হারুকি মুরাকামির গল্প

পারিবারিক ব্যাপারস্যাপার

আমার ছোটবোনের নেয়া জীবনের অন্যান্য সব বিরক্তিকর সিদ্ধান্তের মতোই, তার খুঁজে বের করা হবু বাগদত্তাকে দেখেও আমি যারপরনাই বিরক্ত হলাম। যতই ছেলেটার প্রতি আমার অপছন্দ ক্রমে ক্রমে বাড়ল, ততই আমার বোনের রুচি এবং সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর সক্ষমতাকে ঘিরে আমার সন্দেহ ঘনীভূত হতে থাকল। নিজের জীবনের বিষয়ে নেয়া তার এ সিদ্ধান্তও আমাকে যারপরনাই হতাশ করেছে।

এখন, বলতে পারেন যে আমার মনমানসিকতা সংকীর্ণ।

অন্তত আমার ছোটবোনের তাই মত। ছেলেটার ব্যাপারে আমার মতামত নিয়ে তার সঙ্গে সেভাবে খোলামেলা কোনো আলাপ হয়নি এখনও, কিন্তু সে ইতোমধ্যে টের পেয়ে গেছে যে ওকে আমার তেমন পছন্দ হয়নি, আর এ নিয়ে সে তার বিরক্তি মোটামুটি রাখঢাক ছাড়াই প্রকাশ করে চলেছে ক্রমাগত।

“দুনিয়ার প্রত্যেকটা ব্যাপারেই তোমার দৃষ্টিভঙ্গি, মনমানসিকতা খুব ছোট” সে বলল।

আমাদের আলাপের বিষয়বস্তু অবশ্য এ মুহূর্তে ছিল স্প্যাগেটি। সে বোঝাতে চাইছিল যে স্প্যাগেটি নিয়েও আমার দৃষ্টিভঙ্গি, মনমানসিকতা খুব সংকীর্ণ।

যদিও তার মূল বক্তব্য অবশ্যই স্প্যাগেটিকেন্দ্রিক ছিল না। স্প্যাগেটির ঠিক পেছনেই ঘাপটি মেরে ছিল ওর বাগদত্তা। ছেলেটাকে নিয়ে আমার উদাসীনতাকে কেন্দ্র করেই আসলে সে এই ক্ষোভ ঝাড়ল। মোটের ওপর একটা ছায়াযুদ্ধ চলছিল আমাদের মাঝে।

এ সবকিছুর সূচনা এক রোববার বিকেলে, যখন ও আমাকে কী যেন এক রেস্তোরাঁয় গিয়ে ইতালিয়ান খাবার খাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। “ঠিক আছে,” আমি বলেছিলাম, কারণ সে সময় ঐ ধরনের কিছু একটা খেতে আমারও মন চাইছিল। স্টেশনের কাছেই সম্প্রতি চালু হওয়া ছোটখাটো সুন্দরপানা দেখতে একটা স্প্যাগেটির দোকানে গিয়ে বসলাম আমরা। আমি বেগুন আর রসুনের মিশ্রণে তৈরি বিশেষ ধরনের এক স্প্যাগেটি অর্ডার করলাম, ও চাইল পেস্টো সস বিশিষ্ট স্প্যাগেটি। বিয়ার হাতে বসে আমি খাবারের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। মে মাসের এক রোববার ছিল সেটা। আবহাওয়া ছিল দারুণ।

খোদ স্প্যাগেটিকে নিয়েই সমস্যার শুরু হলো। সেটা ছিল তুলনাহীন রকমের জঘন্য। ওপরে দেখতে ময়দার গুঁড়োর মতো কী একটা ফালতু জিনিস ছড়িয়ে দিয়েছিল বাবুর্চি। আর ভেতরে তো খাবারটা ঠিকমতো রান্না করাই হয়নি। সেদ্ধ হয়নি জিনিসটা একদম, শক্ত শক্ত লাগছিল খেতে। আর যে বাটার তারা খাবারে ব্যবহার করেছিল, সেটা কোনো কুকুরের সামনে ধরলেও প্রাণীটা মুখ সরিয়ে নেবে। বাটি থেকে আমার থালায় প্রথমবার যেটুকু উঠিয়ে নিয়েছিলাম, তার অর্ধেকের বেশি খেতে পারলাম না একচুলও। ওয়েট্রেসকে ডেকে বাকি স্প্যাগেটিটুকু তুলে নিয়ে যেতে বললাম।

এসব কিছুর ফাঁকে আমার বোন দু-একবার আড়চোখে আমার দিকে তাকালেও কথা বলেনি কোনো। বরং বেশ সময় নিয়ে তাকে পরিবেশিত সম্পূর্ণ খাবারের একদম তারিয়ে তারিয়ে খেলো। আমি পুনরায় বিয়ারের বোতলে চুমুক দিতে দিতে তাকিয়ে রইলাম জানালা দিয়ে, বাইরে।

“খাবার অর্ধেক খেয়ে ফেলে দেয়ার মতোও বাজে ছিল না ওদের রান্না। এরকম নাটক না করলেও পারতে।” ওয়েট্রেস ওর প্লেটটাও তুলে নিয়ে যাবার পর ও মুখ খুলল।

“ওয়াক থু” বললাম আমি।

“সরি, অত খারাপও ছিল না খাবারটা। চাইলেই একটু কষ্ট করে পুরোটা শেষ করতে পারতে।”

“কী ঠেকা পড়েছে আমার? আমার পেট, আমার পাকস্থলি; এতে আমি কী ঢোকাব না ঢোকাব, তা নিয়ে সিদ্ধান্ত দেয়ার তুমি কেউ নও।”

“এই রেস্টুরেন্ট একেবারেই নতুন খুলেছে। রাঁধুনি নিজেও হয়তো এখানকার রান্নাঘরের সঙ্গে এখনও মানিয়ে উঠতে পারেনি পুরোপুরি। ওকে খানিকটা সহানুভূতি দেখালে কি তুমি মরে যেতে?” সে তার পাতলা, বিস্বাদ কফিতে চুমুক দিতে দিতে বলল।

“তা ঠিক আছে,” বললাম আমি, “কিন্তু যে খাবার মানুষের পছন্দ হয় না, তা সে খায় না, এটাই তো রীতি।”

“মুখটা বন্ধ রাখলে ভালো লাগে আপাতত, জনাব সবজান্তা শমশের!”

“তোমার সমস্যা কী? ঐটা শুরু হয়ে গেছে এর মধ্যেই? আই মিন, প্রতিমাসে তোমাদের, মেয়েদের যেটা হয়?”

“চুপ করো! এরকম আচরণ তোমার কাছ থেকে আশা করিনি আমি।”

“শান্ত হও,” জবাবে আমি বলি। “তুমি এই মুহূর্তে এমন একটা ছেলের সঙ্গে কথা বলছ, যে একদম চোখ বুজে বলে দিতে পারে মাসের কোন দিন তোমার পিরিয়ড শুরু হয়। যেবার তোমার পিরিয়ড শুরু হতে দেরি হলো, সেবার মা তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল।”

“আমি তোমার থোবড়া তাক করে আমার ডায়রি ছুড়ে মারব...”

যেভাবে ও কথাটা বলল, তাতে বোঝা গেল ও রসিকতা করছে না। কাজেই আমার বাধ্য হয়ে মুখ বন্ধ করতে হয়েছিল।

“তোমাকে নিয়ে সমস্যা হলো যে, তুমি দুনিয়ার তাবৎ জিনিস নিয়ে ছোটলোকি করে বেড়াও,” কফির মধ্যে অতিরিক্ত ক্রিম মেশাতে মেশাতে ও বলে (যার অর্থ, কফিটা আসলেই বিস্বাদ ছিল)। “দুনিয়ার সব নেতিবাচক জিনিসগুলোই তোমার চোখে পড়ে। কোনো কিছুর মাঝে ইতিবাচকতা খুঁজে বের করার চেষ্টাটুকু করতেও তুমি রাজি নও। তোমার মাপকাঠীতে কোনোকিছু ভালো না হলেই তুমি সেটা আর ছুঁয়েও দেখো না। পুরো ব্যাপারটা ভয়াবহ বিরক্তির।”

“হতে পারে। তবে বিষয় হলো—জীবনটা আমার, তোমার না।”

“এবং এই যুক্তি খাটিয়ে তোমার কাজেকর্মে তুমি যে মানুষজনকে কতটা কষ্ট দাও, তা তোমার ধারণাতেও নেই। তোমার ফেলে ছড়িয়ে রাখা আবর্জনা সাফ করা হচ্ছে আমাদের সবার কাজ। এমনকি তোমার হস্তমৈথুনের আবর্জনাও।”

“কী যা তা বলছ!”

“হাই স্কুলে পড়ার সময় তুমি তোমার বিছানার চাদরের ওপর মাস্টারবেট করতে। ঘরের মহিলাদের তারপর তোমার সেই নোংরা বিছানার চাদর ধুয়ে পরিষ্কার করা লাগত। অন্তত পুরো বিছানার চাদর নোংরা করা ছাড়া অন্য কোথাও কাজটা করেও তুমি আমাদের ওপর একটু রহম করতে পারতে।”

“এখন থেকে আরও সতর্ক হব আমি,” আমি বললাম। “ক্ষমা চাইছি একই কথা বারবার বলার জন্য, কিন্তু তবুও, দিনশেষে এটা আমারই জীবন। আমার পছন্দ আমার পছন্দ, আমার অপছন্দ আমারই অপছন্দ। ব্যাপারটা এভাবে মেনে নেয়াটাই সবার জন্য ভালো।”

“তাই বলে তুমি মানুষজনকে কষ্ট দিয়ে বেড়াতে পারো না। একটু সহনশীল হলে তোমার কী এমন ক্ষতিটা হয়? কী হয় নেতিবাচক দিকটা এড়িয়ে একটু ইতিবাচক হলে? আর একটু সহনশীল হলে? বড় হবে না কখনো তুমি?”

এই কথাটা বলেই মেয়েটা সীমা অতিক্রম ফেলল। “আমি বড়ই। সহনশীলও। প্রতিটা জিনিসের ইতিবাচক দিকে তাকানোও আমার পক্ষে সম্ভব। কিন্তু যা কিছু তোমার নজর কাড়ে, আমার ওগুলো ভালো লাগে না, এই যা।”

“এটাই বোঝাতে চাইছি আমি। তোমার এই ঘাড়ত্যাড়ামোর কথাই বলতে চাইছি। এই স্বভাবের কারণেই তোমার কোনো গার্লফ্রেন্ড টেকে না। অথচ তোমার বয়স সাতাশ বছর।”

“কে বলেছে আমার গার্লফ্রেন্ড নেই!”

“শুয়ে বেড়ানোর জন্য মেয়ে আছে তোমার কাছে। তুমি নিজেও বুঝতে পারছ আমি কী বলতে চাইছি। বছর বছর সঙ্গী বদলাতে তোমার নিজেরও কি ভালো লাগে? ভালোবাসার মূল্য বোঝো তুমি? বা, পারস্পরিক বোঝাপড়া, সহানুভূতি, সহমর্মিতা? এগুলো না থাকলে একটা সম্পর্ক সম্পর্ক হয় কখনো? সে তো ঐ মাস্টারবেট করার মতোই।”

“প্রতি বছর আমার সঙ্গী বদলায় না; বাড়িয়ে বলছ কেন?”

“ঐ একই কথা। তোমার জীবন নিয়ে আরও গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করা উচিত, আচরণ করা উচিত পরিণত মানুষদের মতো।”

এরপর আমাদের দুজনের কারওই আর কোনো কথা বলার রুচি ছিল না।

বিগত কয়েক বছরে ওর আচরণ আমার প্রতি এতটা বদলে গেল কেন? এই কিছুদিন আগেও তো আমার মতোই ওর জীবনও ছিল অগোছালো, লক্ষ্যহীন। এমনকি, যদি আমার বোঝাপড়ায় ভুল না থাকে তবে মনে তো হয় যে ও আমাকে খানিকটা সম্মানও করত বড়ভাই হিসেবে। ওর এই বাগদত্তা ছেলেটার সঙ্গে পরিচয় হবার পর থেকেই ও আমার নির্মম সমালোচকে পরিণত হয়েছে।

আমার কাছে এই পুরো ব্যাপারটা ভয়াবহ রকমের অবিচার লাগে। ঐ ছেলেটার সঙ্গে ওর সম্পর্ক আজ অল্প কয়েক মাসের। কিন্তু আমার সঙ্গে ওর ‘সম্পর্ক’ কমসে কম তেইশ বছরের। আমাদের সম্পর্ক সবসময়ই সুন্দর ছিল, কখনোই ঝগড়া হতো না। এতটা সততার সঙ্গে, আর খোলামেলাভাবে নিজেদের মাঝে সবকিছু নিয়ে আলাপ করতে পারে, এমন আর কোনো ভাইবোনের খবর আমার জানা ছিল না। আর এটা বলতে আমি কেবল আমার মাস্টারবেশন আর ওর পিরিয়ড শুরু হবার কাহিনি বোঝাচ্ছি না। আমি প্রথম কনডম কবে কিনি তা ও জানে (তখন আমার বয়স সতেরো বছর), আর ও প্রথম কবে লেইসের আন্ডার গার্মেন্টস কেনে সেটা আমি জানি (তখন ওর বয়স উনিশ বছর)।

আমি ওর বান্ধবীদের ডেট করেছি (কাউকে নিয়ে বিছানায় যাইনি যদিও) এবং ও নিজেও আমার বন্ধুদের ডেট করেছে (আশা করি ও নিজেও তাদের কারও সঙ্গে বিছানায় যায়নি)। আর এভাবেই আমরা বেড়ে উঠেছি। এই অসাধারণ বোঝাপড়া আজ প্রায় এক বছর ধরে একদম শেষের পথে। যতই বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করি, ততই আমি ভেতরে ভেতরে ফুঁসে উঠি।

কাছেই এক ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে ওর একজোড়া জুতা কেনা লাগবে, বলল। আমি ওকে রেস্টুরেন্টের বাইরে রেখে এসে নিজে একা আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে এলাম। ফিরে এসে আমার গার্লফ্রেন্ডকে একটা ফোন দিলাম, কিন্তু সে ধরল না। ব্যাপারটা বিস্ময়কর না তেমন। রোববার দুপুর দুটো বাজে কোনো মেয়েকে হুট করে ডেটে বেরুতে বললে তার জবাব ‘না’ই হবার কথা। আমি আমার টেলিফোনের ডাইরেক্টরি উলটেপালটে আরেকটা মেয়ের নম্বরে কল করলাম, এক ছাত্রী সে, যার সঙ্গে দেখা হয়েছিল কোনো এক ডিস্কোতে। সে ফোন ধরল।

“বাইরে কোথাও গিয়ে একটু বিয়ার টিয়ার খাই, চলো।”

“মজা করছ নিশ্চয়ই! এখন দুপুর দুটো বাজে।”

“তো কী হয়েছে? সূর্যাস্ত পর্যন্ত আমরা পান করতে থাকব। বসে বসে সূর্যাস্ত দেখবার জন্য একদম পারফেক্ট একটা বার আমার চেনা আছে। ওখানে বেলা তিনটার মধ্যে গিয়ে না ঢুকলে ভালো সিট পাওয়া যায় না।”

“তুমি দেখছি সূর্যাস্ত বিশারদ একজন!”

যা হোক, খানিক গাঁইগুঁই করে সে রাজি হলো। আমি তাকে তার বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে এলাম। ইয়োকোহামা সমুদ্র তীর ঘেঁষে কিছুক্ষণ গাড়ি চালিয়ে অবশেষে আমরা একটা বারে এসে উপস্থিত হলাম, যাতে বসে পুরো সমুদ্র দেখা যায়। আমি বসে বসে চার গ্লাস আই ডব্লিউ হারপার সাবাড় করে দিতে দিতে সে পান করল কলা আর রামের সংমিশ্রণে বানানো মাত্র দুটো ডাইকুইরিস (শুনলে কেউ বিশ্বাস করবে?)। এভাবে, বসে বসে আমরা সূর্যাস্ত দেখলাম।

“এতটা পান করার পর তোমার গাড়ি চালাতে অসুবিধা হবে না?” ও প্রশ্ন করল।

“কোনো সমস্যা নেই। যে পর্যন্ত পান করলে মাতাল হয়ে যাব, তার অনেক কমই ঢুকেছে পেটে।”

“অনেক কম?”

“চারটা ড্রিংক আমাকে আমার সাধারণ অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে আসে বরং। তোমার বিন্দুমাত্র দুশ্চিন্তা করার কারণ নেই। বিন্দুমাত্রও না।”

“ঠিক আছে। বলছ যখন...”

আমরা গাড়ি চালিয়ে ইয়োকোহামা ফিরে এলাম। খাওয়াদাওয়া করলাম। গাড়িতে বসে চুমুও খেলাম বেশ কয়েকবার। আমি চাইছিলাম ওকে নিয়ে একটা হোটেলে যেতে, কিন্তু ও রাজি হলো না।

“আমি টেম্পুন পরে আছি।”

“বের করে ফেলো জিনিসটা।”

“বাহ, কী সুন্দর পরামর্শ! আজকে আমার পিরিয়ডের দ্বিতীয় দিন।”

দিন বটে একখানা! এর চেয়ে বরং আমার গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে ডেটে বেরুলেই ভালো হতো। অথচ আমি করলাম কী? দীর্ঘদিন পর আমার বোনের সঙ্গে বেরুলাম শান্তিপূর্ণভাবে লাঞ্চ করতে। তারপর এখন এই অবস্থা। কী নিদারুন সব পরিকল্পনা আমার!

“দুঃখিত,” মেয়েটা বলে। “আমি কিন্তু সত্যি বলছি।”

“না না, ঠিক আছে। আমারই দোষ বরং।”

“আমার পিরিয়ড কীভাবে তোমার দোষ হয়?” সে ভ্রু কুঁচকে তাকাল আমার দিকে।

“না, মানে—আমার কারণেই তো ঘটনাগুলো এভাবে এগোল।” আমি উত্তর দিই। মেয়েটা প্রশ্ন করার মতো আর কোনো টপিক খুঁজে পায় না?

আমি গাড়িতে করে ওকে সেতাগায়ায়, ওর বাড়িতে পৌঁছে দিই। ফেরার পথে গাড়ির ক্লাচ কেমন একটা হাস্যকর ঘরঘর আওয়াজ করা শুরু করে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলাম, এটাকে নিয়ে গ্যারেজে যাওয়া দরকার একবার শীঘ্রই। এটা সেই ক্লাসিক দিনগুলোর একটা, যাতে একটা উলটোপালটা ঘটনা ঘটবার পর বাকি সব ঘটনা উলটোপালটাই ঘটতে থাকে।

“শীঘ্রই আবার একদিন দেখা করতে পারি আমরা?” আমি প্রশ্ন করি।

“ডেটের জন্য, নাকি হোটেলে নিয়ে যাবার জন্য?”

“দুটোই,” আমি হেসে জবাব দিই। “দুটোই তো পরস্পর সম্পর্কিত। টুথপেস্টের সঙ্গে টুথব্রাশ যেমন।”

“হতে পারে। চিন্তা করে দেখব।”

“নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। চিন্তা করা ভালো অভ্যাস। এটা মস্তিষ্কের আলসামো কমায়।”

“থাকো কোথায় তুমি? আমি আসতে পারি তোমার বাসায়?”

“দুঃখিত। আমি আমার বোনের সঙ্গে থাকি। আমাদের আগে থেকে ঠিক করা কিছু নিয়ম আছে। আমি ফ্ল্যাটে মেয়ে নিয়ে আসি না, ও কোনো ছেলে নিয়ে আসে না।”

“হেহ, যেন তোমার আপন বোন সে।”

“সত্যি বলছি। পরের দিন আমাদের চুক্তিপত্র নিয়ে এসে দেখাব তোমাকে। পরের রোববার, ঠিক আছে?”

সে হেসে ওঠে। “ঠিক আছে।”

আমি ওকে ওর বাড়ির দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে যেতে দেখি। তারপর আমি আমার গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট করে বাড়ি ফিরে আসি, সেই অদ্ভুত ক্লাচের আওয়াজ শুনতে শুনতে।

আমাদের অ্যাপার্টমেন্ট ছিল নিকষ কালো আঁধারে ছাওয়া। আমি বাতি জ্বালিয়ে আমার বোনের নাম ধরে কয়েকবার ডাকাডাকি করলাম, কিন্তু সে ভেতরে ছিল না। ঘড়িতে রাত দশটা। এত রাতে ও বাইরে কী করে? সান্ধ্যকালীন পত্রিকার খোঁজে এদিক সেদিক তাকালাম, খুঁজে পেলাম না। পরে মনে পড়ল, আজ রোববার। পত্রিকা দেয়ার কথা না।

আমি রেফ্রিজারেটর থেকে বিয়ার বের করে তা একটা গ্লাসে ঢেলে আমাদের বসার ঘরে চলে আসলাম। স্টেরিও ছেড়ে দিয়ে হারবি হ্যানককের নতুন একটা রেকর্ড চালিয়ে দিলাম রেকর্ড প্লেয়ারে। সংগীত শুরু হবার জন্য অপেক্ষা করতে করতে বিয়ারের গ্লাসে লম্বা চুমুক দিলাম। এদিকে স্পিকার থেকে কোনো শব্দই বের হচ্ছিল না। তখনই আমার মনে পড়ল স্টেরিওটায় আজ তিন দিন ধরে সমস্যা দেখা দিয়েছে। ওটার অ্যাম্পে পাওয়ার থাকলেও কোনো আওয়াজ বেরুচ্ছে না।

ঠিক একই কারণে টেলিভিশন দেখাও অসম্ভব। ওর নিজস্ব কোনো সাউন্ডবক্স নেই, স্টেরিওর সঙ্গে যুক্ত করা।

আমি শব্দহীন টেলিভিশনের দিকেই তাকিয়ে থেকে নীরবে আমার বিয়ারের গ্লাসে চুমুক দিয়ে চললাম। ওতে এক যুদ্ধ নিয়ে নির্মিত সিনেমা চলছিল। ফিল্ড মার্শাল রোমেলের অ্যাফ্রিকা কর্পস ট্যাংক মরুভূমিতে যুদ্ধ করছে। কামানগুলো নিঃশব্দে গোলাবর্ষণ করছে, মেশিনগান থেকে শব্দহীন গুলি ছুটছে, বিনা শব্দে একের পর এক মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে।

আমি আজকের দিনে ষোলোতম বারের মতো টেনে লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।

আজ থেকে পাঁচ বছর আগের এক বসন্তে আমি আমার বোনের সঙ্গে একই অ্যাপার্টমেন্টে বসবাস শুরু করি। আমার বয়স তখন বাইশ, ওর আঠারো। আমি মাত্রই কলেজ গ্রাজুয়েশন শেষ করে প্রথমবারের মতো একটা চাকরি নিয়েছি, এদিকে ও হাই স্কুল শেষ করে কলেজে উঠেছে মাত্র। আমাদের বাবা-মা কেবলমাত্র এক শর্তে ওকে কলেজের পড়াশোনা করতে টোকিও পাঠাতে রাজি হয়েছে : ওকে আমার সঙ্গে একই অ্যাপার্টমেন্টে থাকতে হবে। আমরা দুজনেই মোটামুটি খুশি মনে মেনে নিয়েছিলাম সেই শর্ত। তারা নিজেরাই একটা বড়সড় দুই বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্ট খুঁজে দিয়েছিল আমাদের, আমি তার অর্ধেক ভাড়া বহন করতাম।

বোনের সঙ্গে একসঙ্গে থাকার প্রস্তাবে আমি কোনো সমস্যা দেখিনি তখন। আমাদের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়াই যে ভালো ছিল শুধু, তা নয়; আমাদের দৈনন্দিন জীবনের রুটিনও মিলে যেত দারুণভাবে। একটা অ্যাপ্লায়েন্স ম্যানুফ্যাকচারার কোম্পানির গণসংযোগ বিভাগে চাকরি করা এই আমি সকালে অফিসের জন্য বের হতাম বেশ দেরি করে, আবার রাতে ফিরতেও অনেক দেরি হতো। অপরদিকে আমার বোন সকাল সকাল বের হয়ে গিয়ে সূর্যাস্তের আগেই বাড়ি ফিরে আসত। অন্যকথায়, ও যখন সকালে বের হতো তখন আমি ঘুমিয়ে থাকতাম, আর আমি যখন ফিরতাম ততক্ষণে ও ঘুমিয়ে যেত। এদিকে ছুটির দিনগুলোতেও আমি আমার গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে ডেটে বেরিয়ে যেতাম বলে ওর সঙ্গে পুরো সপ্তাহে আমার দুই কি তিনবারের বেশি কথা হতো না সাধারণত। আমরা চাইলেও কোনো বিষয় নিয়ে ঝগড়া করবার জন্য সময় বের করতে পারতাম না, একে অপরের ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও মাথা ঘামাতাম না তেমন।

যদিও আমি কখনো কখনো আঁচ করতে পারতাম যে ওর জীবনে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটছে হয়তো বা, কিন্তু আমার মনে হতো যে এ নিয়ে আমার বক্তব্য রাখার কোনো অধিকার নেই। ওর বয়স ততদিনে আঠারো পার হয়ে গিয়েছিল। ও কার ফ্ল্যাটে যাচ্ছে, কার সঙ্গে শুচ্ছে, এটা আর আমার চিন্তা করার বিষয় ছিল না তখন।

একরাতে অবশ্য আমার ওর হাত ধরে বসে থাকা লেগেছিল বেশ কিছুক্ষণ, রাত একটা থেকে তিনটা পর্যন্ত—নিখুঁতভাবে বলতে গেলে। অফিস হতে ফিরে দেখেছিলাম, ও কিচেন টেবিলে বসে কান্না করছে। যদিও আমাকে ও প্রায়ই ছোটলোক-স্বার্থপর ইত্যাদি বলে, কিন্তু নিজের রুমে বসে কান্না করার বদলে কিচেন টেবিলে বসে কান্না করার অর্থ বুঝতে আমার বেগ পেতে হয়নি। ও নিশ্চয়ই চাইছিল যে আমি ওকে খানিকটা সান্ত্বনা দিই।

আমাদের প্রাইমারি স্কুলের দিনগুলোতে, যখন আমরা দুজনে মিলে ফড়িং ধরতে বেরুতাম, তখন কখনো কখনো আমরা হাত ধরে থাকতাম পাশাপাশি। এতদিন পর এই প্রথম আমি ওর হাত ধরে বসেছিলাম ঠিক ওর পাশে। খেয়াল করলাম, ওর হাত ইতোমধ্যে স্বাভাবিকভাবেই বেশ বড় আর শক্তপোক্ত হয়ে উঠেছে।

ও বিন্দুমাত্র নড়াচড়া ছাড়া টানা দুঘণ্টা কেঁদেছিল। আমি বসে বসে অবাক হয়ে ভাবছিলাম যে, এইটুকু শরীর থেকে ও কীভাবে এত বেশি পরিমাণ পানি স্রেফ কান্নার মাধ্যমে বের করতে পারে। আমার ক্ষেত্রে তো মোটামুটি দুমিনিট কান্নার পরই চোখ শুকিয়ে খটখটে মরুভূমি হয়ে যায়।

ঘড়ির কাঁটা রাত তিনটার ঘর ছোঁয়া মাত্রই আমি টের পেলাম, অনেক হয়েছে, আর পারছি না। আমার দুচোখ ঘুমে বুজে আসছে। এখন ওর বড়ভাই হিসেবে আমাকে কিছু সান্ত্বনাসূচক কথা বলা লাগবে, যদিও এই উপদেশ দেয়াটেয়া মোটেই আমি উপভোগ করি না।

“আমি তোমার ব্যক্তিগত জীবনে নাক গলাতে চাই না,” আমি শুরু করি। “এটা তোমার জীবন, তোমার যেভাবে ইচ্ছে তুমি সেভাবে এটা কাটাবে।”

সে জবাবে মাথা নাড়ে।

“কিন্তু বড়ভাই হিসেবে আমার একটা পরামর্শ দেয়ার আছে। নিজের হ্যান্ডব্যাগে কখনো কনডম নিয়ে ঘুরবে না। এতে করে সবাই মনে করবে তুমি আসলে একটা মাগি।”

বাক্যটা শেষ হতে না হতেই টেবিলের ওপরে রাখা ভারী টেলিফোন ডাইরেক্টরি দিয়ে ও আমাকে দড়াম করে বাড়ি মারে।

“তুমি আমার পার্সে হাত দিয়েছ কেন আমাকে না বলে?”

রেগে গেলেই ওর জিনিসপত্র ছোড়াছুড়ি করার অভ্যাস। এই কারণেই ওকে আর সেদিন আমার বলা হয়ে ওঠেনি যে, আমি সত্যিই ওর ব্যাগ ঘাঁটিনি। এমনিই বলেছিলাম কথাটা।

সে যাই হোক, এতে কাজ হয়েছিল। ও কান্না থামাল, আমিও ঘুমানোর সুযোগ পেলাম।

ও কলেজ পাস করে একটা ট্রাভেল এজেন্সিতে চাকরি নেয়ার পরেও আমাদের সম্পর্ক একই রকম রইল। ও একদম ছকে বাঁধা ৯টা থেকে ৫টার চাকরি বেছে নিল, এদিকে আমার দৈনন্দিন জীবনের রুটিন গেল আরও ঢিলে হয়ে। প্রতিদিনই আমি দুপুর হবার খানিক আগে গিয়ে অফিসে হাজিরা দিতাম, আমার ডেস্কে বসে প্রথমে সেদিনকার সংবাদপত্র পড়তাম, তারপর দুপুরের খাবার খেতাম। ঘড়ির কাঁটা দুটো অতিক্রম করলে পরে আমি আস্তে ধীরে নড়েচড়ে বসে কাজ করা শুরু করতাম। তারপর বিজ্ঞাপন সংস্থায় থাকা লোকেদের সঙ্গে কোনো রকম একটা বন্দোবস্ত করে প্রতিদিন বাইরে গিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত মদ পান করতাম।

চাকরিজীবনের প্রথম গ্রীষ্মকালীন অবকাশে আমার বোন তার ট্রাভেল এজেন্সির সূত্রে তার কিছু বন্ধুবান্ধব দিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ায় একটা প্যাকেজ ট্যুর দিয়ে এলো। সেই ট্যুরের একজন সঙ্গী ছিল ওর চেয়ে বয়সে এক বছরের বড় একজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। জাপানে ফিরে আসার পর আমার বোন ওকে ডেট করা শুরু করল। এরকম ঘটনা ঘটতে প্রায়ই দেখা যায়, যদিও আমি এভাবে কাউকে ডেট শুরু করা পছন্দ করি না। প্রথম কথা হলো, আমি প্যাকেজ ট্যুরের আইডিয়াটাই অপছন্দ করি। এবং, এরকম একটা গ্রুপ ট্যুর থেকে পরিচিত হওয়া কারও সঙ্গে সিরিয়াস রিলেশনে যাওয়ার কথা চিন্তা করলেই আমার বমি আসে।

অবশ্য ঐ কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার ছেলেটাকে ডেট করা শুরু করবার পর আমার বোনের চেহারার রোশনাই বৃদ্ধি পেল। তারপর থেকে সে নিজের চেহারা এবং আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের চেহারা—উভয়ের ব্যাপারেই মনোযোগ আরও বাড়িয়ে দিল। এতদিন পর্যন্ত সে কাজে যেত একটা শার্ট, একটা ছেঁড়াফাটা-ফেডেড জিনস, আর স্নিকারস পায়ে দিয়ে। এদিকে এখন তার কাপড়চোপড়ে আগ্রহ এতটাই বেড়ে গেছে যে ওর রুমের একদম সামনের আলমিরা স্রেফ জুতো দিয়েই ভরে গেছে। অন্যান্য সব ক্লজেটও লন্ড্রি থেকে ফেরত আসা কাপড়চোপড়ে ভর্তি। অ্যামাজন জঙ্গল নিবাসী পিঁপড়ার ঢিবির অনুকরণে বাথরুমে উঁচু করে অপরিষ্কার জামাকাপড়ের স্তূপ বানানোর বদলে ও নিয়মিতই ওর পোশাকাদি লন্ড্রিতে পাঠিয়ে ধোয়ামোছা-ইস্ত্রি ইত্যাদি করত। এর পাশাপাশি বাসায় থাকলেই ও নেশাগ্রস্তের মতো ঘর ঝাড়ামোছা করত, আর রান্না করত। আমার পূর্বের অভিজ্ঞতা সূত্রে টের পাচ্ছিলাম, এ সবই দশ নম্বর বিপদ সংকেতের লক্ষণ। একজন নারী যখনই এরকম আচরণ করা শুরু করে, তখন তাকে ডেট করা পুরুষের জন্য স্রেফ দুটো পথ খোলা থাকে : এক, যত শীঘ্র সম্ভব সেই নারী থেকে দূরে ভাগা; দুই, সে নারীকে বিয়ে করে ফেলা।

তারপর একদিন সে আমাকে ছেলেটার ছবি দেখাল। সে আরেক বিপজ্জনক লক্ষণ। এ কাজ সে জীবনে কখনোই করেনি আগে।

আসলে সে আমাকে দুটো ছবি দেখিয়েছিল। তার একটা ছিল সানফ্রান্সিসকোতে এক মৎস্যজীবীর জেটিতে তোলা। হাতে একখানা সোর্ডফিশ বা ছুরিমাছ ঝুলিয়ে আমার বোন ঐ কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারকে সঙ্গে করে দাঁড়িয়েছিল আকর্ণবিস্তৃত হাসি মুখে ঝুলিয়ে।

“সুন্দর তো মাছটা,” আমি বলেছিলাম।

“মশকরা কোরো না। আমি সিরিয়াস।”

“তা আমার আসলে কী বলা উচিত?”

“কিছু বলার প্রয়োজন নেই। আমি এই ছেলেটার কথাই বলছিলাম।”

আমি পুনরায় ছবিটার দিকে তাকিয়ে ছেলেটার চেহারা দেখলাম। যদি দুনিয়ায় মানুষের চেহারাছবির একটাও মাত্র ধাঁচ থাকে, যা দেখামাত্র আপনার পিত্তি জ্বলে উঠবে, তবে ছেলেটার থোবড়া হলো সেই ধাঁচের। আরও বিরক্তির বিষয় হলো, ছেলেটার চেহারা আমার হাই স্কুলের এক বড়লোক ফ্যামিলির ছেলের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যার মাথায় ঘিলু বলতে কিছু ছিল না, কিন্তু ওর পুরো শরীর থেকে ফুটানি ঝরে পড়ত ক্রমাগত। শালার স্মৃতিশক্তি ছিল হাতির মতো; একবার যদি ওর সঙ্গে কারও কোনো খুটখাট বেঁধে যায় তো ও সেই গ্যাঞ্জাম আর কখনোই মিটাত না। ওর ঘিলুর অভাব খোদা মিটিয়েছিলেন অবিস্মরণীয় স্মৃতিশক্তি দিয়ে।

“কতবার ওর সঙ্গে ওর ফ্ল্যাটে গিয়েছ?” আমি প্রশ্ন করলাম।

“গাধার মতো কথা বোলো না,” আমার বোনের শব্দচয়নে বিরক্তি, কিন্তু চেহারা লাজরাঙা। “নিজের মাপকাঠিতে পুরো দুনিয়া বিচার করা উচিত নয় তোমার। সবাই তোমার মতো না, এটা তোমার বোঝা উচিত।”

দ্বিতীয় ছবিটা ওদের আমেরিকা ট্যুরের পরে তোলা। ওতে কেবল সেই কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারই ছিল। তার পরনে ছিল একটা চামড়ার জ্যাকেট, সে খানিকটা ঝুঁকে দাঁড়িয়েছিল বড় একটা মোটরসাইকেলের সঙ্গে হেলান দিয়ে। তার হেলমেট রাখা ছিল মোটরসাইকেলের সিটের ওপর। সানফ্রান্সিসকোর ছবিটায় তার যে অভিব্যক্তি, এই ছবিতেও তার হুবহু একই অভিব্যক্তি। হয়তো ওর চেহারায় এটা ছাড়া আর কোনো অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে না কখনো।

“মোটরসাইকেল ওর খুব পছন্দ,” আমার বোন বলে।

“বিষয় হচ্ছে, শুধুমাত্র ছবিটা তোলার জন্য ওর ঐ চামড়ার জ্যাকেট শরীরে চাপানোর কোনো যুক্তি নেই।”

হয়তো এটাও আমার সংকীর্ণ মানসিকতার পরিচায়ক, কিন্তু আমি মোটরসাইকেল নিয়ে মাতামাতি যাদের বেশি—তাদের দুচোখে দেখতে পারি না। আত্মতৃপ্তিতে ডুবে থাকা ঐ বাইকাররা এমনিতেই শো-অফ করতে বেশি পছন্দ করে। আমি আর কথা না বাড়িয়ে ছবিগুলো ফিরিয়ে দিই ওকে।

“আচ্ছা, ঠিক আছে,” আমি বলি।

“আচ্ছা ঠিক আছে, মানে কী?”

“আচ্ছা ঠিক আছে, মানে, এরপর কী?”

“জানি না। আমরা বিয়ে করতে পারি হয়তো।”

“ছেলেটা প্রস্তাব দিয়েছে তোমাকে?”

“বলা যায়। তবে আমি এখনও কোনো উত্তর দিইনি।”
“আচ্ছা।”

“আসলে আমি এটাই নিশ্চিত না যে, আমি আদৌ বিয়ে করতে চাই কি না। মাত্রই চাকরিতে ঢুকলাম। আমি চাইছিলাম এখনই নিজের ওপর এই ধরনের চাপ না নিয়ে, জীবনটাকে আরও একটু উপভোগ করতে। অবশ্য উপভোগ করা বলতে তোমার মতো উচ্ছন্নে যাওয়া বোঝাচ্ছি না...”
“বুঝতে পারছি। তোমার চিন্তা ঠিক লাইনেই আছে,” আমি ওর সঙ্গে সহমত জ্ঞাপন করলাম।

“কিন্তু ছেলেটা খুবই ভালো, এটাই আমাকে দ্বিধায় ফেলে দিয়েছে। কখনো কখনো ইচ্ছে হয় যে ওকে বিয়ে করে ফেলি। কঠিন একটা পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে যাচ্ছি।”

আমি আবারও ওর হাত থেকে ছবিদুটো তুলে নিয়ে দেখলাম। এবারের দীর্ঘশ্বাসটা অবশ্য ভেতরেই গিলে ফেললাম।

এক ক্রিসমাসের আগে আমার বোনের সঙ্গে এই কথোপকথন হয়েছিল আমার। নতুন বছর শুরু হবার পর আমার মা একদিন আমাকে সকাল ৯টায় ফোন করলেন। আমি তখন ব্রুস স্প্রিংস্টিনের ‘বর্ণ ইন দ্য ইউএসএ’ শুনতে শুনতে দাঁত মাজছিলাম।

মা জিজ্ঞেস করলেন, আমার বোন যেই ছেলেটাকে ডেট করছে, আমি তাকে চিনি কি না।

আমি বললাম, না।

মা জানালেন, আমার বোন তাকে চিঠি লিখে জানতে চেয়েছে যে, এই শনিবারের দুসপ্তাহ পর সে ছেলেটাকে নিয়ে আমাদের পৈতৃক নিবাসে বেড়াতে আসতে পারে কি না।

“আমার মনে হয় ও ছেলেটাকে বিয়ে করবে বলে ঠিক করেছে,” আমি বলি।

“আর এ কারণেই আমি তোমার কাছ থেকে ছেলেটার ব্যাপারে কিছু খবর জানতে চাইছি। ওর সঙ্গে সামনাসামনি দেখা করবার আগে ওর ব্যাপারে কিছু জানা থাকা দরকার আমার।”

“কথা হচ্ছে, ছেলেটার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি কখনো। ও তোমার মেয়ের চেয়ে বয়সে এক বছরের বড়, পেশায় কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। তিন বর্ণের নামের কী একটা কোম্পানিতে যেন চাকরি করে, আইবিএম, বা এনইসি, অথবা টিএনটি, এরকম কিছু হবে। আমি ওর ছবি দেখেছি। তেমন আহামরি কিছু নয় দেখতে। আমার তেমন একটা পছন্দ হয়নি, অবশ্য ওকে তো আর আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি না।”

“ওর পড়াশোনা কোথায়? বাড়ি আছে নিজের?”

“তা আমি কীভাবে জানব?”

“তুমি একবার ওর সঙ্গে দেখা করে বিষয়গুলো জেনে নিচ্ছ না কেন?”

“একদমই সম্ভব না। আমি ব্যস্ত খুব। দুসপ্তাহ পর যখন তোমার সঙ্গে দেখা হবে, তখন তুমি নিজেই জেনে নিও।”

এমতাবস্থায় আমার পক্ষে আমার বোনের কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে দেখা না করে আর উপায় ছিল না। পরবর্তী রোববার সে ছেলেটার পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে যাবে, চাইছিল আমি যেন ওর সঙ্গে যাই। আমি একটা সাদা শার্টের সঙ্গে টাই পরে, ওপরে একদম গতানুগতিক রং আর ডিজাইনের একটা স্যুট পরলাম। মেগুরো নামের এক আবাসিক প্রকল্প টাইপ এলাকার মাঝখানে তাদের নয়নাভিরাম বাড়ি। পাঁচশ সিসির হোন্ডা, যেটা ছবিতে দেখেছিলাম, ওটা গ্যারেজের সামনেই পার্ক করে রাখা ছিল।

“ছবির মাছটা সুন্দর ছিল।”

“দোহাই লাগে,” আমার বোন বলে, “তোমার অদ্ভুতুড়ে রসিকতাগুলো করবে না এখন একদম। স্রেফ একদিনের জন্য নিজেকে সামলে রাখো—এতটুকুই চাওয়া আমার তোমার কাছে।”

“জি, ম্যাডাম!”

ছেলেটার বাবা-মা ভালোই ছিল, বেশ গোছাল। মানে, একটু বেশিই গোছাল সম্ভবত। ওর বাবা ছিল এক অয়েল কোম্পানির কর্মকর্তা। আমাদের বাবাও যেহেতু শেইজুওকার একটা গ্যাস স্টেশন চেইনের মালিক, কাজেই আমাদের ব্যাকগ্রাউন্ড মোটামুটি মিলে যায়। খুবই সুন্দর একটা ট্রেতে করে ওর মা আমাদের চা পরিবেশন করলেন।

আমি ছেলের বাবাকে আমার ভিজিটিং কার্ড দিলে বিনিময়ে তিনিও আমাকে তার ভিজিটিং কার্ড দিলেন। তারপর, আমি আমার সর্বোচ্চ ভাষাগত দক্ষতা প্রদর্শন করে গুছিয়ে তাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে আমি আমাদের বাবা-মার প্রতিনিধি হিসেবে এসেছি আজকে এখানে, তারা দুর্ভাগ্যজনকভাবে আজ এই দাওয়াত গ্রহণ করতে পারেননি; আগে থেকেই ঠিক করা কিছু কাজ ছিল তাদের, তাই।  তারা আশা করেন, সামনেই উভয়পক্ষের সম্মতিক্রমে আর একটি দিন ঠিক করে তারা এসে ছেলেমেয়ে দুজনকে আশীর্বাদ করে যাবেন।

ভদ্রলোক বললেন, তাদের ছেলের মুখে আমার বোনের ব্যাপারে তারা অনেক কথা শুনেছেন, সামনাসামনি দেখা হওয়ার পর ওকে তাদের আরও অনেক সুন্দর লেগেছে। এত সুন্দর একটা মেয়েকে তাদের ছেলে কোনোদিন খুঁজে বের করতে পারবে—এমনটা তাদের ধারণা ছিল না। তিনি আরও বললেন যে আমাদের সচ্ছল পারিবারিক অবস্থার ব্যাপারে তাদের মোটামুটি জানাশোনা আছে, এবং ‘বর্তমানের এই আলাপচারিতা’ চালিয়ে যেতে তাদের দিক থেকেও কোনো আপত্তি নেই। ওনার কথা শুনে আমি বুঝলাম যে আমাদের পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে ভদ্রলোক এবং তার পরিবার যথেষ্ট গবেষণা করেছে, কিন্তু তাদের গবেষণা অন্তত এটা বের করে আনার মতো গভীরতায় পৌঁছায়নি যে আমার বোনের বয়স ষোলোতে পৌঁছাবার আগে তার পিরিয়ড শুরু হয়নি, অথবা ওর যে দীর্ঘদিনের কোষ্ঠকাঠিন্য আছে।

কোনো রকম ঝুটঝামেলা ছাড়াই সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা শেষ হবার পর ছেলেটার বাবা আমার গ্লাসে বেশ ভালো কোম্পানির ব্রান্ডি ঢেলে দিলেন। গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে আমরা চাকরিবাকরি এরকম আরও নানা হাবিজাবি নিয়ে কথা বলতে থাকলাম। আমার বোন অবশ্য টেবিলের নিচে ওর ঠ্যাং দিয়ে ক্রমাগত গুঁতো দিয়ে দিয়ে স্মরণ করিয়ে দিতে থাকল—যেন আমি বেশি পান না করে ফেলি।

কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার কিন্তু মুখে একদম কুলুপ এঁটে বসে রইল। বিনা বাক্য ব্যয়ে, চিন্তিত চেহারায় সারাটাক্ষণ বসে রইল ওর বাবার পাশে। ওর চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল যে যতক্ষণ ও এই বাসায় থাকে, তখন ওর বাবাই ওর সুতো নাড়ে পেছন থেকে। ও যেই সোয়েটারটা পরে ছিল, এরকম অদ্ভুত ডিজাইনের সোয়েটার আমি আমার জীবনে দেখিনি। সোয়েটারের রঙের সঙ্গেও শার্টের রং মিলছিল না মোটেই। ওর মতো একটা ভোঁতা ছেলেকেই আমার বোনের বেছে নিতে হলো জীবনসঙ্গী হিসেবে?

বেলা ৪টা নাগাদ আমাদের আর বলবার মতো কোনো কথা বাকি ছিল না, কাজেই আমরা চলে যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালাম। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার আমাদের স্টেশন পর্যন্ত সঙ্গ দিল। একদম শেষ মুহূর্তে জিজ্ঞেস করল—“এক কাপ চা খাওয়া যায় কি?” আমার চা খাওয়ার কোনো ইচ্ছেই ছিল না, বিশেষ করে এমন উদ্ভট রঙের সোয়েটার পরে ঘোরে যে মানুষ, তার সঙ্গে এক টেবিলে বসার আগ্রহও আমার ছিল না। এখন এসব কথা তো আর মুখের ওপর বলা যায় না, কাজেই আমরা তিনজন মিলে কাছেধারের একটা কফিহাউজে গিয়ে বসলাম।

“আজকে আসবার জন্য অনেক ধন্যবাদ,” সে বলল। “ধন্যবাদ আমাদের সাহায্য করবার জন্য।”

“পরিবার থেকে আমাকে যা করতে বলা হয়েছে, আমি তাই করেছি,” সোজাসাপটাভাবে বললাম। “ধন্যবাদ দেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।” খুব সাজিয়ে গুছিয়ে সুন্দরভাবে কথা বলার মতো আমার আর ধৈর্য বাকি ছিল না।

“ওর কাছ থেকে আপনার ব্যাপারে অনেক কিছু শুনেছি—ভাই।”
ভাই!

আমি কফি নাড়াবার চামচের পেছন দিক দিয়ে আমার কান খোঁচালাম কিছুক্ষণ, তারপর আবারও তা রেখে দিলাম আগের জায়গায়। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমার বোন টেবিলের নিচে আমাকে সজোরে লাথি মারল, কিন্তু কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার এসব কিছুর মানে বুঝল বলে মনে হয় না। হয়তো ও কেবল ০ আর ১ এর বাইনারি ছাড়া কোনো রসিকতা বোঝেও না।

“আপনারা দুজন এত ঘনিষ্ঠ যে আমার ঈর্ষা হয়,” সে বলে।

“আমরা যখনই খুশি থাকি, তখন একে অপরকে লাথি মারি,” আমি বললাম।

আমার কথা শুনে ওর মুখে চিন্তার ছায়া পড়ল।

“ও রসিকতা করবার চেষ্টা করছে,” আমার বোন মধ্যখানে ঢুকে পড়ল। “ও বেশিরভাগ সময় এভাবেই কথা বলে।”

“সেটাই সেটাই, রসিকতা ছিল শেষ কথাটা।” আমি যুক্ত করলাম। “ঘরের কাজকর্মও আমাদের ভাগ করা। ও লন্ড্রিটা দেখে, আর আমি নিত্যনতুন জোক বানানোর কাজটা করি যত্ন নিয়ে।”

নবরু ওয়াতানাবি নামের সে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার সবশুনে মৃদু হাসল, যেন প্রয়োজনীয় এক ধাঁধার সমাধানে সে পৌঁছাতে পেরেছে অবশেষে।

“আপনারা দুজনেই সবসময় উচ্ছল, প্রাণবন্ত,” সে আবারও বলে। “আমিও এরকম ঘরই চাই; উচ্ছল, প্রাণবন্ত।”

“দেখেছ?” আমি আমার বোনকে বলি, “সবাই উচ্ছল আর প্রাণবন্ত থাকাটাই পছন্দ করে। তোমার মতো গোমড়া হয়ে বসে থাকা নয়।”

“তোমার রসিকতাগুলো হাস্যকর না হলে আমি তো জোর করে হাসতে পারব না।” সে বলে।

“সম্ভব হলে আমরা এই শরতেই বিয়ে করতে চাই,” নবরু ওয়াতানাবি বলল।

“আরে শরৎকালই তো বিয়ে করার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময়,” বললাম আমি। “একই সঙ্গে স্কোয়ারেল আর ভালুকদের দাওয়াত করা যাবে।”

ছেলেটা হাসলেও মেয়েটা হাসল না। আমার বোনকে দেখে মনে হচ্ছিল ও ভেতরে ভেতরে ক্ষেপে আগুন হয়ে আছে। কাজেই আমি শীঘ্রই ওদের দুজনকে একা ছেড়ে বেরিয়ে আসি সেই রেস্তোরাঁ থেকে।

বাসায় ফিরে এসে আমি আমার মাকে ফোন করে পুরো সেদিনের ঘটনার সারাংশ জানাই।

“ছেলেটা খুব একটা খারাপ না,” আমি আমার কান চুলকাতে চুলকাতে বলি।

“এই কথার কী অর্থ?” মা প্রশ্ন করে।

“সে জীবন নিয়ে খুব সিরিয়াস। অন্তত আমার থেকে অনেক বেশি সিরিয়াস।”

“কিন্তু তোমার তো নিজের জীবন নিয়ে কোনো চিন্তাভাবনাই নেই।”

“কথাটা আমাকে মনে করিয়ে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ মা,” রুমের ছাদের দিকে তাকিয়ে বলি আমি।

“ও গ্রাজুয়েশন শেষ করেছে কোথায়?”

“হ্যাঁ?”

“কোন কলেজে পড়াশোনা করেছে ও?”

“দেখা হলে নিজে জিজ্ঞেস করে নিও,” এই বলে আমি ফোন রেখে দিলাম। এই ঘটনাপরম্পরা আমাকে অসুস্থ করে তুলছে। ফ্রিজ থেকে বিয়ারের একটা বোতল বের করে আমি একাকী বসে তাতে চুমুক দিতে থাকলাম।

স্প্যাগেটি নিয়ে আমার বোনের সঙ্গে গ্যাঞ্জামের পরদিন আমি ঘুম থেকে উঠলাম সকাল সাড়ে আটটায়। গতদিনের মতোই সুন্দর, মেঘমুক্ত একটা দিন ছিল এদিনটাও। বরং, এ যেন ছিল গতদিনেরই ধারাবাহিকতা, এবং আমার জীবন যেন পুনরায় শুরু হলো, এক অর্ধবিরতির পর।

আমি আমার ঘামে ভেজা পাজামা ব্যবহৃত কাপড়ের ঝুড়ির মধ্যে ফেলে গোসল করলাম প্রথমে, তারপর দাড়ি কামালাম। দাড়ি কামাতে কামাতে আমার গতদিনের সেই মেয়েটার কথা মনে পড়ে গেল, যাকে আমি গতরাতে পেলাম না নিজের মতো করে। ওহ, ভাগ্যেই ছিল না আসলে ব্যাপারটা। আমি তো নিজের দিক থেকে পুরো চেষ্টাটাই করেছিলাম। সামনে অবশ্য আরও সুযোগ আছে। সামনে বলতে পরের রোববারই তো আবার দেখা হওয়ার কথা আমাদের।

আমি দুটো পাউরুটির স্লাইস টোস্ট করলাম, কফি গরম করলাম একই সঙ্গে। এফএম রেডিও শুনতে মন চাইছিল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে স্মরণে এলো আমার স্টেরিও নষ্ট। কাজেই, তার বদলে আমি বসে বসে পত্রিকার বুক রিভিউ সেকশন পড়তে পড়তে টোস্ট করা পাউরুটি দুটো খেলাম। রিভিউ করা বইগুলোর একটার বিষয়বস্তুও আমার পছন্দ হলো না : একটা উপন্যাস, যার বিষয়বস্তু : ‘বাস্তবতা এবং কল্পনার সংমিশ্রণে এক বৃদ্ধ ইহুদির যৌনজীবন’, এছাড়াও ছিল স্কিজোফ্রেনিয়ার ঐতিহাসিক অধ্যয়ন, ও ১৯০৭ সালের ‘আশিও কপারমাইন’ দূষণের ওপর বিস্তারিত প্রতিবেদন—এরকম আরও দুটো বই। এর চেয়ে কোনো মেয়েদের সফটবল টিমের ক্যাপ্টেনের সঙ্গে বিছানা শেয়ার করতে আরও অনেক ভালো লাগবে আমার। পত্রপত্রিকাগুলো এই ধরনের বইপত্রের রিভিউ ছাপায়, সম্ভবত আমাদের বিরক্তি বাড়ানোর জন্যে।

টোস্ট চিবুতে চিবুতে আমি সংবাদপত্রটা টেবিলের ওপর বিছিয়ে রাখলাম; তারপর আমি জ্যামের বোতলের নিচে একটা চিরকুট খুঁজে পেলাম। আমার ছোটবোনের গুঁড়ি গুঁড়ি হস্তলিপিতে লেখা আছে, সে এই রোববার নবরু ওয়াতানাবিকে ডিনার করবার জন্য নিমন্ত্রণ জানিয়েছে আমাদের ফ্ল্যাটে, এবং আমার বোন চায় যাতে আমি তাদের সঙ্গ দিই।

খাওয়া শেষ করে আমি আমার শার্টের ওপর পড়ে থাকা টোস্টের গুঁড়োগুলো ঝেড়ে ফেললাম প্রথমে, তারপর বাসন তুলে নিয়ে রাখলাম রান্নাঘরের সিঙ্কের ওপর। তারপর আমি আমার বোনের ট্রাভেল এজেন্সিতে ফোন করলাম। আমার বোনই ফোনটা ধরে বলল, “এখন কথা বলতে পারব না। দশ মিনিট পর ফোন করছি।”

ফোন করতে ওর বিশ মিনিট লেগে গেল। এই ফাঁকে আমি তেতাল্লিশটা বুকডন দিয়ে ফেলেছি, আমার হাত-পায়ের বিশটি আঙুলের নখ ছেঁটেছি, আজকের দিনে পরবার মতো জামাকাপড়ও বাছাই করে ফেলেছি, দাঁত মেজে, চুল আঁচড়ে সর্বমোট দুবার বিশাল বিশাল হাই তুলেছি।

“আমার চিরকুটটা দেখেছ?” ও প্রশ্ন করল।

“হ্যাঁ। কিন্তু দুঃখিত, এই রোববার আমার ডেট আছে। অনেক আগেই তা ঠিক করা। জানলে দিনটা খালি রাখতাম। কিন্তু এখন আর সম্ভব না।”

“তুমি আমাকে এই গুলতানি বিশ্বাস করতে বলছ? আমি জানি তুমি কী করবে সেদিন : যেকোনো এক জায়গায় গিয়ে নামও জানো না এমন একটা মেয়েকে খুঁজে বের করবে সময় কাটানোর জন্য। এই কাজটা এমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। চাইলে রোববারের বদলে শনিবারও করতে পারো।”

“শনিবারে আমার সারা দিন স্টুডিওতে কাটবে, একটা বৈদ্যুতিক কম্বল কোম্পানির বিজ্ঞাপনের শুটিংয়ে। আমরা খুব ব্যস্ত ইদানীং।”

“তাহলে তোমার ডেট বাতিল করে দাও।”

“সম্ভব না। ডেট ক্যানসেল করার ফি আছে মেয়েটার। এছাড়াও, ওর সঙ্গে সম্পর্কের একদম প্রাথমিক অবস্থা চলছে এখন আমার।”

“আমার সঙ্গে সম্পর্কের কোনো মূল্য নেই তোমার?”

“বিষয়টা অমন না আসলে,” চেয়ারের পেছনে ঝুলিয়ে রাখা শার্টের সঙ্গে নেকটাইটা ধরে আমি কথা বলতে থাকি। “কিন্তু তোমার আমাদের ঐ নিয়মটা ভুলে যাওয়া চলবে না : আমরা একে অপরের ব্যক্তিগত জীবনযাপনের স্টাইলে হস্তক্ষেপ করব না কখনো। তুমি তোমার বাগদত্তার সঙ্গে ডিনার করবে, আমি আমার গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে ডেটে থাকব। সমস্যা কী এতে?”

“তুমি নিজেও জানো সমস্যাটা কোথায়। কতদিন হয়ে গেল ওর সঙ্গে তোমার শেষ দেখা হবার, মনে আছে? একবার মাত্র দেখা হয়েছে তোমাদের দুজনের, তাও চার মাস আগে। এটা একদম ঠিক হচ্ছে না। আমি তোমাদের দুজনের একটা সাক্ষাতের উপলক্ষ্য তৈরি করা মাত্রই তুমি দৌড়ে পালাও। তুমি কি বুঝতে পারছ না যে তুমি খুব অসৌজন্যতামূলক আচরণ করছ? সে তোমার একমাত্র বোনের বাগদত্তা। তার সঙ্গে একবার ডিনার করলে তুমি কি মারা যাবে?”

ওর কথায় যুক্তি আছে, কাজেই আমি চুপ হয়ে গেলাম। এটা সত্য যে আমি ছেলেটার সঙ্গে পুনরায় সাক্ষাতের সুযোগ এড়িয়ে চলছি, তবে আমার কাছে এটাই দুনিয়ার সবচেয়ে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া বলে মনে হয়। আমাদের দুজনের পছন্দের কোনো সাধারণ বিষয় নেই, আর আমি যেই জোকসই ওকে বলার চেষ্টা করি, আমার বোনের তর্জমা ছাড়া ও কিছু বোঝে না।

“তুমি দয়া করে এই একবার আমাদের সময় দাও। এতটুকু যদি এবারের মতো করতে পারো আমার জন্যে, তবে আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, সামনের গ্রীষ্মকালের আগ পর্যন্ত তোমার সেক্স লাইফে আমি আর বাগড়া দেব না।”

“এই মুহূর্তে এমনিতেই আমার সেক্স লাইফের অবস্থা খুব করুণ। এখন ঠিকঠাকমতো সম্পর্কের পিছে সময় না দিলে সামনের গ্রীষ্মকালে আমার করার মতো কিছু থাকবে না।”

“যা হোক, এই রোববার তুমি আমাদের সঙ্গে ডিনার করছ, কথা দিচ্ছ তো আমাকে?”

“না বলার উপায় রেখেছ আমার জন্য?”

“তুমি চাইলে ও আমাদের ঘরের নষ্ট স্টেরিওটাও ঠিক করে দিতে পারে। এসব কাজে ও ভালোই দক্ষ।”

“হস্তশিল্পে দারুণদক্ষ দেখা যাচ্ছে...”

“তুমি আর তোমার নোংরা মন,” এই বলে ও উলটো পাশ থেকে ফোন কেটে দিল।

আমি নেকটাই লাগিয়ে অফিসে বেরিয়ে পড়লাম।

পুরো সপ্তাহ জুড়েই আবহাওয়া পরিষ্কার ছিল। প্রতিটি দিনই ছিল তার পূর্ববর্তী দিনের অনুবর্তী। বুধবার রাতে আমি আমার গার্লফ্রেন্ডকে ফোন করে বলি, এই রোববার রাতে আমাদের ডেটে যাওয়া হচ্ছে না। সে যথেষ্ট যৌক্তিকভাবেই বিরক্ত হলো : প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে আমাদের দেখা হচ্ছে না। রিসিভার হাতে ধরে রেখেই আমি ঐ কলেজের মেয়েকে ফোন দিলাম, কিন্তু পেলাম না। পরবর্তী বৃহস্পতিবার এবং শুক্রবারও ওকে ফোনে পেলাম না আর।

আমার বোন আমাকে রোববার দিন ঠিক সকাল আটটায় ঘুম থেকে উঠিয়ে দিল। “উঠে পড়ো, উঠে পড়ো! আমার বিছানার চাদর বদলানো লাগবে।”

সে প্রায় একটানে বিছানার চাদর, বালিশের কভার বদলে ফেলে। আমাকেও বলে ঘুমানোর পায়জামা পালটে ভালো পোশাকাদি পরতে। অতঃপর যে জায়গায় আমি দাড়ি কামাই আর গোসল করি, অর্থাৎ বাথরুম ছাড়া আমার আর আশ্রয় নেবার মতো কোনো জায়গা বাকি ছিল না। দিনে দিনে মেয়েটা ক্রমশ আমাদের মায়ের মতো হয়ে উঠছে। মেয়েরা সবাই স্যালমন মাছের মতো, দিনের শেষে সাঁতারে সবাই ঐ একই গন্তব্যে ফিরে আসে।

গোসল শেষে আমি বক্সারের ওপর একটা গেঞ্জি পরে বের হলাম বাথরুম থেকে। লম্বা লম্বা কয়েকটা হাই তুলতে তুলতে কমলার জুস খেলাম এক গেলাস। শরীরে তখনও গতরাতের অ্যালকোহলের প্রভাব কাজ করছিল, কাজেই রোববার সকালের পত্রিকা খুলে বসা সম্ভব ছিল না আমার জন্য এই মুহূর্তে। কিচেন টেবিলে রাখা কয়েক পিস বিস্কুট খেয়ে মনে হলো, আপাতত আমার আর সকালের নাশতা করার প্রয়োজন নেই।

ততক্ষণে আমার বোন বিছানার চাদর ওয়াশিং মেশিনে চালান করে দিয়ে দুটো কামরাই গুছিয়ে এনেছে। এরপর সে সাবান গোলানো পানি দিয়ে বসবার ঘর আর রান্নাঘরের মেঝে আর দেয়াল ঘষে ঘষে পরিষ্কার করা আরম্ভ করল। এই ফাঁকে আমি সোফায় ঠ্যাঙের ওপর ঠ্যাঙ তুলে বসে আমার এক বন্ধুর আমেরিকা থেকে পাঠানো ‘হাসলার’ নামে এক প্রাপ্তবয়স্কদের পত্রিকার পাতায় নগ্ন নারীদের ছবি দেখছিলাম। মেয়েদের যৌনাঙ্গের গড়ন, আকৃতির এত ভিন্নতা আমাকে বরাবরই বিমোহিত করে। যৌনাঙ্গের এই বিভিন্নতা অনেকটা মানুষের আইকিউর পার্থক্যের মতোই।

“এইভাবে বসে না থেকে আমাকে কিছু কেনাকাটা করে দিয়ে সাহায্য করো।” এই বলে আমার বোন আমাকে একটা লম্বা জিনিসপত্রের লিস্টি ধরিয়ে দেয়। “আর দয়া করে এই নোংরা ম্যাগাজিন সরিয়ে রাখো এখান থেকে। ও এগুলো এভাবে পড়ে থাকতে দেখলে ভিরমি খাবে।”

আমি ম্যাগাজিন নামিয়ে রেখে ওর ধরিয়ে দেয়া ফর্দর দিকে তাকালাম। লেটুস পাতা, টমেটো, আলু, পেঁয়াজসহ আরও নানা জাতের সবজি, দই, স্মোকড স্যালমন মাছ, স্যুপ স্টক, বিফ স্টেক—এই সব হাবিজাবি লেখা আছে তাতে।

“স্টেক আবার? গতকাল রাতেই না খেলাম এটা? ম্যাশড পটেটো, আর মাছ ভর্তা একসঙ্গে ভেজে কী একটা বানায় না, ক্রিউকেট বলে যেটাকে—ওটা বানাও না হয় আজকে?”

“তুমি হয়তো গতরাতে স্টেক খেয়েছ, কিন্তু আমরা তো খাইনি। এরকম স্বার্থপরের মতো কথা বোলো না। ডিনারের জন্য একজন অতিথিকে নিমন্ত্রণ করে ক্রিউকেট খাওয়ানো যায় না।”

“আমাকে যদি কোনো মেয়ে তার বাসায় ডিনারের জন্য দাওয়াত করে গরম গরম ক্রিউকেট ভেজে খাওয়াত, আমার আর কিছু লাগত না। সঙ্গে দু-একটা সবজির আইটেম, এক বাটি মিসো ক্লাম স্যুপ...আহা, আর কী লাগে জীবনে।”

“হতে পারে, কিন্তু আমি স্টেক বানানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। অন্য একদিন আমি তোমাকে গলা পর্যন্ত ভরে খাওয়ার মতো ক্রিউকেট বানিয়ে দেব। কিন্তু আজকে দয়া করে স্টেক দিয়ে চালিয়ে নাও।”

“ঠিক আছে,” আমি তাকে আশ্বাস দিয়ে বললাম। যদিও সময়ে সময়ে আমি মানুষকে ভীষণ জ্বালাযন্ত্রণা দিই, কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমি বরাবরই একজন দয়ালু হৃদয়ের সমঝদার মানুষ।

আমি আমাদের মহল্লারই এক সুপারমার্কেটে গিয়ে ফর্দে থাকা সমস্ত তরিতরকারি, বাজারসদাই কিনে নিয়ে এলাম। ফিরে আসার পথে আমি একটা মদ্যশালায় থেমে সাড়ে চার হাজার ইয়েন দামের একটা শ্যাবিলসের বোতল কিনলাম, নবীন দম্পতির জন্য আমার উপহার হিসেবে। শুধুমাত্র এক নরম হৃদয়ের, সমঝদার মানুষের পক্ষেই যেমনটা করা সম্ভব।

বাসায় ফিরে দেখলাম আমার জন্য একটা নীল রঙের রালফ লরেন পোলো শার্ট আর নতুন একটা কটনের প্যান্ট একদম নিখুঁতভাবে ভাঁজ করে রেখে দেয়া আছে বিছানার ওপর।

“এগুলো পরে নাও,” আমার বোন বলল।

আবারও একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে রেখে, আমি ওর কথা অনুসরণ করলাম। সত্যি বলতে, ওকে এখন আর যাই বলি না কেন, আজকের দিনটাকে আর কোনোভাবেই আমার আকাঙ্ক্ষিত শান্তিময় ছুটির দিনে পরিণত করা সম্ভব হবে না।

নবরু ওয়াতানাবি এসে হাজির হলো তিনটা বাজে। বসন্তকালের প্রশান্ত বাতাসের মতো হাওয়া ছড়িয়ে তার মোটরবাইক এসে দাঁড়াল আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের সামনে। আমি অবশ্য ওর ৫০০ সিসি হোন্ডার ভটভট আওয়াজ শুনতে পেয়েছি প্রায় আড়াইশ মিটার দূরে থাকতেই। বারান্দায় উঁকি দিয়ে দেখলাম, আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের প্রবেশদ্বারের সামনে বাইক রেখে ওর হেলমেট খোলার দৃশ্য। সৌভাগ্যবশত, এসটিপি স্টিকার লাগানো সাদারঙের ঐ হেলমেটটা খুলে রাখার পর দেখা গেল, আজকে ওর পোশাকআশাক অনেকটাই মানুষের মতো। ঢিলেঢালা বাটন ডাউন একটা চেক শার্ট, ঢোলা সাদারঙের প্যান্ট, সঙ্গে ট্যাসলস লাগানো বাদামি রঙের একজোড়া লোফার ছিল ওর পায়ে। অবশ্য জুতার সঙ্গে ওর বেল্টের রং ম্যাচ করছিল না, যাক কী আর করা।

“আমার মনে হয় তোমার মাছ চাষের খামারে খুঁজে পাওয়া বন্ধু এসে হাজির হয়েছে,” আমি আমার বোনকে সুসংবাদটা দিলাম। ও তখন কিচেনের সিঙ্কে আলু কুঁচি কুঁচি করে কাটছিল।

“দয়া করে ওকে একটু সঙ্গ দাও? আমি এই ফাঁকে এখানকার কাজগুলো একটু গুছিয়ে ফেলি।”

“উঁহু, সম্ভব না। ওর সঙ্গে কথা বলার মতো কোনো বিষয় আমার জানা নেই। আমি বরং তোমার কাজ করি, তুমি গিয়ে ওকে সঙ্গ দাও।”

“বোকার মতো কথা বোলো না। তোমাকে রান্নাঘরে রেখে আমার ওর সঙ্গে সময় কাটানোটা ভালো দেখাবে না। তুমি গিয়ে কথা বলো ওর সঙ্গে।”

ডোরবেল বেজে উঠলে আমি গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। ওপাশে দাঁড়ানো নবরু ওয়াতানাবি। আমি তাকে সঙ্গে করে বসার ঘরে নিয়ে এসে বসবার জন্য একটা সোফা দেখিয়ে দিলাম। সে আজকের সন্ধ্যার উপহার হিসেবে নিয়ে এসেছিল বাস্কিন-রবিনসের একত্রিশ রকমের ফ্লেভারসের একটা আইসক্রিম-প্যাক। আমাদের ইতোমধ্যে বোঝাই হয়ে থাকা রেফ্রিজারেটরে সেটা ঠেলে ঢোকাতে বেশ কষ্টই হলো আমার। কী যে এক যন্ত্রণা! দুনিয়ায় এত কিছু থাকতে ওকে আইসক্রিমই কেন আনা লাগল? তাও এতগুলো!

“বিয়ার চলবে?”

“না, ধন্যবাদ। আমার মনে হয় অ্যালকোহলে অ্যালার্জি আছে। একগ্লাস কোনো রকমে ভেতরে ঢুকলেই অসুস্থ হয়ে যাই।”

“আমি একবার আমার কলেজ বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে ওয়াশ বেসিন ভরা বিয়ার খেয়ে ফেলেছিলাম একটানে।”

“তারপর আপনার কী অবস্থা হয়েছিল?”

“আমার প্রস্রাবে এরপর টানা দুদিন বিয়ারের গন্ধ ছিল। আর আমার ঢেঁকুরের সঙ্গে ঐ...”

“তুমি নবরুকে তোমার স্টেরিও সেটটা দেখাচ্ছ না কেন বরং?” গল্পের মাঝে আমার বোন মাথা ঢুকিয়ে দিল। যেন পোড়া কিছুর গন্ধ ওর নাকে যাওয়ায় একদম ঠিক সময়ে ছুটতে ছুটতে এসে হাজির হয়েছে হাতে দুগ্লাস অরেঞ্জ জুস নিয়ে।

“হ্যাঁ, এটা করা যায়,” নবরু বলে।

“শুনেছি আপনি হাতের কাজে বেশ দক্ষ,” আমি বললাম।

“তা ঠিক,” বিন্দুমাত্র লজ্জা না পেয়ে সে বলল। “আমি প্লাস্টিকের ছোট ছোট জিনিস তৈরিতে বা রেডিও সারাই করতে খুবই পছন্দ করি। ঘরে কিছু ভাঙলেও সেটা সারাই করা আমারই দায়িত্ব। যা হোক, আপনার স্টেরিওর কী হয়েছে?”

“কোনো শব্দ বেরুচ্ছে না,” আমি বললাম। তারপর অ্যাম্পটা চালু করে একটা রেকর্ড প্লেয়ার ছেড়ে দিয়ে তাকে দেখালাম।

সে লাফিয়ে উঠে স্টেরিওর ওপর ঝুঁকে পড়লে তাকে সংগমে লিপ্ত হয়ে বেঁকে থাকা একটা বেজির মতো দেখাচ্ছিল। সব সুইচ টিপেটুপে সে ঘোষণা করল, “সমস্যা অ্যামপ্লিফায়ারেরই, কিন্তু সমস্যাটা বাইরের কিছুতে না, বরং ভেতরে।”

“আপনি কীভাবে জানেন?”

“অনুমান করছি।”

হ্যাঁ, অনুমান করা ছাড়া আর কীই বা করতে পারে সে!

সে স্টেরিওর মিনি-প্রিঅ্যাম্প আর পাওয়ার অ্যামপ্লিফায়ারটা টেনে বের করে তাদের সঙ্গে লেগে থাকা সমস্ত তার খুলে ফেলল। তারপর দুটো যন্ত্র খুব যত্ন করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে লাগল। সে যখন এ সমস্ত কাজে ব্যস্ত আমি তখন রেফ্রিজারেটর থেকে বাড-ওয়েইসার বিয়ারের একটা ক্যান বের করে চুমুক দিতে থাকলাম।

“এভাবে মদ্যপান করার সক্ষমতা থাকাটা নিশ্চয়ই একটা উপভোগ্য ব্যপার?” সে একটা প্লাগকে মেকানিক্যাল পেনসিল দিয়ে খোঁচাতে খোঁচাতে আমাকে প্রশ্ন করে।

“কী জানি,” আমি বলি। “এত দিন ধরে আমার পান করার অভ্যেস যে, পান করা ছাড়া আসলে কেমন লাগে—সে অবস্থার সঙ্গে আমার বর্তমান অবস্থা তুলনা করা আমার পক্ষে সম্ভব না।”

“আমি একটু একটু করে অভ্যেস করছি।”

“কী? মদ্যপানের?”

“হ্যাঁ। কেন, শুনে অবাক লাগছে?”

“না, একদমই না। হোয়াইট ওয়াইন দিয়ে শুরু করতে পারেন। একটা বড় গ্লাসে বরফের সঙ্গে খানিকটা ওয়াইন ঢেলে তাতে প্যারিয়ের আর লেবুর রস দিন খানিকটা, ব্যস হয়ে গেল। আমি তো ফলের জুসের বদলে এটাই পান করি সবসময়।”

“চেষ্টা করে দেখব ভবিষ্যতে,” সে বললে। “আহা! যা আমি ভেবেছিলাম...”

“কী হলো?”

“প্রি অ্যাম্প আর পাওয়ার অ্যাম্পের মাঝখানে যে কর্ডটা আছে, তা দুই চ্যানেলেই ছিঁড়ে গেছে। এই ধরনের পিন প্লাগ আসলে বেশি নাড়াচাড়া সহ্য করতে পারে না। তাছাড়া এগুলো দামে খুব সস্তা। নিশ্চয়ই এই অ্যামপ্লিফায়ার ধরে কেউ নাড়াচাড়া দিয়েছে গত কয়েক দিনে?”

“ঐ দিন ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে আমিই ওটা নাড়িয়েছিলাম,” আমার বোন বলে।

“এটাই কারণ।”

আমার বোন আমার দিকে চোখ গরম করে তাকাল। “তোমার কোম্পানি থেকে কিনেছি এই জিনিস। এটা তোমার কোম্পানির দোষ। এরকম সস্তা পার্টস ব্যবহার করো কেন তোমরা বৈদ্যুতিক জিনিসপত্র নির্মাণে?”

“এখন, আমি তো আর বানাইনি এটা,” আমি আমতা আমতা করে বলি। “আমি তো কেবল বিজ্ঞাপনের দিকটা দেখি।”

“চিন্তার কোনো কারণ নেই। ঘরে এই মুহূর্তে একটা সোল্ডারিং আয়রন থাকলেই আমি এটা এখনই ঠিক করে দিতে পারি।” নবরু ওয়াতানাবি বলে।

“কিন্তু ঐ জিনিস তো ঘরে নেই এই মুহূর্তে।”

“সমস্যা নেই। আমি এখনই বাইরে গিয়ে কিনে আনছি একটা। তবে আপনাদের ঘরে অবশ্য একটা সোল্ডারিং আয়রন রাখা দরকার। খুব দরকারি একটা জিনিস।”

“তা ঠিক। কিন্তু আমাদের মহল্লায় কোনো হার্ডওয়ার স্টোর আছে কি না, তাও আসলে আমার জানা নেই।”

“আমি জানি। আসার পথেই একটা হার্ডওয়ারের দোকান ফেলে এসেছি পিছে।”

আমি আবারও বারান্দা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে নবরু ওয়াতানাবিকে তার হেলমেট পরে, বাইকে চেপে বসে রাস্তার শেষ বাঁকে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখলাম।

“ছেলেটা আসলেই ভালো,” আমার বোন ছোট করে শ্বাস ফেলে বলে।

“একদম,” আমি বলি। “একদম সোনার টুকরা একটা।”

নবরু ওয়াতানাবি বেলা পাঁচটা নাগাদ আমার স্টেরিওর পিন-প্লাগ সারাই করে ফেলল। তারপর সে আমার বোনকে অনুরোধ করল সহজ-সাধারণ একটা রেকর্ড ছাড়তে। আমার বোন জুলিও ইগ্লেসিয়াসের একটা রেকর্ড ছেড়ে দিল স্টেরিওতে। এই ধরনের বালছাল মিউজিক আমাদের বাসায় এলো কোথা থেকে?

“আপনি কী ধরনের মিউজিক পছন্দ করেন?” নবরু আমাকে প্রশ্ন করে।

“ওহ, আমি নানা রকমের মিউজিক পছন্দ করি,” আমি তেমন একটা চিন্তাভাবনা ছাড়াই উত্তর দিই। “ধরুন : ব্রুস স্প্রিংস্টিন, জেফ বেক, বা দা ডোরস।”

“আরে, আমি দেখি এগুলোর একটারও নাম শুনিনি। ওরা কি জুলিও ইগ্লেসিয়াসের ধাঁচের মিউজিক করে?”

“হ্যাঁ, একদম হুবহু!”

সে এবং তার প্রজেক্ট টিম মিলে নতুন যে কম্পিউটার সিস্টেম ডেভলাপ করছে, তা নিয়ে এরপর নবরু খানিকক্ষণ কথা বলল। কম্পিউটারটা এমনভাবে ডিজাইন করা হচ্ছে যে, কোনো একটা ট্রেন দুর্ঘটনার সম্মুখীন হবার পর সেটাকে তার ডিপোতে ফিরিয়ে আনার একদম তাৎক্ষণিক ও নিখুঁত একটা ডায়াগ্রাম দেখাতে সেটা সক্ষম হবে। সে যে আগ্রহ নিয়ে ব্যাপারটা বর্ণনা করছিল, তা দেখতে ভালোই লাগছিল; কিন্তু আমার কাছে পুরো ব্যাপারটা আসলে ফিনল্যান্ডে ব্যবহৃত ফিনিশ ভাষায় ক্রিয়াপদের ব্যবহার ও বিবিধ কার্যকলাপের মতোই দুর্বোধ্য, এবং অপ্রয়োজনীয় মনে হচ্ছিল। আমি ওর কথা শুনতে শুনতে, জায়গামতো মাথা নাড়াতে নাড়াতে চিন্তা করছিলাম মেয়েদের নিয়ে। যেমন, এরপরের ছুটিতে কাকে নিয়ে কোথায় আমি মদ্যপান করতে যেতে পারি, তারপর রাতের খাবার কোথায় খাওয়া যাবে, খাওয়া শেষ করে কোন হোটেলে নিয়ে যাব ওকে—এসব। এই ব্যাপারটা নিয়ে আমার আগ্রহ একদম জন্মগত। দুনিয়ায় কিছু মানুষের প্যাশন যেমন প্লাস্টিকের মডেল, বা ট্রেন ডায়াগ্রাম আঁকা, আমার তেমন প্যাশন হচ্ছে মেয়েদের সঙ্গে মদ খাওয়া, আর তাদের নিয়ে বিছানায় যাওয়া। এটা আসলে আমার নসিবের ইশারা, মানুষের নিয়ন্ত্রণ আর সমঝদারির বাইরের এক বিষয়।

আমার চতুর্থ বিয়ারের বোতল শেষ করতে না করতেই ডিনারের ডাক এলো : স্মোকড স্যালমন, ফ্রেঞ্চ স্যুপ, স্টেক, সালাদ, এবং আলু ভাজা। অন্যান্য সময়ের মতোই আমার বোনের রান্না ছিল দারুণ। আমি আজ সকালে নিয়ে আসা শ্যাবিলসের বোতল খুলে একাকী পান করতে থাকলাম।

নবরু ছুরি দিয়ে বিফ স্টেক টুকরো করতে করতে আমাকে প্রশ্ন করে, “আপনি অ্যাপ্লায়েন্স ম্যানুফ্যাকচারারের চাকরি করছেন কেন? আপনাকে তো দেখে মনে হয় না বৈদ্যুতিক জিনিসপত্রে আপনার কোনো রকম আগ্রহ আছে।”

আমার বোনই আমার হয়ে উত্তর দিয়ে দিল। “মানবজাতির কাজে লাগে—এমন কোনো বিষয়েই ওর আগ্রহ নেই। ওর পক্ষে যেকোনো জায়গায় যেকোনো চাকরি করা সম্ভব। এখন যে কোম্পানিতে আছে, সেখানেও ঐ একই ভাবেই ঢুকেছে ও।”

“এতটা সুন্দরভাবে গুছিয়ে আমি নিজেও বলতে পারতাম না,” আমি আমার বোনের সঙ্গে সহমত পোষণ করি।

“ওর একমাত্র ঝোঁক হচ্ছে ফুর্তি করে বেড়ানোর প্রতি। কোনো কিছুর প্রতি সিরিয়াসভাবে মনোযোগ দেয়া, বা নিজেকে একটু ভালো অবস্থানে তুলে নিয়ে আসার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ নেই ওর।”

“এই মুহূর্তে কথা বলছেন আমার বোন, ওরফে ইশপের গল্পের গ্রীষ্মকালীন কর্মঠ ফড়িং।”

“যে বা যারা একটু গুছিয়ে জীবনযাপন করতে চায়, জীবন নিয়ে ভাবে, চিন্তা করে—তাদের সবাইকেই ও বাঁকা দৃষ্টিতে দেখে।”

“এইবার তুমি ভুল বললে,” আমি প্রতিবাদ করলাম। “দুনিয়ার বাদবাকি মানুষ কে কী করল—এটা নিয়ে আমার কোনোই মাথাব্যথা নেই, আমি অন্যের ব্যাপারে নাক গলাইও না কখনো। দুনিয়াদারি আমি যে দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি, মাপি—ঠিক সে ব্যক্তিগত বিবেচনায় দুনিয়ার পিছে ছুটে আমি আমার শরীরের ক্যালরি পোড়াই। অন্য কে কী করে, ওটা আমার বিষয় নয়। মানুষের জীবনের দিকে তাকিয়ে মুখ ভ্যাংচানো আমার কাজ না। মুখ ভ্যাংচানো দূরে থাক আমি অন্যের লাইফস্টাইলের দিকে ফিরেও তাকাই না। হতে পারি আমি একজন অকর্মণ্য, কিন্তু মানুষের জীবনে ঝামেলা সৃষ্টি করা আমার ধাঁতে নেই মোটেও।”

“না না, এ কথা আমি মানতে পারলাম না মোটেও,” নবরু ওয়াতানাবি প্রাসঙ্গিকভাবে চেঁচিয়ে উঠে ঢুকে পড়ে আমার কথার মাঝে। “আপনি অকর্মণ্য নন মোটেই!” যাক, ছেলেটাকে ওর বাবা-মা ভালো শিক্ষাদীক্ষা দিয়ে বড় করেছে।

“ধন্যবাদ,” আমি আমার ওয়াইনের গ্লাস তুলে ধরলাম। “ওহ, অভিনন্দন, বাগদানের পরিকল্পনা করবার জন্য। যদিও দুঃখের ব্যাপার হলো, এই শুভক্ষণে কেবলমাত্র আমিই পান করছি।” 

“আমরা অক্টোবর মাসে অনুষ্ঠান আয়োজন করার পরিকল্পনা করছি,” নবরু বলে। “তবে আপনার কথামতো ‘স্কোয়ারেল’ আর ‘ভালুক’দের দাওয়াত দেয়ার জন্য সময়টা বেশ লেট হয়ে গেল।”

“কোন প্যারা নেই,” আমি হাসি চেপে উত্তর দিলাম। ও বাপ! এই ছেলের দেখি রসিকতা করার সেন্সও আছে।

“তা হানিমুনের পরিকল্পনা করছেন কোথায় আপনারা? আপনাদের তো হানিমুনের বিশেষ ছাড় পাওয়ার কথা।"

“হাওয়াই,” আমার বোন রুক্ষ স্বরে বলে।

এরপর আমরা কিছু সময় উড়োজাহাজ নিয়ে কথা বললাম। কিছুদিন আগেই আন্দিজ পর্বতমালায় উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হওয়া সংক্রান্ত কিছু বইপত্র পড়ার কারণে আমি বিষয়টা তুলে আনলাম আলোচনার টেবিলে।

“তারা তাদের মৃত সহযাত্রীদের মাংস খাওয়ার আগে মাংসের টুকরাকে বিধ্বস্ত উড়োজাহাজের অ্যালুমিনিয়ামের পাতে রেখে রোদে পুড়িয়ে নিত।”

আমার বোন খাওয়া বন্ধ করে আমার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাল। “খাবার টেবিলে তোমার এরকম একটা বিষয়ে আলাপ শুরু করবার কী কারণ? তুমি যখন তোমার পছন্দের কোনো মেয়েকে পটানোর চেষ্টা করো, তখন তার আগে খাবার টেবিলে বসে এই সব বিষয়ে কথা বলো?”

বুড়ো বিবাহিত দম্পতিদের দাম্পত্য কলহের চিপায় আটকা পড়া নিমন্ত্রিত অতিথির মতোই নবরু আমাদের আলোচনার ভেতরে ঢুকে গিয়ে আমাকে প্রশ্ন করল, “আপনি বিয়েশাদির চিন্তা করেছেন কখনো?”

“সুযোগই পেলাম না,” আমি আমার মুখে ভাজা আলুর একটা বড় টুকরা পুরতে পুরতে উত্তর দিলাম। “ছোট বোনটাকে একাকী মানুষ করতে করতেই তো অনেক সময় কেটে গেল। তারপর এলো যুদ্ধের সময়...”

“যুদ্ধ? কোন যুদ্ধ?”

“এটা ওর আরেকটা ফালতু রসিকতা,” আমার বোন সালাদ ড্রেসিংয়ের বোতল ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলে।

“আরেকটা ফালতু রসিকতা? আচ্ছা ঠিকাছে, কিন্তু বিয়ে করার যে কোনো সুযোগ হয়নি আমার, এ কথাটা কিন্তু সত্য। আমি তো সবসময়ই ছোট মনমানসিকতার ছিলাম, আমার মোজাও কখনো নিজে ধুতাম না, এসব কারণেই আমার সঙ্গে জীবন কাটাতে আগ্রহী হবে এমন কোনো মেয়ের সঙ্গে আমার দেখা হয়নি কখনো।”

“আপনার কি মোজা নিয়েও কোনো সমস্যা হয়েছিল?” নবরু আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করে।

“ওটাও ওর ফালতু একটা রসিকতা,” আমার বোন বিরক্তির সঙ্গে উত্তর দেয়। “ওর মোজা আমারই ধোয়া লাগে প্রতিদিন।”

নবরু মাথা নেড়ে দেড় সেকেন্ড ধরে হাসল। আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম ওকে এর পরেরবার অন্তত তিন সেকেন্ড হাসানোর।

“এখন, এই মহিলা তো আসলেই তার জীবন আপনার সঙ্গে কাটাচ্ছে, তাই না?” আমার বোনের দিকে ইশারা করে সে বলে।

“দিনশেষে সে তো আমার বোনই।”

“আমাদের একসঙ্গে থাকা সম্ভব হয়েছে, কারণ তোমার যা মনে চায় তুমি সেটা করলেও আমি কখনো তার প্রতিবাদ করি না। কিন্তু এটা প্রকৃত অর্থে কোনো জীবন না। সত্যিকারের জীবনে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষেরা সততার সঙ্গে একে অপরের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ায়। আমি এটা দাবি করছি না যে তোমার সঙ্গে কাটানো গত পাঁচ বছর একদম জঘন্য ছিল আমার জন্য। আমি মোটামুটি স্বাধীন এবং নিজের মতো করে জীবন কাটিয়েছি। কিন্তু তারপর আস্তে আস্তে আমার এই উপলব্ধি হয়েছে যে, এটা কোনো আসল জীবন না। এই জীবনে কী যেন একটা নেই; এই, ধরো—বাস্তব জীবনের কোনো স্বাদ নেই এতে। তুমি সবসময় কেবল তোমার নিজেকে নিয়েই চিন্তা করো, আর কেউ যদি তোমার সঙ্গে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বলতে চায় তো তুমি তাদের নিয়ে রঙ্গ তামাশায় মেতে ওঠো।”

“ভেতরে ভেতরে আমি খুবই লাজুক এক মানুষ।”

“না, তুমি এক সোজাসাপটা ঘাড়ত্যাড়া।”

“ঠিক আছে, আমি লাজুক এবং ঘাড়ত্যাড়া।” আমি আমার গ্লাসে আরও ওয়াইন ঢালতে ঢালতে এবার নবরু ওয়াতানাবিকে আমার অবস্থান বোঝানোর চেষ্টা করলাম। “আমি, ধরুন, দুর্ঘটনার পর ট্রেনকে তার ডিপোতে ফিরিয়ে আনার জন্য লাজুক এবং ঘাড়ত্যাড়া পন্থা অবলম্বন করি।

“আপনি যা বলতে চাইছেন, আমি তা বুঝতে পারছি,” সে মাথা নেড়ে বলে। “কিন্তু আমার কী মনে হয় জানেন? আমার মনে হয় যে, আপনি যখন একদম একা হয়ে যাবেন, অর্থাৎ আমরা দুজন বিয়ে করে ফেলার পর, তখন আপনার নিজেরও বিয়ে করে ফেলতে মন চাইবে।”

“হতে পারে,” আমি বলি।

“ওরে বাবা, তাই নাকি?” আমার বোন লাফিয়ে ওঠে। “তুমি যদি সত্যি সত্যিই বিয়ে করতে আগ্রহী হও তো আমাকে বলো। আমার একটা ভালো বান্ধবী আছে, খুব জোস একটা মেয়ে। ওর সঙ্গে তোমাকে পরিচয় করিয়ে দিতে পারি।”

“নিশ্চয়ই। যখন সময় হবে তখন দেখা যাবে,” আমি উত্তর দিই। “আপাতত এই পরিকল্পনা খুব বিপজ্জনক লাগছে আমার।” 

রাতের খাবার শেষে আমরা বসার ঘরে কফি হাতে গা এলিয়ে দিলাম সোফায়। এবার আমার বোন জুলিও ইগ্রোসিয়ার বদলে রুচিতে এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে উইলি নেলসনের গান ছাড়ল।

আমার বোন তখন রান্নাঘরে, পরিষ্কার করছে সবকিছু, তখন নবরু ওয়াতানাবি খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে আমাকে বলল, “সত্যি বলতে, ত্রিশের আগ পর্যন্ত অবিবাহিত থাকার পরিকল্পনা আমার নিজেরও ছিল। কিন্তু আপনার বোনের সঙ্গে পরিচয় হবার পর আমার বিয়ে ছাড়া আর কিছুই মাথায় আসেনি।”

“মেয়েটা ভালো,” আমি বলি। “একটু ত্যাড়া প্রকৃতির, কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যাও আছে খানিকটা, তবে আমার মনে হয় এসব কিছুর পরেও আপনার সিদ্ধান্ত সঠিক।”

“তারপরেও, বিয়ের সিদ্ধান্তটা কিছুটা ভীতিকরই, তাই না?

“যদি আপনি সবসময় জিনিসপত্রের পজিটিভ দিকে তাকাতে অভ্যস্ত হন, সবকিছুর মাঝে ইতিবাচকতা খোঁজেন, তবে মনে হয় না ভয় পাওয়ার কোনো কারণ আছে। কোনো ঝামেলা লাগলে, সেই ইতিবাচকতার ওপরেই নাহয় মনোযোগ সরিয়ে আনবেন।”

“হয়তো আপনি ঠিক বলছেন।”

“আমি মানুষকে ভালো পরামর্শই দিই সবসময়।”

আমি রান্নাঘরে গিয়ে আমার বোনকে বলি, আমি একটু হেঁটে আসছি বাইরে গিয়ে। “রাত দশটার আগে ফিরছি না। তোমরা তোমাদের মতো করে সময়টা কাটাও। বিছানার চাদর একদম ঝেড়েমুছে রাখা।”

“এগুলোই তোমার মাথায় ঘোরে সবসময়, তাই না?” আমার বোন অত্যন্ত বিরক্তি নিয়ে কথাটা বললেও, আমাকে থামানোর কোনো চেষ্টা করল না।

আমি বসার ঘরে ফিরে এসে নবরু ওয়াতানাবিকে বললাম আমি জগিং করতে বেরুচ্ছি, সম্ভবত আমার ফিরতে দেরি হবে।

“আপনার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হওয়াও আমি সত্যিই আনন্দিত,” সে বলে। “প্লিজ, আমরা বিয়ে করে ফেলার পর আমাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখবেন। প্রায়ই আসবেন আমাদের বাড়িতে।”

“ধন্যবাদ,” মুহূর্তকালের জন্য আমার কল্পনাশক্তিকে বিরতি দিয়ে বললাম আমি।

“খবরদার, গাড়ি চালাবে না!” আমার বোন রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে উঠল, “তুমি প্রচুর পান করেছ।”

“চিন্তা কোরো না, আমি হাঁটব।” 

রাত আটটা বাজার কিছু আগে আমি আমাদের পাড়ার একটি বারে প্রবেশ করলাম। কাউন্টারে বসে আই. ডব্লিউ. হারপার ভর্তি গ্লাসে চুমুক দিতে থাকলাম। বারের টেলিভিশনে জায়ান্টস বনাম সোয়ালো’স—এই দুই দলের মধ্যে বেসবল খেলা চলছিল। টিভির শব্দ বন্ধ রেখে তারা সায়ান্দি ল্যুপেরের রেকর্ড বাজিয়ে রেখেছিল ব্যাকগ্রাউন্ডে। পিচারের পজিশনে ছিল নিশিমোতো আর ওবানা নামের দুই খেলোয়াড়। সোয়ালো’সরা এগিয়ে ছিল ৩-২ এ। নিজস্ব সাউন্ড ছাড়া টিভি দেখতে খুব একটা মন্দ লাগছিল না।

এই বেসবল খেলা দেখতে দেখতে আমি তিন গ্লাস হুইস্কি সাবাড় করে দিলাম। যখন স্কোর ৩-৩, অর্থাৎ সমান সমান, তখন রাত নয়টা বাজায় সম্প্রচার বন্ধ হয়ে গেল। তারা টিভিসেট বন্ধ করে দিল। আমার থেকে দুই সিট দূরেই বসা ছিল বিশ বছর বয়সী এক মেয়ে, যার দিকে ইতোমধ্যে কয়েকবার আমার নজর গিয়ে আটকেছে। মেয়েটা নিজেও খেলা দেখছিল বলে আমি তার সঙ্গে বেসবল নিয়েই কথা বলা আরম্ভ করলাম।

“আমি জায়ান্টস-দলটার ভক্ত,” মেয়েটা বলে। “আপনি কোন দলের খেলা দেখেন?”

“সব দলই আমার কাছে এক রকম লাগে। আমি স্রেফ বসে বসে তাদের খেলা দেখি।” আমি উত্তর দিই।

“কারও সাপোর্ট না করে খেলা দেখে মজা লাগে আদৌ? আপনি তবে খেলার মাঝে উত্তেজিত হন কী দেখে?”

“আমাকে উত্তেজিত হতে হবে কেন? আমি তো খেলছি না। খেলছে ওরা।”

আমি নিজে আরও দুগ্লাস হুইস্কি পান করলাম, মেয়েটাকেও দুগ্লাস ডাইকুইরিস কিনে দিলাম। সে টোকিও ইউনিভার্সিটি অব আর্টসে কমার্শিয়াল ডিজাইনে মেজর করছে। কাজেই আমি তার সঙ্গে বিজ্ঞাপন সংস্থার সঙ্গে শিল্পকলার সম্বন্ধ নিয়ে এরপর কিছুক্ষণ কথা বললাম। রাত দশটা বাজার পর আমরা অন্য একটা বারে গিয়ে হাজির হলাম, যেখানে বসার জন্য আরও আরামদায়ক সোফা ইত্যাদি আছে। সেখানে গিয়ে আমি আরও এক গ্লাস হুইস্কি আর মেয়েটা এক গ্লাস গ্রাসোফার পান করল। ততক্ষণে আমরা দুজনেই মোটামুটি তাল হারিয়ে ফেলেছি পান করতে করতে। রাত এগারোটা বাজে আমি ওর সঙ্গে ওর অ্যাপার্টমেন্ট পর্যন্ত গেলাম, যেখানে আমরা মোটামুটি নিয়মতান্ত্রিকভাবেই ওর সঙ্গে সেক্স করলাম, যেমনটা কিনা কোনো সরাইখানায় গিয়ে হাজির হলেই তারা ভদ্রতা করে আপনাকে কুশন আর চা এগিয়ে দেবে।

“আলো বন্ধ করে দাও,” মেয়েটা বলল, কাজেই আমি আলো নিভিয়ে দিলাম। তার রুমের জানালা দিয়ে একটা বড় নাইকনের বিলবোর্ড দেখা যাচ্ছিল। পাশেই কোথা থেকে যেন টেলিভিশনে অনেক জোরে সেদিনের তরুণদের বেসবল খেলার সারাংশ, ফলাফল শোনানো হচ্ছিল। সেই অন্ধকারে, আর আমার মাতাল অবস্থায় সব মিলিয়ে আমি কী করছিলাম, তা আমার নিজেরও জানা ছিল না। যেটা আমি করলাম, সেটাকে সেক্স বলা যায় না। আমি শুধু আমার যৌনাঙ্গ কিছুক্ষণ ধরে ভেতরে বাইরে নাড়াচাড়া করে বীর্যপাতের মাধ্যমে প্রক্রিয়াটা সম্পন্ন করলাম।

এই সংক্ষিপ্ত প্রকল্পটি সম্পন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মেয়েটা ঘুমে তলিয়ে গেল, যেন জ্ঞান হারাবার তর সইছিল না ওর একদমই। নিজেকে ঠিকভাবে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করা ছাড়াই আমি কাপড়চোপড় পরে বেরিয়ে পড়লাম। সবচেয়ে কঠিন ছিল তারা নানা জিনিসপত্রের নিচে ঐ অন্ধকারে চাপা পড়ে থাকা আমার পোলো শার্ট, আর আন্ডারওয়্যার খুঁজে বের করা।

বাইরে পা রাখা মাত্র টের পেলাম, আমার ভেতরে থাকা অ্যালকোহলের প্রভাবে আমার সমস্ত শরীর গুলিয়ে উঠছে। জঘন্য লাগছিল আমার। শরীরের গিঁটগুলো টিভির দ্য উইজার্ড অব ওজ শোর চরিত্র টিন উডসম্যানের মতো মটমটিয়ে ফুটছিল। নিজেকে শান্ত করতে রাস্তার এক ভেন্ডিং মেশিন থেকে একটা অরেঞ্জ জুসের ক্যান কিনলাম। কিন্তু যেই মাত্র তার একটা ঢোক আমার পেটে পড়েছে, সঙ্গে সঙ্গে আমার পাকস্থলিতে থাকা সবকিছু একদম হরহরিয়ে বমি হয়ে বেরিয়ে এলো রাস্তার ওপরে। আধা হজম হওয়া বিফ-স্টেক, স্মোকড স্যালমন, লেটুস এবং টমেটো আলাদা আলাদা চেনা যাচ্ছিল রাস্তায়, বমির ভেতর।

কত বছর পর আজ আমি মদ্যপ হয়ে বমি করলাম? এতদিন, এতগুলো দিন—আমি কী করলাম? একই জিনিস, একই কাজ, বারে বারে। প্রতিবারের পুনরাবৃত্তি ছিল তার আগেরবারের অভিজ্ঞতার চেয়ে জঘন্য।

তারপর, কোনো প্রাসঙ্গিকতা ছাড়াই আমার স্মৃতিতে ভেসে উঠল নবরু ওয়াতানাবি, আর তার নিয়ে আসা সোল্ডারিং  আয়রনের কথা। “ঘরে অবশ্য একটা সোল্ডারিং আয়রন রাখা দরকার। খুব দরকারি একটা জিনিস।”—বলেছিল ও।

কী অসাধারণ একটা পরামর্শ, আমি মনে মনে ওকে উত্তর করি, রুমালে আমার মুখ মুছতে মুছতে। ধন্যবাদ আপনাকে, আপনার উছিলায় আমার বাড়িতে এখন একটা সোল্ডারিং আয়রন আছে। কিন্তু এই বালের যন্ত্রটার উপস্থিতির কারণেই আমার নিজের বাড়ি আর আমার নিজের বাড়ি মনে হচ্ছে না।

তা সম্ভবত এই কারণে যে, আমার মনমানসিকতা ছোট।

আমার বাড়ি ফিরতে ফিরতে মাঝরাত পার হয়ে গেল। স্বাভাবিকভাবেই বাড়ির দরজায় পার্ক করে রাখা মোটরসাইকেলটা আর ছিল না। আমি লিফটের চার তলার বাটন প্রেস করে, নিজের চাবি দিয়ে অ্যাপার্টমেন্টের লক খুলে ভেতরে প্রবেশ করলাম। পুরো রুম একদম নিকষ কালো আঁধারে ছাওয়া ছিল, রান্নাঘরের সিঙ্কের ওপর আবছা একটা ফ্লুরোসেন্ট আলো ছাড়া। আমার বোন সম্ভবত বিরক্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। ওকে দোষ দেয়া যায় না।

এক গ্লাস অরেঞ্জ জুস ঢেলে নিয়ে আমি এক চুমুকে পুরোটা গিলে ফেললাম। গোসলে ঢুকে প্রচুর পরিমাণ সাবান ব্যবহার করলাম আমার শরীরের বাজে গন্ধ দূর করার জন্য। তারপর সময় নিয়ে দাঁত মাজলাম। বাথরুমের আয়নাতে নিজের চেহারার দিকে তাকিয়ে আমি চমকে উঠলাম। আমাকে দেখতে রাতের শেষ ট্রেনে সফর করা মাঝবয়সী মদ্যপ মানুষগুলোর মতো লাগছিল, যারা বমি করে সিট আর নিজের শরীর-টরির মাখিয়ে একটা যাচ্ছেতাই অবস্থায় বসে থাকে। আমার ত্বক খসখসে, চোখ কোটরাগত, চুলে আর সেই আগের জেল্লা নেই।

আমি হতাশ হয়ে মাথা নেড়ে বাথরুমের আলো বন্ধ করে বেরিয়ে আসি। কোমরে স্রেফ একটা তোয়ালে পেঁচিয়ে আমি রান্নাঘরে গিয়ে ঢকঢক করে খানিকটা ট্যাপের পানি খাই। কালকের দিনটা একটু ভিন্নভাবে কাটানোর চেষ্টা করে দেখা যাবে, আমি ভাবলাম। যদি চেষ্টা করতে না পারি, তবে অন্তত খানিকক্ষণ ভাবব বসে বসে কী করা যায় এই নিয়ে। ওব-লা-ডি, ওব-লা-ডা, জীবন এগিয়ে চলে নিজের গতিতে।

“ফিরতে এত দেরি হলো যে,” অন্ধকার চিরে আমার বোনের কণ্ঠ ভেসে এলো। সে বসার ঘরের সোফায় বসে একাকী বিয়ার পান করছিল।

“এই একটু পান-টান করছিলাম,” আমি বললাম।

“তুমি খুব বেশি মদ খাও।”

“জানি।”

আমি রেফ্রিজারেটর থেকে আরেক বোতল বিয়ার হাতে এসে বসলাম তার উলটো দিকে।

কিছুক্ষণ আমাদের দুজনের কেউই কিছু বললাম না। চুপচাপ বসে রইলাম, মাঝেসাঝে আমাদের বিয়ারের ক্যানে টুকটাক টোকা দিতে দিতে। বারান্দার টবে বেড়ে ওঠা গাছের পাতাগুলো বাতাসে দুলছিল। তার পেছনে ঝুলে ছিল রহস্যময় আধখানা চাঁদ।

“তোমাকে স্রেফ জানিয়ে রাখার জন্য বলছি, আমরা কিছু করিনি আজ রাতে।” সে বলল।

“কী করোনি?”

“কিছুই না। আমারই ভেতরে কি যেন একটা সমস্যা হচ্ছিল। পরে আর করতে পারলাম না।”

“ওহ,” আমি কেমন যেন নেতিয়ে পড়ে আর কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না।

“কী সমস্যা হচ্ছিল আমার, সেটা জানতে তোমার আগ্রহ হচ্ছে না?”

“আচ্ছা বলো, কী সমস্যা হচ্ছিল?”

“এই রুম! এই জায়গা! এখানে আমার পক্ষে ওর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়া সম্ভব না।”

“ওহ।”

“তোমার কিছু হয়েছে নাকি? অসুস্থ লাগছে দেখতে।”

“আমি ক্লান্ত খুব। আমারও কখনো কখনো ক্লান্ত লাগে।”

সে কোনো কথা না বলে আমার দিকে চেয়ে রইল। আমি আমার পানীয়ের শেষ ফোঁটাটুকুও চুমুক দিয়ে শেষ করে ফেলে সোফার সিটে মাথা ঠেকিয়ে শুয়ে রইলাম চোখ বন্ধ করে।

“আমাদের দোষ ছিল? আমাদের কারণেই কি তুমি এরকম ক্লান্ত বোধ করছ?”

“একদমই না,” আমি আমার চোখ বন্ধ রেখেই জবাব দিলাম।

“তুমি কি এতটা ক্লান্ত যে কথাও বলতে পারবে না?” সে মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল।

আমি সোজা হয়ে বসে তাকালাম ওর দিকে। তারপর মাথা নাড়লাম।

“আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছে। আমি কি খুব ভয়ানক বাজে কিছু বলে ফেলেছি আজ, তোমাকে নিয়ে, বা তুমি যেভাবে জীবনযাপন করো—সেটা নিয়ে?”

“না, সেটাও না।” আমি বলি।

“সত্যি বলছ?”

“যা কিছু তুমি বলেছ, তার সবই সত্যি ছিল। কাজেই চিন্তার কিছু নেই। কিন্তু তুমি হঠাৎ এমন চিন্তিত হয়ে পড়লে কেন?”

“জানি না, হঠাৎ করেই মাথায় এলো ব্যাপারটা। ও চলে যাওয়ার পর যখন তোমার জন্য একাকী অপেক্ষা করছিলাম। মনে হলো কোনো জায়গায় সীমা অতিক্রম করে ফেললাম কি না।”

আমি রেফ্রিজারেটর থেকে দুই ক্যান বিয়ার বের করলাম। তারপর স্টেরিও সুইচ অন করে রিচি বেইরাখ ত্রয়ীর মিউজিক ছেড়ে দিলাম খুব মৃদু সুরে। মাঝরাতে মদ্যপ অবস্থায় বাড়ি ফিরে প্রতিবারই আমি এই রেকর্ডটা শুনি।

“আমি নিশ্চিত যে তুমি কিছুটা ধোঁয়াশায় আছ,” আমি বললাম। “ব্যারোমিটারে দেখানো বায়ুর চাপের পরিবর্তনের মতোই জীবনের এ সমস্ত পরিবর্তন। আমি নিজেও খানিকটা ধোঁয়াশায় আছি অবশ্য, নিজের মতো করে।”

সে মাথা নাড়ল।

“আমি কি বেশি যন্ত্রণা দিচ্ছি তোমাকে?” সে জিজ্ঞেস করল।

“দুনিয়ার সবাই কাউকে না কাউকে যন্ত্রণা দিচ্ছে।” আমি বলি। “তুমি যদি আমাকে যন্ত্রণা দেয়ার জন্য বেছে নিয়ে থাকো, তো একদম ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছ। এটা নিয়ে চিন্তা কোরো না।”

“কখনো কখনো আমি ব্যাপারটা নিয়ে খুব ভয়ে থাকি, মানে, ভবিষ্যৎ নিয়ে।”

“তোমার সবসময় সব ঘটনার একদম ইতিবাচক দিকগুলোতেই মনোযোগ দিতে হবে, চিন্তা করতে হবে ভালো ভালো ব্যাপার নিয়ে। তাহলে দেখবে যে আর ভয় লাগছে না। যদি আসলেই কোনো সমস্যা হয়, তাহলে আরও বেশি করে ইতিবাচক দিকগুলোর ওপরে ফোকাস করবে।” নবরু ওয়াতানাবিকে দেয়া বক্তৃতাই আমি ওকে শুনিয়ে দিই আবার।

“কিন্তু আমি যেভাবে চাই, ব্যাপারগুলো যদি সেভাবে না এগোয়, তবে?”

“যদি সেভাবে না এগোয়, তবে আবারও আগাগোড়া ভেবে দেখবে কোনো ইতিবাচক ইঙ্গিত খুঁজে পাওয়া যায় কি না।”

সে খুক খুক করে হাসল একটু। “তুমি বরাবরের মতোই অদ্ভুত থেকে গেলে।”

“এবার আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি?” আমি বিয়ারের আরেকটা ক্যান খুলতে খুলতে প্রশ্ন করলাম।

“নিশ্চয়ই।”

“ওর আগে তুমি কয়জন ছেলের সঙ্গে বিছানা ভাগ করেছ?”

সে কিছুক্ষণ দনোমনো করে উত্তর দিল দুই আঙুল দেখিয়ে, “দুইজন।”

“একজন ছিল তোমার বয়সী, আরেকজন মোটামুটি বুড়ো টাইপের মানুষ?”

“তুমি কীভাবে জানলে?”

“এটা একটা প্যাটার্ন,” আমি ঢকঢক করে খানিকটা বিয়ার গিললাম। “এত বছর আসলে ঘাস খেয়ে বেড়িয়েছি পুরোটা সময়, তা তো নয়। এতটুকু ধরতে পারার সক্ষমতা আছে আমার।”

“তার মানে, আমি গতানুগতিক আর সব মেয়ের মতোই?”

“বলা যাক, অন্যসব ‘স্বাভাবিক’ মেয়ের মতোই...”

“তুমি কতগুলো মেয়ের সঙ্গে শুয়েছ এই পর্যন্ত?”

“ছাব্বিশজন। সেদিন গুনেছি বসে বসে। ছাব্বিশজনের কথা আমার স্মরণে আছে। আরও দশজনের মতো বেশি হবার কথা, কিন্তু তাদের কারও কথাই আমার স্পষ্ট মনে নেই। ভয় পেও না, আমি মেয়েদের কোনো তালিকা টুকে রাখছি না ডায়েরিতে।”

“এত মেয়ের সঙ্গে তুমি শুয়ে বেড়াও কেন?”

“জানি না,” আমি সত্যি উত্তরটাই দিই। “আমার মনে হয় যে, একপর্যায়ে এসে আমারও থামা লাগবে। কিন্তু সেটা যে কীভাবে হবে, আমার জানা নেই।”

আমরা কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলাম, নিজ নিজ চিন্তায় ডুবে। অনেক দূর থেকে মোটরসাইকেলের ভটভট আওয়াজ ভেসে আসে, কিন্তু ওটা নবরু ওয়াতানাবির হওয়ার কথা নয়। রাত একটা বাজে তো অবশ্যই নয়।

“এখন সত্যি সত্যি বলো,” সে বলে, “ওকে কেমন লাগল তোমার?”

“নবরু ওয়াতানাবি?”

“হুমমমম।”

“মন্দ নয়, মনে হচ্ছে। আমার মতো না। অবশ্য ওর জামাকাপড়ের চয়েজ খুব বাজে।” আমি আরও কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললাম, “ওর মতো একজন সদস্য প্রতি পরিবারেই থাকতে পারে। তাতে কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হয় না।”

“আমিও এটা মনে করি। তুমি নিজেও তো একটা চিড়িয়া : তুমি, যাকে আমি আমার ভাই বলি। আমি তোমাকে পছন্দ করি সন্দেহ নেই, কিন্তু পুরো দুনিয়ার সব মানুষ যদি তোমার মতো হতো, তবে দুনিয়াটা একটা ভয়ানক জায়গায় পরিণত হতো।”

“হয়তো তুমি ঠিক বলছ।”

আমরা যে যার বিয়ারটুকু শেষ করে নিজ নিজ কামরায় চলে গেলাম। আমার বিছানার চাদর পরিষ্কার, টানটান, ভাঁজহীন। আমি টান হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে জানালা দিয়ে উঁকি মেরে থাকা চাঁদের দিকে তাকালাম। আমার গন্তব্য কোথায়? আমি চিন্তা করি। কিন্তু এরকম একটা বিষয় নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করার জন্য আমি খুব ক্লান্ত এখন। চোখ বন্ধ করা মাত্রই ঘুম আমাকে অন্ধকার, নীরব একটি মশারির মতো আচ্ছাদিত করে ফেলল। 

(অ্যান্ড দ্য এলিফ্যান্ট ভ্যানিশেস গল্পগ্রন্থ থেকে জে রুবিনের করা ইংরেজি অনুবাদের বঙ্গানুবাদ।)