অনুভূতিহীন কবিতা পছন্দ করি না : বঙ্গ রাখাল

সাহিত্য বিভাগের আয়োজনে নির্ধারিত প্রশ্নে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন কবি ও গবেষক বঙ্গ রাখাল। জন্ম ১২ জুন, ঝিনাইদহ। উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ: যৈবতী কন্যা ইশকুলে (২০২০), অন্ধ যাজক (২০২১) ও জন্মান্ধ ঘোড়া (২০২৪) এবং অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে: মনীষা বীক্ষণ ও অন্যান্য (২০১৮), পাগলা কানাই ও তাঁর তত্ত্ব দর্শন (২০১৯) ও কবিতার করতলে (২০২০)। পেয়েছেন আবুল মনসুর আহমদ পুরস্কার (২০২০), জলধি সম্মাননা (২০২১), অনুপ্রাণন সাহিত্য সম্মাননা (২০২২) ও কাব্যশ্রী সাহিত্য পুরস্কার (২০২৪)।

বাংলা ট্রিবিউন: কোন বিষয় বা অনুভূতি আপনাকে কবিতা লিখতে অনুপ্রাণিত করে?

বঙ্গ রাখাল: মানুষের তো নির্দিষ্ট কোনো অনুভূতি থাকে না। নানা সময়ে নানা অনুভূতির উদ্বেগ হতে পারে। তবে এটা নির্দিষ্ট করে বলাটা দুষ্কর। কেননা, আমরা আনন্দ পেলে আনন্দের কবিতা লিখি—তখন কিন্তু দুঃখের কবিতা লিখি না। আবার অনেক অনেক কষ্টে, কষ্টের কবিতার জন্ম হতে পারে—তখন কিন্তু আনন্দের কবিতা লিখি না। তবে নির্দিষ্ট করে এই অনুভূতির কথা বলাটা কঠিন। তারপরও যদি বলেন, তাইলে বলব, বিশেষ করে আমার জন্য দুঃখের অনুভূতি কবিতা লেখার ক্ষেত্রে বেশি তাড়িত করে—ব্যথিত করে—পীড়িত করে।

বাংলা ট্রিবিউন: আপনি কী ধরনের থিম বা বিষয় নিয়ে কবিতা লিখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?

বঙ্গ রাখাল: আমি প্রকৃতি-মানুষ এবং মানবতা কেন্দ্রিক কবিতা লিখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। তবে আমাকে এটাও বলতে হবে যে, কোনো নির্দিষ্টতা মেনে তো সাহিত্য হয় না। তাই একক কোনো থিম বা বিষয় মেনেও আমি কবিতা লিখি না। তবে কবিতার মূল থিম বা বিষয় তো মানুষই হওয়া উচিত। আর ঐতিহ্যই আমার উত্তরাধিকার—সেখানেও তো মানুষ প্রধান। এক্ষেত্রে সুব্রত সরকারের একটা কবিতা মনে পড়ছে—

দূরে চলে যেও না, কাছে থেকো
যত কাছে থাকলে সবাই দেখবে
মানুষের কাছে রয়েছে মানুষ।
কাছে ডাক, যেমন করে ডাকলে
মানুষ বুঝবে মানুষকে কাছে ডাকছে মানুষ।

দূরে যেতে দিও না, কাছে ডাক
যেমন করে ডাকলে সবাই বোঝে
মানুষ ডাকছে মানুষকেই
কাছে থাক, যত কাছে থাকলে বোঝা যায়
মানুষ ভালোবাসে মানুষকেই।

মানুষের এই মানুষকে ভুলে যাওয়া
দূরে চলে যাওয়া ভাল কথা নয়।
এমনই করে সৃজনে বিলয় আসে
এমনই করে সভ্যতার মৃত্যু হয়।
(সুব্রত সরকার/দূরে চলে যেওনা, দূরে যেতে দিও না)

বাংলা ট্রিবিউন: আপনি তাৎক্ষণিক অনুপ্রেরণায় লেখেন, নাকি ধীরে ধীরে শব্দ সাজান?

বঙ্গ রাখাল: আমি তাৎক্ষণিক অনুপ্রেরণায় কবিতা লিখি, তবে সেটাকে ফেলে রেখে আবার বার্নিশ করি। তবে শব্দের পরে শব্দ সাজিয়ে, অনুভূতিহীন কবিতাকে আমি পছন্দ করি না। কবিতা তো সেই জিনিস, যার সাথে নিজের আবেগ-অনুভূতির সত্যিকার প্রকাশ থাকতে হবে।
 
বাংলা ট্রিবিউন: আপনার কবিতার ভাষা ও শৈলী কীভাবে বেছে নেন?

বঙ্গ রাখাল:
দেখেন আমি কোনোকিছু পরিকল্পনা বা প্ল্যান করে কখনো করি না। কোনো তাড়না থেকেই কবিতা লিখতে বসে যাই। তবে, পূর্বসূরিদের কবিতা, তাদের অভিজ্ঞান, তাদের কবিতা যাপন আমাকে প্রাণিত করে, এর সাথে নিজের অভিজ্ঞতা, আবেগ-অনুভূতির সংমিশ্রণের ফলেই তো তৈরি হয় নিজস্ব ভাষা বা শৈলী। আর সেটাই করার চেষ্টা করে যাচ্ছি মাত্র। প্রসঙ্গক্রমে আরেকটা কথা বলি—আমার কাছে চম্পুকবিতা ভাল লাগে। চম্পু কবিতা হলো—গদ্য পদ্যের সংমিশ্রণ। গল্প বলতে বলতে বা গদ্যে বলতে বলতে ছড়া বা শ্লোক ছড়িয়ে দেওয়া কবিতায় চম্পু কবিতা। আমার কবিতার মধ্যে এই কবিতাও রয়েছে বেশকিছু। আমি কোনোকিছু উন্মোচন করতে চাই না কবিতায়, চর্যাপদের মতো সান্ধ্যভাষা আমার পছন্দ। কেননা কবিতায় থাকবে রহস্য—যা পাঠক বা সমালোচক তার মতো করে আবিষ্কার করবেন।

কবিতা সৃষ্টির জন্য ভাষা এক অন্য রকম ব্যাপার। মানুষের সাথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ভাষা, আর এই ভাষা শুধু মাত্র একটা নির্দিষ্টতার মধ্যে থাকলেও, তা আমাদের জন্য বিড়ম্বনারও কারণ হতে পারে। তাই আমি কবিতা সৃষ্টির জন্যও নির্দিষ্ট কোনো ভাষাকে বেছে নেইনি। কবিতা হতে হলে অনেককিছুর মিশ্রণ থাকতে হয়—এরমধ্যে একটা বিষয় দৃশ্য বা ইমেজ। এই দৃশ্যের কথা এই জন্য বলছি যে—এই ইমেজ বা দৃশ্যতার কথা অনেক সময় আমাদের মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে। তবে এই দৃশ্যতাও আমরা ভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে কবিতায় বলে থাকি। তবে মনে রাখতে হবে, কবি ভাষাকে শাসন করবেন, ভাষা যেন কবিকে নিয়ন্ত্রণ না করে ফেলেন। করলে সেটা তখন আর কবিতা হবে না। কবি তো এই ভাষার ভেতর দিয়ে কবিতায় অনেককিছু বলতে চান—যে কবি তার কবিতার ভাষাকে যত বেশি নিয়ন্ত্রণে নিতে পেরেছেন, সে ততবেশি মানুষের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়েছেন এবং তার গ্রহণযোগ্যতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। যে কারণে আমি মানুষের মুখের ভাষাকেই, কবিতা লেখার ভাষা হিসেবে বেছে নিয়েছি, এবং স্থান বিবেচনায় তা বলার চেষ্টা করেছি—এর বেশি না।

বাংলা ট্রিবিউন: কোন কোন কবির প্রভাব আপনার লেখায় আছে?

বঙ্গ রাখাল:
আমার লেখায় অনেক কবির প্রভাবই তো আছে। কারণ ভাষা তো আর একার পক্ষে তৈরি করা সম্ভব না। ভাষা সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বিকশিত হয়। আমার কবিতায় আমার পূর্ববর্তী সমস্ত কবিরই প্রভাব রয়েছে। তবে রবার্ট ফ্রস্টের কবিতা বা বোদলেয়ারের কবিতা আমাকে অনেক টানে, এবং তাদের কবিতার মতো আমার কিছু কবিতাও বলবার চেষ্টা করেছি মাত্র।

বাংলা ট্রিবিউন: কথাসাহিত্যের চর্চা করেন? এ চর্চা আপনার কবিতায় কতটুকু প্রভাব রাখে?

বঙ্গ রাখাল:
আমার কবিতায় কোনো প্রভাব রাখে বলে মনে করি না। কারণ আমি মূলত কবিতা লিখি—গবেষণা করার চেষ্টা করি। তবে কথাসাহিত্যের চেষ্টা মাঝে মাঝে। যা কবিতায় বা প্রবন্ধে বলতে পারি না, তা কথাসাহিত্যের মাধ্যমে বলার চেষ্টা করে থাকি। কথাসাহিত্য তো বিস্তৃত ক্যানভাস; কোনো কিছু বিস্তৃতভাবে বলবার প্রয়োজন পড়লে, ঠিক তখনই আমি কথাসাহিত্যে কলম রাখি। তবে এটা সচরাচর অব্যাহত থাকে না—মাঝে মাঝে চেষ্টা করা মাত্র।

বাংলা ট্রিবিউন: আপনার প্রথম কবিতার বই সম্পর্কে কিছু বলুন। প্রথম বই প্রকাশের অনুভূতি কেমন ছিল?

বঙ্গ রাখাল:
আমার প্রথম কবিতা বইয়ের নাম ‘হাওয়াই ডাঙ্গার ট্রেন’। প্রকাশিত হয় ২০১৬ সালে। আমার কবিতার বই সম্পর্কে বলতে হলে বলতে হবে, সে অনুভূতি আমার এক অন্য রকম অনুভূতি। যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। কবিতা তো অনুভূতির প্রকাশ মাত্র। আমি সেই অনুভূতি কবিতায় প্রকাশ করতে পারব না। তবে এটুকু মনে পড়ে, অনেক অনেক লজ্জা নিজের ভিতরে বোধ করতাম। কারণ এগুলো কবিতা হয়েছে কি না—মানুষ কি বলবে। আবার কবিতার বই বের হলে, বার বার পড়ে, নিজের কবিতাকে আমার কবিতা মনে হয়নি। কারণ আমি তখন নিজেকে নিজেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। যে এই কবিতা কি আমি লিখেছি? এই বোধ আমার আনন্দের চেয়ে পীড়িত করেছে বেশি। তবে এই গ্রন্থের অধিকাংশ কবিতাগুলোই অনেক যাতনা-মানবতার পীড়ন, কিংবা হতাশাক্লিষ্ট জীবনেরই সারাৎসার বলতে পারি।

বাংলা ট্রিবিউন: সমকালীন সামাজিক, রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক ঘটনা কি আপনার কবিতায় প্রভাব ফেলে? যদি ফেলে, তবে কীভাবে তা প্রকাশিত হয়?

বঙ্গ রাখাল:
প্রভাবিত হওয়াটা তো স্বাভাবিক। আমি তো মানুষ, সামাজিক জীব। সমাজ বা সামাজিকতার বাইরের কেউ না। যেহেতু সমকালীন সামাজিকতা, রাজনৈতিক বা সংস্কৃতির বাইরের কেউ না; সেহেতু এই প্রভাব আমার জীবনে পড়বে এবং কবিতা যেহেতু আমার যাপনের অংশ; সেহেতু তাকেও প্রভাবিত করবে। আমার কষ্ট আছে; হাসি পাই-আনন্দ পাই। প্রাণী হিসেবে এই সব অনুভূতি আছে, এবং তা কবিতায় প্রভাব বিস্তার করবে এটা স্বাভাবিক। আমার কবিতায় তা স্বাভাবিকভাবেই প্রকাশিত হয়, এটার জন্য আলাদা কোনো প্রস্তুতি দরকার পড়ে না।

বাংলা ট্রিবিউন: পাঠকদের মন্তব্য আপনার লেখায় কোনো পরিবর্তন আনে?

বঙ্গ রাখাল: পাঠকের সমালোচনাকে খুব ভালো ভাবে গ্রহণ করার মতো মন-মানসিকতা আমার আছে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমি আমাকে গুরুত্ব দেই—কেননা,  আমি যেমন পাঠকের কথা মাথায় রেখে কোনো লেখা লেখি না। আমি নিজের কথা বলতে চাই। পাঠক কীভাবে নেবে, সেটা পাঠকের ব্যাপার। কিন্তু অনেকে আছেন নিজের বইয়ের নাম কি রাখবে, সেটাও ফেসবুকে নিয়ে জানতে চান; কোনটা ভালো লাগছে। আমার কবিতার বইয়ের নাম কোনটা হতে পারে? আসলে ভাই, যে তুমি কবিতার বইয়ের নাম রাখতে পারো না—সেই তুমি আবার কী কবিতা লিখবে? কারণ নিজের মধ্যে আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে। আর যারা নিজেকে বাজারে বা জনপ্রিয় ধারার লেখক হতে চান, তারাই পাঠকের কথা মাথায় রেখে বই লেখেন। আমি তো বলতে চাই—বলতে আসছি, বলাটা আমার কাজ। কে কীভাবে নেবেন সেটা তার ব্যাপার মাত্র। আমি তাদের দ্বারা তাড়িত হয়ে লিখতে বসি না। আমি আমার দায়, কিংবা যন্ত্রণা-পীড়নের জায়গা থেকেই লিখতে এসেছি।

বাংলা ট্রিবিউন: ভবিষ্যতে কী ধরনের কবিতা লিখতে চান? নতুন কোনো ধারা বা শৈলীতে কাজ করার ইচ্ছা আছে কি?

বঙ্গ রাখাল: অনেকের মতো বড় বড় কথা বলতে চাই না। সময়-কালই বিবেচনা করবে আমি কী ধরনের কবিতা লিখতে চাই। তবে একটা ইচ্ছে তো সবার মধ্যেই, জাগ্রত থাকে বা থাকতে হয়। যেটা হবে একমাত্র বঙ্গ রাখালীয় স্বর। যে কেউ কবিতা পড়লেই বুঝতে পারবেন, এটা রাখালের কবিতা। এই বঙ্গ রাখালীয় স্বরের প্রত্যাশায় কাজ করে যাওয়া।