'বাংলা চলচ্চিত্র' আর 'বাংলাদেশী চলচ্চিত্র' এ দুটি বিষয় আলোচনার প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে, তাই বিষয়টি খোলাসা করার দরকার আছে— মূলত পাকিস্তান আমল থেকেই উর্দু ছবির পাশাপাশি বাংলা ছবি নির্মিত হত। আমাদের প্রথিতযশা নির্মাতা যেমন জহির রায়হান, এহতেশাম, মুস্তাফিজ সহ অনেকে বাংলার পাশাপাশি উর্দু ছবিও নির্মাণ করেছেন। তাদের সময়ের ধারাবাহিকতায় পরবর্তীকালে বাংলা ছবি নির্মাণ চালু থাকে এবং যা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের আগ পর্যন্তও ছিলো। মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আমরা বাংলাদেশ পেয়েছি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের অনেক আগেই 'বাংলাদেশ' রাষ্ট্রের ধারণা ছিলো, তাই ষাটের দশক জুড়েও বাংলাদেশি ছবি নির্মিত হয়েছে। একইভাবে, পশ্চিমবঙ্গীয় টলিউড ইন্ডাস্ট্রিতেও বাংলা ছবি নির্মিত হয়েছে সমান্তরালে। তাই তাদের ছবিও বাংলা চলচ্চিত্র নামে পরিচিতি পেয়েছে। আমাদের ছবি নির্মিত হয়েছে আমাদের মতো করে। সার্বিকভাবে 'বাংলা চলচ্চিত্র'র আইডেন্টিটিই বড় আকারে পরিচিত হয়ে উঠেছে ইতিহাসের পরম্পরায়।
বাংলা চলচ্চিত্রের সময়কে তুলে ধরতে, সে সময়টাকে এই লেখায় 'সুবর্ণ সময়' বলে সম্বোধন করাই ভালো। অতীতে ভালো ছবি নির্মাণের জোয়ার ছিল। সিনেমা হল ছিল হাজার হাজার। তখন এক সপ্তাহে বেশ কয়েকটি ছবি মুক্তি পেত। ফলে দর্শক ছবি নির্বাচনে বেশ চিন্তায় পড়ে যেত—কোনটা ছেড়ে কোনটা দেখবে। কিন্তু আজ আর ঐ সময়টা নেই। উপভোগ্য ছবি নির্মাণের জন্য মেধাসম্পন্ন নির্মাতাদের অভাব প্রকট আকারে দেখা দিয়েছে। তারপরেও দর্শক স্বপ্ন দেখছে আবারও হয়তো ভালো সময় আসবে। যুগের পরিবর্তনের সাথে চাহিদাসম্পন্ন গল্প ও নির্মাণের ছবি তৈরি হলে আবারও ঘুরে দাঁড়াতে পারে ইন্ডাস্ট্রি।
যা হোক, বাংলা চলচ্চিত্রের 'সুবর্ণ সময়'কে কোন সময়ের নিরীখে তুলে ধরা হবে সেটা দেখার বিষয়। আমার মতে বাংলা সিনেমার 'সুবর্ণ সময়' ষাটের দশক থেকে নব্বই দশক পর্যন্ত ছিলো। হ্যাঁ, শূন্য দশকেও ভালো ছবি হয়েছে কিন্তু মাঝখানে অর্থাৎ শূন্য দশকের প্রথমার্ধ্বে অশ্লীলতা আমাদের সিনেমায় মারাত্মক প্রভাব ফেলেছিল। শূন্য দশকের জন্য অশ্লীলতা বিষফোঁড়া হয়ে আছে। এজন্য আমাদের সিনেমার সুবর্ণ সময়ের সাথে আমি শূন্য দশককে যুক্ত না করার পক্ষে।
ষাট থেকে নব্বই দশক পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের ছবি হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের গল্প, গানে ভরপুর ছবিতে তার সাথে জীবনমুখী অন্যরকম ছবিও হয়েছে। সমগ্র ছবিকেই বাণিজ্যিক ও নিরীক্ষামূলক বা অফট্র্যাক ছবিতে শ্রেণিবিন্যাস করা যায়। এই লেখায় ষাট থেকে নব্বই দশক বাংলা চলচ্চিত্রের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা হবে। আলোচনার সুবিধার্থে চলচ্চিত্রকে 'পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি' বলার দেশীয় ট্রেন্ড থেকে সংক্ষেপে 'ছবি' বলা হবে।
ষাটের দশক
আমাদের চলচ্চিত্র যার হাত দিয়ে শুরু সেই আব্দুল জব্বার খান ১৯৫৬ সালে নির্মাণ করেন প্রথম বাংলা সবাক ছবি 'মুখ ও মুখোশ।' পাকিস্তান আমলে তাকে এ ছবি নির্মাণের সময় প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছিল। তাকে বলা হয়েছিল এ অঞ্চলের জলবায়ু চলচ্চিত্র নির্মাণের উপযুক্ত না। পরে তিনি নিজে চ্যালেন্জ গ্রহণ করে ছবিটি নির্মাণের কাজ শুরু করেন। নিজের লেখা নাটক 'ডাকাত' থেকে 'মুখ ও মুখোশ' ছবির জন্য স্ক্রিপ্ট লেখেন। তারপর শিল্পী নির্বাচনের কাজ করেন। ইনাম আহমেদ, পূর্ণিমা সেনগুপ্তা এবং জহরত আরাকে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করান। আব্দুল জব্বার খানের হাত ধরে বাংলা চলচ্চিত্রের সুবর্ণ সূচনা হয়। তারপর একে একে নির্মিত হতে থাকে ছবি। উর্দু ছবির রাজত্ব ছিল সে সময়, সেটা চরম সত্য। হওয়াটাও স্বাভাবিকই, কারণ পাকিস্তান সরকারের একটা দৌরাত্ম্য তো ছিলই। 'জাগো হুয়া সাভেরা' দিয়ে উর্দু ছবির যাত্রা শুরু এ দশকে। বাংলা ছবি চলেছে আলাদা একটা ধারা বা চেষ্টা হিসাবে। পরে বাংলা ছবিই প্রধানভাবে মূল জায়গা দখল করে নিয়েছিল। এ ধারার পাটাতন মজবুত করেছিলেন জহির রায়হান, এহতেশাম, মুস্তাফিজ, সুভাষ দত্ত, ফতেহ লোহানী, খান আতাউর রহমান, সালাহউদ্দিন, ইবনে মিজান, কাজী জহির, নারায়ণ ঘোষ মিতা, বশির হোসেন, মহিউদ্দিন প্রভৃতি নির্মাতা। জহির রায়হানের 'কখনো আসেনি’, ‘কাঁচের দেয়াল’, ‘বেহুলা’ ছবিগুলো ভিন্ন ভিন্ন কনটেন্টে সমালোচকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। সুভাষ দত্তের 'সুতরাং' বাণিজ্যিক ছবির অনেক বড় সম্ভাবনাকে তুলে ধরেছিল। নিজে নায়ক হয়ে কবরীকে নায়িকা করে দর্শকের মন জয় করেছিল সুভাষ। খান আতাউর রহমানের 'নবাব সিরাজউদ্দৌলা' ইতিহাসের তাৎপর্যে মাস্টারপিস ছিল। সাদাকালো সেলুলয়েডে এ ছবি দিয়ে প্রথিতযশা অভিনেতা আনোয়ার হোসেন 'বাংলার নবাব' খ্যাতি পেয়েছিলেন। ছবিটিতে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার জীবন ও কর্মকে তুলে ধরা হয়েছিল।
এই দশকে সবথেকে ব্যবসাসফল ছবির রেকর্ড গড়েছিল সালাহউদ্দিন পরিচালিত 'রূপবান।' সুজাতা নাম ভূমিকায় অভিনয় করে সাড়া ফেলেছিল। ফোক কনটেন্টের এ ছবি ষাটের দশকের অন্যতম প্রধান বৈচিত্র্য। ফোক-ফ্যান্টাসি ছবির আদর্শ নির্মাতা ছিলেন ইবনে মিজান। তার 'পাতালপুরীর রাজকন্যা' এ দশকেরই কাজ। মহিউদ্দিনের 'গাজী কালু চম্পাবতী', খান আতাউর রহমান-এর 'অরুণ বরুণ কিরণমালা' একই ঘরানার ছবি। ফ্যামিলি ড্রামার সেরা নির্মাতাদের একজন নারায়ণ ঘোষ মিতা এ সময়ের আবিষ্কার। তার 'এতটুকু আশা' জীবনমুখী ছবি, পাশাপাশি 'নীল আকাশের নিচে' ছবিটিও জনপ্রিয় ছবি। কামাল আহমেদ ষাট থেকে পরবর্তী বেশ কিছু কাল ধরে বিভিন্ন ধরনের বাণিজ্যিক ছবি নির্মাণ করেন। তার শুরুটাও এ সময়ে 'অবাঞ্ছিত' ছবি দিয়ে। শুধু ষাটের দশকেরই ন,য় ঢালিউডি ছবির ইতিহাসে এখনও পর্যন্ত সেরা কমেডি ছবি '১৩ নং ফেকু ওস্তাগার লেন।' আলতাফ, রবিউল অভিনীত দম ফাটানো হাসির ছবি এটি। কাজী জহির পরিচালিত 'ময়নামতি' রোমান্টিক ড্রামার মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয়। এহতেশাম যিনি ছিলেন উর্দু ও বাংলা ছবির নির্মাতা তার সাথে শিল্পী গড়ার কারিগর, তার ছবিরও ভিত গড়ে উঠেছিল সে সময়ে। তার 'রাজধানীর বুকে’, ‘চকোরী’, ‘নতুন সুর’ এবং ‘এদেশ তোমার আমার' ছিল উল্লেখযোগ্য ছবি।
ষাটের দশকের ছবিতে মিশ্র কাজ হয়েছে দেখাই যাচ্ছে। এর মাধ্যমে নানা স্বাদের ছবি দর্শক দেখতে পেয়েছে। 'রূপবান' ছবির গানের গুরুত্ব ছিল সংসারত্যাগী বাঙালি বধূর জন্য। গানগুলো জনপ্রিয় ছিল। 'এতটুকু আশা' ছবির 'তুমি কি দেখেছ কভু জীবনের পরাজয়' গানটি মানুষের প্রত্যহিক জীবনদর্শনকে তুলে ধরে। আব্দুল জব্বার-এর গাওয়া সেরা জনপ্রিয় গান। এ গানটি বিবিসি বাংলা জরিপে সর্বকালের সেরা বাংলা গানের মধ্যে একটি নির্বাচিত হয়েছিল। 'নীল আকাশের নিচে' ছবির 'নীল আকাশের নিচে আমি' গানটি অত্যন্ত জনপ্রিয়। 'অবাঞ্চিত' ছবিতে ফোক গানের বিখ্যাত শিল্পী আব্দুল আলিমের 'কেহই করে বেচাকেনা' গানটি ব্যবহৃত হয়। 'ময়নামতি' ছবির 'অনেক সাধের ময়না আমার বাঁধন কেটে যায়' অত্যন্ত জনপ্রিয় গান। সে সময় থেকেই তারকা তৈরির কারিগর ছিলেন এহতেশাম। রহমান ছিলেন ঢালিউডের প্রথম তারকা। তার 'হারানো দিন’, ‘রাজধানীর বুকে’, ‘এদেশ তোমার আমার' সুপারহিট সব ছবি। তার 'রাজধানীর বুকে' ছবির 'তোমারে লেগেছে এত যে ভালো' গানটি খুব অল্প সময়ে জনপ্রিয়তা লাভ করে। টলিউডের তখনকার সুপারস্টার উত্তম কুমার’র সাথে তার হুবহু মিল ছিল। রহমান’র আত্মকথা 'আমার কথা'-তে পাওয়া যায়, তাকে দেখে একজন নাকি বলেছিলেন—'ইয়া আল্লাহ ইয়ে তো বিলকুল উত্তম কুমার কি তরাহ লাগতা হ্যায়।' রহমান’র পরে তারকা হয়ে ওঠেন আনোয়ার হোসেন, রোজী আফসারী, রাজ্জাক, সুজাতা, কবরী।
ষাটের দশকেই ভারসাম্যপূর্ণ তারকা, ছবি, গান দিয়ে ঢাকাই ছবির সুবর্ণ সময়ের সূত্রপাত হয়েছিল। (চলবে)