X
শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪
২০ বৈশাখ ১৪৩১

ক্ষতচিহ্নিত হাড়মাংস অথবা নিছকই আত্মজনের কথা

গৌতম গুহ রায়
২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১৪:১৬আপডেট : ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১৪:১৬

১২তম পর্ব

ধান ভানতে শিবের গীত

‘আমাকে শনাক্ত করো হে যৌবন, যুদ্ধের সন্তান,
আমাকে শনাক্ত করো স্বদেশের দগ্ধ কৃষ্ণচূড়া।’  

সত্যজিৎ রায়ের ‘অশনি সংকেত’ হলে বসে দেখা আমার প্রথম সিনেমা, আমি তখন সদ্য ১১। হলদিবাড়ি, দেশভাগের পর অন্যদেশ হয়ে যাওয়া আমারই বাংলার সঙ্গে এই ভারতের সীমান্তের অন্তিম রেল স্টেশন। স্টেশন থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরেই কালো কাঁটাতারের সীমান্ত। কাঁটাতারে হাতে হাত ধরে এপ্রান্ত ওপ্রান্ত মানুষের থেকে উঁচু লোহার স্তম্ভ, সেই কালো কাঁটাতার। কয়েক মিটার পর পর মাথা বাঁকানো সেই পিলারগুলোকে আধো-অন্ধকারে অনেকটা শহিদ বেদির ভাস্কর্য মনে হয়। সেই আমার প্রথম সীমান্ত দেখা, এ পারে বাংলা, ও পারে বাংলাদেশ। 

১৯৭৪ সালের সেই মাঘ মাস, সেই শীতকাল। এর পরের প্রবল গ্রীষ্ম দিনে দেশে অভ্যন্তরীণ জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়। মাঝে বসন্ত এলো, বাসন্তী দোল। ফাল্গুন মাস, দোলযাত্রা, রং খেলা, হোলি। শীত কমে আসছে, বাতাসের তাপ বাড়ছে। সেই সময় আমাদের হোলি-প্রস্তুতি শুরু হতো বাসন্তী বা দোল পূর্ণিমার কয়েকদিন আগে থেকেই। মানিকের এক মামাতো দাদা এসে সেবার আমাদের সেবার দোলের প্রস্তুতিতে হাত লাগালেন। কাটা সুপারির দ্বিখণ্ডিত শুকনো খোল সংগ্রহ করে আনা হলো। মোম গলিয়ে সেই গরম তরল সুপারির খোলের ভেতর ভরে সেটা বন্ধ করে ভালো করে ঝাঁকিয়ে সতর্কভাবে রাখা হতো। ঠান্ডা হয়ে গেলে আরো সতর্কভাবে সেই সুপারির খোল খোলা হতো। ভেতরে ছোট্ট বলের মতো সুপারির আকারের মোমের বল তৈরি হতো। একটা ইঞ্জেকশনের সুচ দিয়ে জলে গোলানো রং তাতে ভরে আমাদের ‘রং গুলি’ তৈরি হলো। এই ‘রঙের গুলি’ অনেক দূর থেকেও কারো শরীর লক্ষ্য করে ছুড়ে তাকে রং ছিটিয়ে ঘায়েল করা যেত। বন্দুকের গুলির মতো সেই মোমগুলি ভেঙে জামার উপর রং ছিটিয়ে দিত। আমাদের উল্লাস ও আক্রান্তের ভ্যাবাচ্যাকা রাগ, জমে উঠতো আমাদের রঙখেলার মজা। বাঁশ দিয়ে বানানো পিচকারির থেকে গোলাপি আবিরেই আমার টান ছিল বেশি। দ্বিতীয় দিন পিচকারি, রঙ-গুলি, প্রথমদিন শুধু আবির খেলা শুরু হতো বড়দের পায়ে আবির দিয়ে। সমবয়সীরা দল বেঁধে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরতাম, দাদাদের মধ্যে চুপিচুপি ভাঙের শরবত খাওয়ার চল থাকলেও আমাদের জন্য বরাদ্দ ছিল লাড্ডু। খেলায় শেষ হতো কাদা খেলায়, এরপর কলোনির পুকুরে সবাই মিলে স্নানে। 

কলোনির কয়েকটি বাড়িতে ‘ঝুলন’ হতো। তিন নম্বর গলির গোস্বামী বাড়িতে উঠানের একদিকে দোলনায় ঝোলানো থাকতো গোপাল। তকে আবির মাখানো হতো। এই বাড়ির বড় মেয়ে মধুমিতা ব্যডমিন্টনে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। মায়ের কাছে এই ঝুলনের গল্প শুনতাম। রাধাকৃষ্ণের প্রেম আনন্দের এই রঙিন উদ্‌যাপন। ব্রজে বা মথুরায় অর্থাৎ কৃষ্ণের শৈশব ও কৈশরের ভূমিতে রঙ-প্রথা পালিত হয় রং খেলার মধ্য দিয়ে। কৃষ্ণবর্ণ চেহারা ছিল কৃষ্ণের। পুতনার বিষ মাখানো স্তনের দুধ পানের প্রকোপেই হোক বা ‘নারায়ণের অবতার’ রূপেই হোক তার নামের সঙ্গে, কৃষ্ণকথার অংশ হয়ে গিয়েছে এই গাত্রবর্ণ। সে বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে ‘হোলি’ খেলায় মাতোয়ারা হতো। গৌড়বর্ণা রাধা ও তার সখীদের আবির কুমকুমে রাঙিয়ে দিতো কৃষ্ণবর্ণ কৃষ্ণ ও তার সাথীরা।  এই গাত্রবর্ণ প্রসঙ্গে মনে পড়ে, ১৯৯১ নাগাদ মালদহে এক সাহিত্য আলোচনায় উদ্বোধনে এসে ‘রাজনগর’ স্রষ্টা অমিয়ভূষণ মজুমদার বলেছিলেন, কৃষ্ণের বা রামের গাত্রবর্ণ কালো, এটা প্রতীকী। এই কৃষ্ণবর্ণ আসলে সমাজের প্রান্তিক, শূদ্র জনতার আধিপত্যের প্রতীকী প্রতিনিধিত্ব। উঠে দাঁড়িয়ে ‘একটা পুঁচকে ছোকরা’ এই কথার প্রতিবাদ করায় সেবার বেশ শোরগোল পড়ে যায়। আমি সেই সময় ও আজও এই ব্যাখ্যার বিপ্রতীপে আছি। বর্ণবাদী সমাজের ডিসকোর্স এতো সরলীকরণ মেনে চলে না। ব্রাহ্মণ্যবাদ নির্মিত সাহিত্য তো নয়ই।

এই উপমহাদেশের মিথে, আখ্যানে, লোকধর্মে ও বিশ্বাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী শব্দ ‘শ্রীকৃষ্ণ’, এঁকে অতিক্রম করে যাওয়া কঠিন। এই কৃষ্ণ আবার এক রহস্যেরও নাম। ‘মহাভারত অনুযায়ী এই কৃষ্ণে সার্বিকভাবেই কুরু-পাঞ্চাল-যাদব বংশধারার রাজন্যবর্গ দূর বা নিকট সম্পর্কে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ।’ (নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী) 

কৃষ্ণের পালক পিতা নন্দ গোপালক শূদ্র আভীর জাতির অন্তর্ভুক্ত। অভিজাত যদুবংশীয় পুরুষ কৃষ্ণের পিতা বসুদেবের সঙ্গে তার নিবিড় বন্ধুত্ব ছিল। নন্দ গোপালক আভী তার স্ত্রীদের নির্দ্বিধায় বাসুদেবের আশ্রয়ে রেখে আসতেন। নন্দগোপালের ঘরে সেই সন্তানসম্ভবা রমণীরা সন্তানের জন্ম দিতেন। বসুদেব রোহিণীকে সন্তানসবম্ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে নন্দগোপালের কাছে পাঠিয়েছিলেন। সেখানেই হলধর বলরামের জন্ম হয়। কৃষ্ণের জন্মে বেশ রহস্য জড়িয়ে আছে। তিনি বসুদেব-দেবকীর সন্তান এবং নন্দের ঘরে পালিত। অথবা নন্দেরই সন্তান যদুবংশীয় বসুদেবের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছেন। অথবা নন্দের ঘরে প্রেরিত বসুদেবের কোনো এক স্ত্রীর গর্ভে বসুদেব বা নন্দের ঔরসে জন্ম। নন্দকে নপুংসক দেখানোর আখ্যানও তো আমরা পাই! এমন নানা প্রশ্নের ঠিকঠাক উত্তর খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তবে কৃষ্ণের গায়ের রং কালো ছিল। কালো বলেই তিনি কৃষ্ণ। যেমন কালো ছিলেন কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস। তবে তো কৃষ্ণ নির্ভেজাল আর্য জনক-জননীর সন্তান ছিলেন না! ব্যাসের জন্মবৃত্তান্ত তার গায়ের রঙের রহস্য ব্যক্ত করলেও কৃষ্ণের তো তেমন কোনো সমাধান সূত্র মেলে না! এই রহস্যের সমাধান না হলেও জন্মসূত্রের বা পালিত হওয়ার কারণে আভীর জাতির গোপালক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকলেও কৃষ্ণের প্রধান দ্বন্দ্ব ও সখ্য দুই-ই ছিল আর্য অভিজাত বর্গের সঙ্গেই। অনার্যদের যে অংশ আর্য সংস্কৃতির বিরোধী বা অনুকূল ছিল না কৃষ্ণ তাদের বিনাশে সক্রিয় ছিলেন। তিনি যেনতেনভাবে তার আধিপত্য বিস্তারে আপসহীন ছিলেন। তার শরণাপন্ন না হলেই তাদের বিনাশ ঘটিয়েছিলেন তিনি। একের পর এক রাজাদের, গোষ্ঠিপতিদের হত্যা করে, হত্যা করিয়ে শেষে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে সমবেত রাজাদের সমূলে বিনষ্টের ব্যবস্থা করে তিনি কী চেয়েছিলেন? নিজে রাজা হননি। তিনি চেয়েছিলেন সর্বময় প্রভু হতে। ঈশ্বরের জায়গায় নিজেকে স্থাপিত করতে চেয়েছিলেন কৃষ্ণ। যা তিনি পেরেছেন। 

পুরাণে বসুধা বিষ্ণুর স্ত্রীরূপে কল্পিত। বিষ্ণুর ঔরসে বসুন্ধরার গর্ভে নরকাসুরের জন্ম হয়েছিল। নরকাসুর নিধনের পর বসুন্ধরা পৃথিবী শ্রীকৃষ্ণের কাছে গিয়ে বলেছিলেন– ‘হে নাথ, যখন বরাহরূপে তুমি আমাকে উদ্ধার করেছিলে, তখন তোমার কারণে আমার গর্ভে এই পুত্র জন্ম নিয়েছিল।’ এরপর তিনি বলেন–

দত্তস্ত্বয়ৈব গোবিন্দ ত্বয়ৈব বিনিপাতিতঃ।

যথেচ্ছসি তথা ক্রীড়া বালঃ ক্রীড়ন কৈ রিব।। (হরিবংশ, বিষ্ণু পর্ব– ৬৩/১২৫)

‘হে গোবিন্দ, এই পুত্রকে তুমিই দিয়েছিলে, তুমিই মেরেছ, বালক খেলনা নিয়ে যেমন খেলে, তুমিও যেমন ইচ্ছে খেলা করো।’

এই ‘খেলা’র আগ্রাসী নেশায় পররাজ্য আক্রমণ করিয়েছেন অর্জুনকে দিয়ে। যুধিষ্ঠির ইন্দ্রপ্রস্তের রাজা হলে নাগরাজ (অন্ত্যজ শ্রেণীর বা অনার্য) রাজ্য খাণ্ডববনে নির্মম আক্রমণ চালিয়েছেন। সেখানকার অধিবাসীদের অগ্নিতে নিক্ষেপ করে হত্যা করা হয়েছে। খাণ্ডববনের কয়েকজন আদিবাসী ছাড়া সবাই নিহত হন। তক্ষক কুরুক্ষেত্রে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান। এভাবেই আমরা যদি পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মতো পুরাণের, মহাকাব্যের পাতা উলটে তার গভীরে যাই তবে অনেক আখ্যানই নানা রং ও চেহারায় সামনে এসে দাঁড়াবে। পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর কাজ মুলতবি রেখে আমাদের সেই সব রঙখেলার দিনের কথা বলি।

সম্প্রতি সময় ও সুযোগ থাকলেই আমি সেমিনার শুনতে যাই। গত বছর কলকাতায় একক আলোচনায় আমেরিকার হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর অরিন্দম চক্রবর্তী আমাকে মুগ্ধ করেছিলেন তার দর্শন চিন্তার আধুনিক বয়ানে। কথার শুরুতে মার্ক্সের প্রসঙ্গ এনে বলেছিলেন, ‘দার্শনিকরা কেবল এ যাবত জগতটাকে ব্যাখ্যা করেছেন, আসল কাজ হলো জগতটাকে বদলানো’ –এই মহাকাব্য যে মুনি বলেছিলেন, দ্বান্দ্বিক জড়বাদ ও ঐতিহাসিক সমাজবাদের প্রবক্তা সেই মুনি আজ নিজেই জগৎ বদলের জোয়ারে তামাদি হতে বসেছেন। তার আলোচনায় ‘সংস্কার’ প্রসঙ্গে কৃষ্ণের কথা বলেছিলেন তিনি। যাগযজ্ঞ, বেদমন্ত্রের অনুস্বর বিসর্গ নিয়ে চুলচেরা বাদানুবাদ, ইন্দ্র বরুণ অগ্নি সোম ইত্যাদি নানা দেবতার উপাসনার জরাজীর্ণ এক ধর্মকে সংস্কার করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। পাপ, পুণ্য ও বর্ণ সংকর, গুরুজন বধ ইত্যাদি নিয়ে অর্জুনের মনে যত সংস্কার ছিল তা জ্ঞানাগ্নি দিয়ে ভস্ম করেই কৃষ্ণ সংস্কারকরূপে অবতীর্ণ হলেন। তিনি শাস্ত্রবিভ্রান্ত মানুষকে আত্মমুখী করবার জন্য বললেন, ‘সব ধর্ম পরিত্যাগ করে, এক আমার শরণ নাও’। এই প্রসঙ্গেই একটা কথা মনে এলো, ১৮৪৩-৪৪ নাগাদ এঙ্গেলস একটি প্রবন্ধে লিখেন যে– বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থার দৌলতে উদ্ভূত নৈতিক অবক্ষয় রোধের রাস্তা আর যাই হোক না কেন, ধর্মের পুনরুজ্জীবন অন্তত নয়। এর অনেক পরে ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’তে মার্ক্স এঙ্গেলস আক্ষেপ করেন, আত্মসর্বস্ব হিসাব-নিকাশের বরফজল বুর্জোয়ারা ডুবিয়ে মেরেছে ধর্মোন্মাদনার প্রশান্তদিব্য ভাবোচ্ছ্বাসকে। অথবা এর দুবছর আগে তাদের লেখা ‘জার্মান ইডিওলজি’তে তুলে ধরা ‘ন্যাচারাল ইডিওলজি’ প্রসঙ্গ। মানুষের ধর্মবোধের অঙ্কুর খুঁজে পাওয়া যায় সেইসব প্রাগৈতিহাসিক দিনকালের মধ্যে, যখন প্রকৃতির পরাক্রমের কাছে নতজানু মানুষ প্রকৃতির খেয়ালের মধ্যে দেখছিল এক অদৃশ্য মহাবলের স্বাক্ষর। প্রাকৃতিক ‘মহালীলা’র স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হিসাবে ধর্মবোধকে চিহ্নিত করতে মার্ক্সেরও কোনো কুণ্ঠা ছিল বলে মনে হয় না। 

আত্মমুখী মানুষ ভোগের ‘ভুবনব্যাপী’ বিস্তৃত জালে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আজ সে হারিয়ে ফেল তার নিজেরই ফেলা আসা সময়কে, হারিয়ে ফেলে হাসি খুশি আনন্দের নির্মল সময়। আজ আমাদের শৈশব, কিশোরবেলা জুড়ে সবাই মিলে যে আনন্দে মেতে থাকতাম আজ সেই আনন্দের দিনকাল স্মৃতি ধূসরতায় পথ হারাচ্ছে। ডিজিটাল সভ্যতায় আমরা নিছক দাবার গুটি আজ, রিমোটের হেলনে নড়াচড়া করি। ম্লান হয়ে আসে আমাদের লোকধর্ম, লোককথায় জড়িয়ে থাকা বহুত্ববাদের আলো। মার্ক্স কথিত সেই আপ্তবাক্য মনে আসে– প্রলেতারিয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে পুরোনো ধর্মব্যবস্থার মেরুদণ্ড হলো বুর্জোয়া স্বার্থ। ঠাকুরমা, মায়ের কাছে শোনা পুরাণের গল্প বলেন, তাদের আচার বিচার সংস্কারের সামনে দাঁড়িয়ে মনে হয় আমাদের লোকধর্ম এই সমীকরণ থেকে হয়ত মুক্ত ছিল। সেখানে সত্যনারায়ণের প্রাসাদ করা হয় শিন্নি। মসজিদের পুকুরে ভাসিয়ে দেয়া হয় মনসার ভেলা। 

আমাদের সেই মিলেমিশে থাকার দিনের বাংলায় দোল পূর্ণিমার আগের আগের দিন বুড়ির ঘর পোড়ানো হয়। আমাদের বাড়ির পাসের সেই ‘বুড়োর মাঠ’য়ে আমরা ছেলেছোকড়ারা বুড়ির ঘর বানাতাম। বাঁশের চারটে খুঁটি এবং তার চারদিকে শুকনো ডালপাতা, শুকনো সুপারির খোল ও পাতা, শুকনো কলাপাতা দিয়ে দহনপ্রবণ কাঠামোটি বানানো হতো। এরমধ্যে কেউ আবার মিষ্টি আলু বা কাঁচা আম প্রভৃতি রেখে আসত। দোলের আগের সন্ধ্যায় সেই বুড়ির ঘরে আগুন লাগিয়ে ‘বহ্নি-উৎসব’ হতো। দাউ দাউ আগুনের লেলিহান শিখা উপরের দিকে উঠে যেত, আর সেই আগুন ঘিরে আমাদের হই হই নাচ ও উদ্দাম উল্লাস। মা বলতেন, যা কিছু অশুভ, পুরোনো ক্লেদ– তাকে দহন করা হতো এইভাবে। পরদিন হোলি।  

আমাদের এই বহ্নি-উৎসব ও রঙের খেলা ‘হোলি’কে নিয়ে যে গল্পটি প্রচলিত আছে সেটি সিন্ধু গঙ্গা পদ্মা নদী বিধৌত এই অঞ্চলের মিথ পূরণ থেকে আহরণ করা। আর্য ও অনার্যের সংঘাতময় সেই পুরাণ কথিত সময় দেবকুলের ক্ষমতা বৃত্তের বাইরে যে অংশ তাকে দৈত্য দানব বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এহেন দৈত্য কুলের সম্রাট হিরণ্যকশিপুরের ভাই হিরণ্যাক্ষ পৃথিবীকে হরণ করে পাতালে নিয়ে গেলে বিষ্ণু বরাহ রূপে তাকে হত্যা করে। ভাইকে হত্যা করায় তার রাজ্যে বিষ্ণুর নাম উচ্চারণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে হিরণ্যকশিপুর। এহেন হিরণ্যকশিপুরের চার সন্তানের কনিষ্ঠ সন্তান প্রহ্লাদ শৈশব থেকেই ছিল নারায়ণ বা বিষ্ণু ভক্ত। হিরণ্যকাশিপুরের কাছে এ ছিল পরাজয়ের অধিক, মৃত্যু। তাই তিনি প্রহ্লাদকে হত্যা করার বাসনায় নানাভাবে ফন্দি ফিকির করেও ব্যর্থ হয়ে অবশেষে তাকে পুড়িয়ে মারার বিধান দেন। হিরণ্য দুহিতা হোলিকা দাদার আদেশে প্রহ্লাদকে নিয়ে আগুনে প্রবেশ করেন। কিন্তু ‘বিষ্ণুর কৃপায়’ প্রহ্লাদ অক্ষত থাকে কিন্তু হোলিকা দগ্ধ হয়ে মারা যায়। হোলিকা দহনের সেই ছাই দিয়ে উৎসব। হোলিকার পুড়ে যাওয়ার ঘটনাকেই উৎসবের চেহারায় উদ্‌যাপন করা হয়, পরদিন রঙের উৎসব তাই হোলি উৎসব।

মনে পড়ছে, হোলির রাতে আমাদের ‘সোনারকাঠি পাঠাগার’-এ পাঁচু মাস্টারের সঙ্গে হরপ্রসাদ ঘোষ স্যারের সেই তুমুল বিতর্ক। শ্রেণি সংগ্রামের তত্ত্বে বিশ্বাসী হরো স্যার পূজা আরাধনার থেকে অনেক দূরে থাকা মার্ক্সবাদী। পাঁচু মাস্টার লোকধর্মের প্রাণশক্তিতে বিশ্বাসী। আজ হলে আমার পক্ষপাত হরপ্রসাদ স্যারের দিকেই যেত। তিনি একসময় আমার প্রাইভেট টিচার ছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসাবে তাম্রফলক পেয়েছেন। তিনি বলতেন- সামাজিক পরিবেশ বিভিন্ন কারণে ও বিভিন্ন সময়ে ‘সংস্কৃত’ হয়েছে। আমাদের লোক কথা, লোক ধর্মের আচার বিচার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পালটেছে। ‘সংস্কার’-এর আবার দুই অর্থে আমরা জানি। জরাজীর্ণ বাড়িকে মেরামত করে বাসযোগ্য করে তোলা এক ধরনের ‘সংস্কার’। আবার বহু পুরোনো দিন থেকে অভ্যাসবশত একই ধরনের আচার বিচার আঁকড়ে রাখা যা আধুনিকীকরণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তাও ‘সংস্কার’। এই ‘সংস্কার’ থেকে মুক্ত হওয়াই ‘সংস্কারমুক্ত’ থাকা।

এই পরিবর্তনের বা নব-নির্মানের মধ্যকালীন ভারতের গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময় ভক্তি ব্যাখ্যায় ও ভক্তিমূলক দর্শন গণসমর্থন লাভ করে, এর মধ্যে বাংলা ও উড়িষ্যা, আসামে বৈষ্ণব মতো, পূর্বোত্তর ভারতে বিষ্ণু ও শৈব সিদ্ধান্ত প্রচলিত ছিল। উদারতা ও সাম্য চিন্তার অভাব ছিল না। এই ভক্তিসিদ্ধান্তে ভক্তের সঙ্গে আরাধ্য দেবতার ব্যক্তিগত সম্পর্ক গুরুত্ববহ। এই লোক-ধর্মীয় সমাজ এক বিচিত্র গণতান্ত্রিকতাকে সমাজে ও ধর্মে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। এই মতই পুষ্ট হয় যে দেবদেবীর পূজা-উৎসবে সবার সমানাধিকার আছে। কিন্তু এই ‘গণতান্ত্রিকতা’ আরাধনায় সীমাবদ্ধ থেকে যায়। বৃহত্তর সমাজে জাতিবর্ণ ভেদ তেমনি রয়ে যায়। এ এক ধরনের ‘স্পিরিচুয়াল ডিমোক্রেসি’। এই ‘আধ্যাত্মিক গণতন্ত্র’ সামাজিক বৈষম্য দূর করতে পারেনি। শ্রেণিবৈষম্য ও পুঁজির ক্ষমতায়ানের বিরুদ্ধে জনতার সংগ্রামই সাম্যের কাছে নিয়ে যেতে পারে।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
শর্টকাটে বড়লোক হতে গিয়ে
শর্টকাটে বড়লোক হতে গিয়ে
নারী ফুটবল লিগ থেকে চারটি দলের ভোটাধিকার থাকছে!
নারী ফুটবল লিগ থেকে চারটি দলের ভোটাধিকার থাকছে!
থেমে থাকা ট্রাকে পিকআপের ধাক্কা, ২ জন নিহত
থেমে থাকা ট্রাকে পিকআপের ধাক্কা, ২ জন নিহত
প্রতিদিন মা হারাচ্ছে ৩৭ ফিলিস্তিনি শিশু
প্রতিদিন মা হারাচ্ছে ৩৭ ফিলিস্তিনি শিশু
সর্বাধিক পঠিত
মুক্তি পেলেন মামুনুল হক
মুক্তি পেলেন মামুনুল হক
যশোরে আজ সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
যশোরে আজ সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
২৫ জেলার সব মাধ্যমিক স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা শনিবার বন্ধ
২৫ জেলার সব মাধ্যমিক স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা শনিবার বন্ধ
ব্যর্থতার অভিযোগে শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগ চেয়ে আইনি নোটিশ
ব্যর্থতার অভিযোগে শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগ চেয়ে আইনি নোটিশ
কেমন থাকবে আগামী কয়েকদিনের আবহাওয়া?
কেমন থাকবে আগামী কয়েকদিনের আবহাওয়া?