন, যেমন ব্ল্যাকবেরি ও হ্যাজেলনাট সংগ্রহ করা, মদ তৈরি ও সংরক্ষণের জন্য বন্য ফল এবং ফুল বাছাই করা অথবা টেমস নদীতে নৌকা ভ্রমণ। আর কোনো এক যুগান্তকারী মুহূর্তে ডাকিন পরিবারের ছেলেরা (যাদের বাবা ছিলেন পারিবারিক ডাক্তার) অরওয়েলকে তাদের সাথে মাছ ধরতে নিয়ে যেতে শুরু করে। তারা তার চেয়ে বড় ছিল, কিন্তু তারা মার্জোরির জন্য এটি করেছিল : এরিক না গেলে মার্জোরিও যেত না। সারাজীবন তিনি বড় মাছ ধরার বালকসুলভ আনন্দ এবং দক্ষতা ধরে রেখেছেন এবং মাছের পাশাপাশি মাছ ধরার প্রতীকী উপস্থাপনা তার ‘কামিং আপ ফর এয়ার’ উপন্যাসে উঠে এসেছে।

‘কামিং আপ ফর এয়ার’-এর দ্বিতীয় খণ্ডের প্রথম পৃষ্ঠায় এডওয়ার্ডিয়ান শৈশবের সুখী জর্জ বোলিং চরিত্রটির স্মৃতি রোমন্থন জর্জ অরওয়েলের নিজের বলেই মনে হয়। ‘লোয়ার বিনফিল্ড’ স্থানটিকে স্বীকৃতভাবে হেনলি বলেই মনে হয় :

‘‘আমি যদি চোখ বুজে আমার আট বছর বয়সের আগের লোয়ার বিনফিল্ডের কথা ভাবি, আমার মনে আছে... গ্রীষ্মকালের অবহাওয়াতে বেশির ভাগ মিষ্টিই এক পেনিতে চার আউন্স পরিমাণ পাওয়া যেত। এমনকি প্যারাডাইস মিক্সচার নামে বিভিন্ন বোতল থেকে সংগৃহীত মিষ্টিজাতীয় একরকম পানীয় ছিল যার দাম ছিল ছয় পেনি।”

অরওয়েল ৮ বছর বয়স পর্যন্ত সম্পূর্ণভাবে নারীদের সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠেন। তিনি ৪ বছর বয়সের মধ্যে মাত্র তিন মাসের জন্য বাবাকে কাছে পেয়েছেন। তিনি তার মা এবং সহোদরা দুই বোনকে সারা জীবন গভীরভাবে ভালোবাসলেও তার মনোভাবের মধ্যে কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকতে পারে। চেহারা এবং আচার-ব্যবহারে তাকে সামরিক বা ঔপনিবেশিক ভদ্র-ব্যাচেলর বলে মনে হলেও সারাজীবন তিনি পুরুষদের তুলনায় নারীদের সাথে সহজভাবে মিশেছেন। ঔপন্যাসিক এবং ব্যক্তি- এই উভয় ভূমিকায় নারীদের প্রতি তার আচরণে কিছুটা উপলব্ধির অভাব রয়ে গেছে। বাড়িতে হয়ত অতিশয় বালকসুলভ ছেলেটির কিছু ক্ষোভের অনুভূতি হতে পারে এবং তারপর যখন এত অল্প বয়সে বোর্ডিং স্কুলের কঠোর পুরুষ মহলের কাছে তাকে তুলে দেয়া হয়েছিল, তখন দ্রোহের অনুভূতি হওয়া খুবই স্বাভাবিক।

ওদিকে অরওয়েলের এক ভগ্নী তার মাতামহী ইডা ব্লেয়ারের মধ্যে এমন কিছু দেখেছেন যা অন্তত একটি ছেলের কাছে কিছুটা উদ্বেগজনক মনে হতে পারে। একটা কোনো ভালো কিছু। তিনি ১৯২০-এর দশকের শেষের দিকে সাউথওল্ডে ইডা ব্লেয়ার সম্পর্কে কথা বলেন। তিনি স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ‘তিনি সেই একই নারী, অর্ধ মুক্ত, অর্ধ শৈল্পিক এবং ১৯১০-এর দশকে হেনলি অঞ্চলের সাথে মানানসই গৃহস্থালিসম্পন্ন।’

“আমরা ব্লেয়ার পরিবার এবং ডাকিন পরিবার সর্বদাই এরিকের এই চিত্রটি সম্পর্কে মনে করি যে তার প্রথম জীবন ‘জীর্ণ-ভদ্র’ অবস্থার মধ্যে কাটাচ্ছে। জীর্ণ সম্ভবত, ভদ্র কখনই না। সাউথওল্ডে আমার মাতামহী ইডা ব্লেয়ারের গৃহের সুচারুভাবে পরিচালিত জীবনযাত্রা সম্পর্কে আমার স্মৃতি অত্যন্ত মনোরম। বেশ ছোটো কিন্তু নিঃসন্দেহে বিদেশি। আসবাবপত্রের বেশিরভাগই মেহগনি কাঠের তৈরি, পুরোনো হলেও সবকিছু ছিল মানানসই। রংধনু রেশমের পর্দা, আমার মাতামহীর নিজ হাতে সূচিকর্ম করা টুল, ব্যাগ, কুশন, পিন কুশন, আকর্ষণীয় মেহগনি বা আইভরি বাক্স ভরা চুমকি, পুঁতি, ক্ষুদ্রাকার পুস্তিকা, কাঠের সুঁচ-দানি, পীতাভ বাদামি রঙের পুঁতি, রক্তাভ-ধবল সীসমণি এবং হাতির দাঁত, ভারত ও বার্মা থেকে আনা ছোটো বাক্স। শিশুদের জন্য এসব নিশ্চয়ই প্রবল আকর্ষণীয়।

মিসেস মে নামের ছোটোখাটো চেহারার সাফোকের একজন মহিলার সহায়তায় বাড়ির বেশিরভাগ কাজ আমার মাতামহীই করতেন... আমার মাতামহী এবং মাসি এভ্রিল– দুজনেই আর্ল গ্রে চা, টোস্ট অর প্যাটাম পেপেরিয়াম নিয়ে বিছানার দুই প্রান্তে বসে সকালের জলখাবার খেতেন। জলখাবারের পরপর মিসেস মে আসতেন। আমাদের ড্যাশহাউন্ড কুকুরগুলো সাধারণত বিছানায় বসত, ওরা আমাদেরকে আনন্দিত এবং বিচলিত করত। মাতামহী মিসেস ব্লেয়ার ছিলেন তার স্বামীর চেয়ে বয়সে অনেক ছোটো, আর ছিলেন খুবই বুদ্ধিমতী এবং সদা প্রত্যুৎপন্নমতি। তিনি সাউথওল্ডে থাকাকালীন যা-কিছুই ঘটুক না কেন, তার স্বামীকে কমবেশি ছাড় দিতেন। তাদের শয়নকক্ষ এবং আগ্রহ আলাদা রকমের ছিল কিন্তু বেশ বন্ধুত্বপূর্ণভাবে তারা পরস্পরের সাথে মিশতেন। খাবারের সময় মিস্টার ব্লেয়ারের পছন্দের কথা সবসময় বিবেচনা করা হতো এবং তার প্রিয় খাবার বিশেষ করে পুডিং বানিয়ে তাকে খেতে দেওয়া হতো। অন্যথায় তিনি সবকিছুর বাইরেই ছিলেন। তিনি একজন খুব মিষ্টি স্বভাবের মানুষ ছিলেন কিন্তু মিসেস ব্লেয়ারের ওপর কোনো কর্তৃত্ব দেখাতেন না। তিনি সাধারণত পুরুষদেরকে ‘সেই নৃশংস’ বলে উল্লেখ করতেন। ‘তুমি কি জানো সেই নৃশংসরা কী করেছে?’ পশ্চাতে বলতেন ঝাড়ুদার, কসাই ইত্যাদি। এর ফলে বাচ্চারা বোর্ডিং-স্কুলের মেয়াদকালে এবং সংরক্ষিত ছুটির মধ্যে বরং আত্মনির্ভরশীল ও আবেগগতভাবে নির্বিকার ছিল। অবশ্যই আমি শুধু মিসেস ব্লেয়ারকে একজন মাতামহী হিসেবেই দেখেছি। তিনি একজন তরুণী হিসেবে ভিন্নরকম হয়ে থাকতে পারেন।”

শিশু এরিক বা অরওয়েল কার কাছ থেকে তার প্রথম উচ্চারিত শব্দ ‘বিস্টলি’ শিখেছিল, সেই বিষয়ে কিছুটা সন্দেহ আছে। ‘সেই নৃশংস’ মূলত একটি সমসাময়িক কথ্য রীতি। তবুও মনে হয় যে তার শৈশবকালে তিনি একজন প্রথাগত মায়ের অতিরিক্ত সুরক্ষা ও সার্বক্ষণিক শুচিবাইয়ের মধ্যে দোটানার কারণে কিছুটা উত্তেজনা ভোগ করতেন। সম্ভবত শৈশব জুড়ে তার দোদুল্যমান মন, তার নির্লিপ্ততা ও সঙ্গলিপ্সুতার অদ্ভুত মিশ্রণের কারণে এরকম হতে পারে।