যে গান নজরুল লেখেননি

কাজী নজরুলের মতো ভাগ্যহত কবি খুব কমই আছেন। ব্যক্তিগত জীবনে যেমন, তেমনি তাঁর সাহিত্য জীবনেও দুর্ভাগ্য তাঁকে তাড়া করে ফিরেছে। ব্যক্তিগত জীবনে দুর্ভাগ্য হল, দুই ছেলে কৃষ্ণ মহম্মদ এবং অরিন্দম খালেদের (বুলবুল) মৃত্যু। স্ত্রীর দীর্ঘ অসুস্থতা, শাশুড়ির সংসার ত্যাগ, আর আবাল্য দারিদ্র। যদিও এক সময় তিনি দারিদ্রের গ্রাস থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। তিনি যখন সৃষ্টির তুঙ্গ মুহূর্তে, তখনই, আমাদের চরম দুর্ভাগ্য, তাঁকে গ্রাস করল দুরারোগ্য ব্যাধিতে। আর সাহিত্য জীবনে সর্বাপেক্ষা বড় দুর্ভাগ্য, তাঁর ভাল মানুষি, সরলতা ও দিলখোলা ভাবের সুযোগ নিয়ে তাঁকে ঠকানো। যৌবনেই তাঁকে প্রায় কিনে নিতে চেয়েছিলেন দৌলতপুরের বাসিন্দা, পুস্তক ব্যবসায়ী আলী আকবর খান, নিজের ভাগ্নি নার্গিসকে বিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে। আর শেষ জীবনে, এমন কি তাঁর মধ্য জীবনেও বিভিন্ন জন এই আবেগপ্রবণ মানুষটির বিভিন্ন রচনা আত্মসাৎ করে, কখনো বিকৃত করে, কখনো অন্যের রচনা তাঁর নামে চালিয়ে দিয়ে, তাঁকে অন্যের খ্যাতি-অখ্যাতির ভাগীদার করে ঠকানোর চেষ্টা করেছেন।

তবে কবির জীবনের সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য হল, তাঁর গানের বাণী ও সুর নিয়ে বিভিন্ন জনের যথেচ্ছাচারিতা। কবি সুস্থ থাকার সময় তিরিশের দশকের আগে থেকেই গানের বাণী ও সুর নিয়ে কোনো কোনো শিল্পী নিজের খেয়ালখুশিমতো ছেলেখেলা করেছেন। সে সব গান নজরুল বেতারে শুনতে পেয়ে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিবাদ করেছেন, কখনও জোরালো আক্ষেপ করেছেন। নজরুলের ঘনিষ্ঠ সহচরদের লেখায় এই আক্ষেপের কথা আমরা জানতে পারি। নজরুল যখন নির্বাক এবং বোধ বুদ্ধিহীন হয়ে যান, সে সময়ে তাঁর গানকে বিকৃত করার মাত্রা অনেক বেড়ে যায়। তাঁর যে সব গানের সুর হাতের কাছে পাওয়া যায়নি, সেখানে, কিছু সংখ্যক শিল্পী নিজেরাই সুর তৈরি করে, কখনো সুরের গোঁজামিল দিয়ে, নজরুলের গান বলে চালিয়ে দিয়েছেন। এই যথেচ্ছাচারিতা অবশ্য এখনো অব্যাহত রয়েছে।

কথায় বলে সর্ষের ভূত থাকলে সে ভূত তাড়ানো কঠিন। যারা নজরুল পূজারি নজরুল ভক্ত বলে নিজেদের দাবি করেন, তাদেরই অনেকে সেই সর্বনাশের হোতা। জানি না কবে এদেশে রবীন্দ্র সংগীতের মতো নজরুলের গানও শুদ্ধ কথায়, শুদ্ধ সুরে পরিবেশিত হবে।

কেউ কেউ অবশ্য চেষ্টা করছেন শুদ্ধতা বজায় রাখার। যাঁরা শুদ্ধতা বজায় রেখে নজরুলকে বিকৃতির হাত থেকে রক্ষা করছেন, অবিকৃতভাবে গান পরিবেশন করছেন, আমরা বলব তাঁরাই নজরুলকে প্রকৃত শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছেন। অন্যরা নজরুলকে পুঁজি করে নিজেদের খ্যাতি এবং আর্থিক লাভের পরিধি বাড়াচ্ছেন।

সুর-বিকৃতি ছাড়াও অন্য গীতিকারের বেশ কিছু গান নজরুল সংগীতের মধ্যে ঢুকে গেছে। বাংলাদেশের বিখ্যাত গবেষক আসাদুল হক একটি প্রবন্ধে (সাহিত্য সাময়িকী, প্রসঙ্গঃ নজরুল সঙ্গীত) লিখেছেন, ‘১৯৩০ সাল থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত রেকর্ডে প্রকাশিত নানা গীতিকারের বহু সংখ্যক গান নজরুলের নামে চলছে। অজ্ঞতার কারণেই এগুলি ঘটেছে এবং অজ্ঞতার কারণেই চল্লিশের দশকে প্রকাশিত অন্যের গান নজরুলের নামে চলছে।’ বিশেষ করে ১৯৬০ সালের পর নজরুল চর্চা পুনরায় শুরু হলে তখন অন্য গীতিকারের গানগুলি আরো বেশি করে নজরুল সংগীতের ভাণ্ডারে প্রবেশ করতে থাকে। এই অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছেন নজরুলের একান্ত ঘনিষ্ঠ সহচরগণ, জ্ঞাত এবং অজ্ঞাতসারে। এ প্রসঙ্গে নজরুলের গানের ভাণ্ডারি জগৎ ঘটক ১৯৭২ সালে জানালেন, ‘ইতোমধ্যেই কবির যে-সব গান স্বরলিপি সহকারে প্রকাশিত হচ্ছে তার মধ্যে কিছু কিছু অন্য গানের অনুপ্রবেশ ঘটেছে ও ঘটবার মুখে আছে। যেমন ‘আজি নিঝুম রাতে কে বাঁশি বজায়’, ‘ও বিদেশি বন্ধু’, ‘চোখ মুছিলে জল মোছে না’, ‘তোমার আকাশে এসেছিনু হায়’ ইত্যাদি। এভাবেই কাজী নজরুলের গান বলে অন্য লোকের গান মিশে যেতে বসেছে’ (কাফেলা, মে, ১৯৭২)।

যে-সব গান নজরুল-সৃষ্ট নয়, দেখা গেছে, শিল্পীরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, বেতারে এবং গ্রামোফোন রেকর্ডে অন্য গীতিকারের গানগুলি নজরুল সংগীত হিসেবে গেয়ে চলেছেন অকাতরে, নির্দ্বিধায়। আবার উলটো দিকে দেখা গেছে নজরুল রচিত কিছু গান সমসাময়িক অন্য গীতিকারের নামে প্রচলিত হয়েছে।

এর পেছনে অবশ্য কয়েকটি কারণ আছে। যেমন—

১. ১৯২০ সাল থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত নজরুল সৃজনশীল ছিলেন। সে সময় তিনি নিরলসভাবে রঙ্গমঞ্চ, বেতার, সিনেমা ও রেকর্ডের জন্য প্রচুর গান রচনা করেছেন। কিন্তু সব গানের হিসেব রাখা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাছাড়া নজরুল তাঁর কর্মময় জীবনে সব গান গ্রন্থাকারে প্রকাশ করে যেতে পারেননি, এবং তার গানের পাণ্ডুলিপিগুলিও তখন যথাযথ সংরক্ষিত হয়নি।

২. নজরুলের প্রথম গীতি-গ্রন্থ 'বুলবুল' ১৯২৮ সালের নভেম্বর মাসে প্রকাশিত হয়। ক্রমশ তাঁর গীতি-গ্রন্থগুলি প্রকাশিত হতে থাকে। তবে ১৯৩৪ সালের পর আর কোনো গীতি-গ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি। নজরুলের বাকি গান অগ্রন্থিতই থেকে যায়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, বাংলা ভাষায় নজরুলের চেয়ে অধিক সংখ্যক গান আর কোনো গীতিকার রচনা করেননি। তবে তাঁর সমস্ত গান গ্রন্থাকারে প্রকাশিত না হওয়ায় গানগুলি খাতার মধ্যেই থেকে যায়।

অনেকের ধারণা নজরুল তাঁর গান সম্বন্ধে উদাসীন ছিলেন বলেই এই ধরনের বিপর্যয় ঘটেছে। কিন্তু ধারণাটি সত্য নয়। তাঁর সঙ্গীত জীবনের সর্বাপেক্ষা ঘনিষ্ঠ সহচর জগৎ ঘটক জানিয়েছেন— ‘লিখেছেন তিনি অনেক তাঁর ছিল অনেক খাতা, সব বাঁধানো খাতা। এক একখানা লিখে শেষ করতেন আর তার থেকে পরিষ্কার করে লিখতেন এক-একখানা আর এক প্রস্থ বাঁধানো খাতায়। তাঁর সাথি ছিল একটা চামড়ার ব্যাগ যেখানে যেতেন সঙ্গে নিয়ে যেতেন। থাকতো তার মধ্যে draft খাতা। যখন যেখানে বসে লিখতেন বার করতেন সেই খাতা। বাড়ি এসে প্রয়োজন মতো পরিষ্কার করে লিখে রাখতেন Fair খাতায়।.........সীতানাথ রোড, হরি ঘোষ স্ট্রিট এবং পরে শ্যামবাজার স্ট্রিট পর্যন্ত খাতাগুলো এসেছিল জানি— কারণ সব খাতারই হিসাব ছিল আমার কাছে। মনে হয় শ্যামবাজার স্ট্রিটের বাড়ি থেকে সম্পূর্ণ অসুস্থ অবস্থায় পাইকপাড়ার বাড়িতে স্থানান্তরিত হওয়ার সময় সব গোলমাল হয়ে গেছে। এই সময়েই কবির লেখার ভাণ্ডার তচনচ হয়ে যায়'। (কাফেলা, নজরুল সংখ্যা ১৩৭৯, কবি নজরুলের গান, জগৎ ঘটক)। এই উদ্ধৃতি থেকে আশা করি আমাদের বুঝতে অসুবিধে হবে না, কবি তাঁর গান সম্বন্ধে মোটেই উদাসীন ছিলেন না। কতো সযত্নে তিনি গানগুলো খাতায় লিপিবদ্ধ করে রাখতেন তা বোঝা যায়। অসুস্থ অবস্থায় বাড়ি পাল্টানোর সময় তাঁর কিছু গানের খাতা হারিয়ে যায়। তাছাড়া তিরিশের দশকে নজরুল যখন গ্রামোফোন কোম্পানির chief trainer ছিলেন সে সময় রিহার্সাল রুম থেকে দু-খানি গানের খাতা হারিয়ে যায়। সে খাতাগুলো উদ্ধার হয়েছে কিনা জানা যায়নি।

প্রখ্যাত নজরুল সংগীতশিল্পী ফিরোজা বেগম এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আকাশ- বিশাল নজরুলের দু-একটি গানের খাতা চুরি হয়েছে সে তো জানেনই। কতো গান হেলায় ফেলায় এদিক-ওদিক ছড়িয়ে গেছে। আবার রেকর্ডে অনেক সময় কবির নাম উল্লিখিত হয়নি। নানা রকম ভুল বোঝাবুঝি এবং ঘাপলাও আছে।’ ১৯৪২ সালে কবি অসুস্থ হয়ে পড়ার পর নজরুল এবং তাঁর গান অবজ্ঞার অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে যেতে থাকে। ক্রমশ আধুনিক গানের দাপট বাড়তে থাকে। ধীরে ধীরে নজরুল সংগীত বিস্মৃত হয়ে যায়।

১৯৪২ সালের পর আকাশবাণী এবং রেকর্ড কোম্পানি নজরুলের গান প্রচার করার জন্য আর কোনো আগ্রহ দেখায়নি। ফলে নজরুল সংগীতের রেকর্ড প্রকাশ অনেক কমে যায়। ১৯৫১ সাল থেকে ১৯৬৩ সালের মধ্যে মাত্র ১৩টি রেকর্ড প্রকাশ হয়। পুরোনো রেকর্ডগুলিও পুনঃপ্রচারের অভাবে বিলুপ্তির অন্ধকারে চলে যেতে থাকে। আমরা জানি না, এর পেছনে কারও কোনো কারসাজি ছিল কিনা। তবে কবি-পত্নী প্রমীলা নজরুলের উদ্যোগে কিছু পাণ্ডুলিপি উদ্ধার হয়েছিল। সেগুলি থেকে সংকলিত হয়ে ১৯৫২ সালে কিছু গীতি-গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। পরে কয়েকটি গীতিগ্রন্থ, কাব্যগ্রন্থ এবং নাট্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়।

তিরিশের দশকে রেকর্ডের লেবেলে কোনো গীতিকারের নাম উল্লেখ থাকত না। ফলে রেকর্ড লেবেলে নজরুলের নাম উল্লেখ না থাকার জন্য কয়েকজন গীতিকার তাঁর গান চুরি করার সুযোগ পেয়েছিলেন। নজরুলের উপস্থিতিতেই এসব ব্যাপার ঘটেছিল। সে সময় নজরুলের সঙ্গে কয়েকজন গীতিকার রেকর্ড কোম্পানিতে কাজ করতেন। তাঁরা নজরুলের গান চুরি করেই থেমে থাকেননি, রীতিমতো গানগুলিকে নজরুলের চোখের সামনে রেকর্ডও করেছেন। এ বিষয়ে নজরুল গবেষক, নজরুল সুহৃদ ব্রহ্মমোহন ঠাকুরের সাক্ষ্য আমরা উল্লেখ করতে পারি। তিনি লিখেছেন, ‘দলবদ্ধভাবে এইসব গীতিকারগণ নজরুলের গান চুরি করেছেন নজরুলের কর্মাবস্থায়। আরো সরল করে বললে যেটা দাঁড়ায় সেটা হল, নজরুল ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠিত গীতিকারগণ (সংখ্যায় পঁচিশ-ছাব্বিশ) একই সঙ্গে যখন রেকর্ড কোম্পানিতে কাজ করছেন, সেই সময় এইসব গীতিকারগণ নজরুলের গান শুধু চুরিই করলেন না, গানগুলি নজরুলের চোখের সামনে (যেখানে নজরুল Exclusive composer ও একটা সময়ে chief trainer) রেকর্ডও করিয়ে ফেললেন এবং এই কাণ্ড ঘটে গেল বছরের পর বছর ধরে! এই উদ্ভট সিদ্ধান্তের সমর্থনে করুণাময় গোস্বামী পেশ করেছেন একটি অতি দুর্বল যুক্তি ‘বাণী বন্ধের নজরুলোপম বৈশিষ্ট্য’। এই বাণী বন্ধের বৈশিষ্ট্যে বিভ্রান্ত হয়ে নারায়ণ চৌধুরীর মতো গবেষকও ‘বাজে মৃদঙ্গ বাজে’ (তুলসী লাহিড়ী), ‘দামিনী দমকে’ (তুলসী লাহিড়ী), ‘আজি নিঝুম রাতে কে বাঁশি বাজায়’ (তুলসী লাহিড়ী), ‘প্রিয় যেন প্রেম ভুলো না’ (ধীরেন মুখোপাধ্যায়)’ ইত্যাদি গানগুলি নজরুলগীতি বলে ভুল করেছেন তাঁর গ্রন্থে (কাজী নজরুলের গান)। এই বাণী বন্ধের বৈশিষ্ট্যে প্রতারিত হয়ে ষাটের এবং সত্তরের দশকে যে সব গান নজরুল সংগীত হিসেবে বহুল প্রচারিত হয়েছিল সেগুলি হল, ‘কেমন করে বাজাও বল’ (হেমেন রায়), ‘চোখ মুছিলে জল মোছে না’ (ধীরেন মুখোপাধ্যায়), ‘পেয়ে অবলা ঘটালে জ্বালা’ (হেমেন রায়), ‘চৈতী রাতের উদাস হাওয়া’ (রামেন্দু দত্ত), ‘ফিরিয়া ডেকো গা বনের পাখি’ (প্রণব রায় ইত্যাদি)।

এছাড়া আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় সে সময় রেকর্ড লেবেলে গীতিকারের নাম উল্লেখ না থাকার জন্য অন্য লেখকের বেশ কিছু গান নজরুল সংগীত হিসেবে প্রচারিত হয়েছে। আবার দেখা গেছে অনেক রেকর্ডে একদিকে নজরুলের গান অপর দিকে অন্য গীতিকারের গান থাকত। কিন্তু রেকর্ড লেবেলে গীতিকারের নাম উল্লেখ থাকত না। ফলে দুদিকের গানকে নজরুলের গান হিসেবে ভুলবশত অনুমান করে নিয়েছেন কোনো কোনো নজরুল বিশেষজ্ঞ গবেষক। সেজন্যই এত বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে।

নজরুলের সান্নিধ্যধন্য অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ পুরোনো শিল্পীদের মধ্যে ও কেউ কেউ ভুলবশত অন্য গীতিকারের গান নজরুল সংগীত হিসেবে উল্লেখ করেছেন, গেয়েছেন। নজরুল সান্নিধ্যধন্য সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায় তাঁর প্রশিক্ষণে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে রেকর্ডে (এইচ এম ভি এন ৩১০৩/৮ জুন, ১৯৪৯) ‘ফিরিয়া ডেকোনো মহুয়া বনের পাখি’ গানটি নজরুলের গান হিসেবে গাওয়ান। তখন তাঁর মনে ছিল না যে গানটি প্রণব রায়ের লেখা। নিতাই ঘটকের মতো নজরুলের ঘনিষ্ঠ সহচরও স্মৃতি বিভ্রমবশত এ ধরনের ভুল করেছেন। তাঁর গানের খাতায় অন্যান্য গীতিকারের লেখা গান আছে। সে সব গানের ক্ষেত্রে তিনি খাতায় গীতিকারের নাম লিখে রাখেননি, পরবর্তীকালে সেগুলি নিয়েই তাঁর বিভ্রম ঘটেছে।

  • জানি জানি তার সে আঁখি (ধীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়)
  • কানন পারে মূরলী ধ্বনি (তুলসী লাহিড়ী)
  • অ্যগ্যর তুম রাধা হোতে শ্যাম (ফৈয়াজ হাশমী)
  • বধূর চোখে জল (নলিনী মজুমদার)

ইত্যাদি গানগুলি নজরুল সংগীত হিসাবে স্বরলিপি গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। সবচেয়ে বেশি বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছেন মনোরঞ্জন সেন। তাঁর স্বরলিপি গ্রন্থগুলিতে প্রায় কুড়িটি অন্যের লেখা গান নজরুল সংগীত হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। গানগুলি হল—

  • অন্তর দোলায় দোলাও (অনিল ভট্টাচার্য)।
  • আজ মধুবনে চাঁদের মেলা (প্রণব রায়)।
  • আমার রাঙা হৃদয় মাগো (প্রণব রায়)।
  • আমি গানে গানে মাধবীর নিদালি ভাঙাই (প্রণব রায়)।
  • এল নন্দের নন্দন নব ঘন শ্যাম (ধীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়) ইত্যাদি।

এছাড়া আরো কয়েকটি বহুল প্রচারিত গান উল্লেখ করছি। যেগুলি নজরুলের নয়, অন্য গীতিকারের লেখা।

  • আমি সাধ করে মোর গৌরী মেয়ের নাম রেখেছি কালী (প্রণব রায়)।
  • ইসলামের ঐ বাগিচাতে (মহঃ সুলতান)।
  • এস ফিরে পথিক বন্ধু (প্রণব রায়)।
  • এ ঘোর বরিষায় (সুরেন চক্রবর্তী)।
  • কালো ভ্রমর এলো গো আজ (ধীরেন মুখোপাধ্যায়)।
  • কত রাতি পোহায় বিফলে হায় (ধীরেন মুখোপাধ্যায়)।
  • কালো রূপে মন ভুলালো (অনিল ভট্টাচার্য)।
  • ঘঘং ঘঘং ঘ্যাঙ (সুনির্মল বসু)।
  • তোমায় যদি পেয়ে হারাই (প্রণব রায়)।
  • শ্মশান কালীর রূপ দেখে যা (প্রণব রায়)।

এরকম অন্য গীতিকারের রচিত প্রায় দুইশতের উপর গান নজরুল সংগীত হিসেবে বিভিন্ন স্বরলিপি গ্রন্থে এবং অখণ্ড নজরুলগীতির প্রথম ও দ্বিতীয় সংস্করণে স্থান পেয়েছে বা অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এছাড়া একই গান বিভিন্ন স্বরলিপি গ্রন্থে একাধিকবার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

নজরুল নির্বাক হয়ে যাবার পর যার যেমন খুশি গানকে নিয়ে যথেচ্ছাচার করেছেন। ফলে এতসব বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। যদি রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতীর মতো নিয়ামক সংস্থা বা বোর্ড থাকত, তাহলে, নজরুলের গান নিয়ে এমন যথেচ্ছাচার হত না।