আপনি যদি শক্তিকে প্রত্যাখ্যান করেন তাহলে জীবন হয়ে পড়ে এক রকম মৃত্যুরই শামিল। আর যদি তা গ্রহণ করেন তাহলে আপনাকে তা ধ্বংস করে ফেলে। সুতরাং বিকল্প কি ? বিকল্প হচ্ছে এটাকে গ্রহণ করা এবং তা কল্যাণকর করে তোলার পদ্ধতি খুঁজে বের করা, এটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা
অ্যাডওয়ার্ড জেমস টেড হিউজ। পরবর্তীতে টেড হিউজ নামেই কবিখ্যাতি জোটে। আজ থেকে ৮৬ বছর আগে ১৯৩০ এর ১৭ আগস্ট পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেন এই কবি। কেলভার নদীর কোলঘেষে মিথলম্রয়ড নামক স্থানে বেড়ে ওঠেন তিনি। উক্ত জায়গাটি ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ারের পেনিনসে অবস্থিত। চারপাশ ছিল তার শান্ত গ্রামীণ পরিবেশ। উইলিয়াম জেমস তাঁর বাবার নাম। পেশায় ছিলেন তিনি একজন কাঠমিস্ত্রি। টেড হিউজের বয়স যখন ৭ তখন তাঁর পরিবার পশ্চিম ইয়র্কশায়ারে ছোট্ট শহর ম্যাক্সবোর্গে বসত গড়ে। পাহাড় সদৃশ সেইসব ভূগোল আমরা তাঁর কবিতায় লক্ষ্য করি যত্রতত্র।
১৫ বছর বয়স থেকেই টেড হিউজ কবিতা লিখতে শুরু করেন। কবিতা চর্চার শুরুটা তার উজ্জ্বল-ই ছিল বলা চলে। এর স্বপক্ষে যুক্তি হিসেবে আমরা দেখি স্কুল জীবনে কবিতা লেখার প্রতিযোগিতায় বগলদাবা করেছিলেন অগ্রজ আরেক কবি রবার্ট গ্রেভস এর লেখা ‘হোয়াইট গডেস’ অর্থাৎ ‘শুভ্র দেবী’। কবি হবার প্রাক্কালে এই গ্রন্থের ভূমিকা বেশ কাজে দিয়েছিল তাঁর। উচ্চ বিদ্যালয়ের পাঠ চুকে তিনি একজন স্থল বেতার মেকানিক হিসেবে যোগ দেন রয়্যাল এয়ার ফোর্সে। কিন্তু তাঁর উড়নচণ্ডি মন সেখানে টিকল মাত্র দুই বছর। চাকরি ছেড়ে সোজা ঝুঁকে পড়লেন পড়ালেখার দিকে। একাডেমিক বৃত্তি নিয়ে পড়তে গেলেন কেমব্রিজে পেমবোর্ক কলেজে। সেখানে অধ্যায়নকালে কিছু কবিতা প্রকাশিত হয়। এরপর ১৯৫১ সালের দিকে কেমব্রিজে প্রত্নতত্ত্ব ও নৃতত্ত্বে অনার্স শুরু করেন। সেই সময়ে তিনি কাল্পনিক ও পৌরাণিক বিষয়ের উপরেও চর্চা করেন ব্যাপক। ১৯৫৪ তে এসে গ্রাজুয়েট শেষ করার দুই বছর পর মাতলেন পত্রিকা নিয়ে। ১৯৫৬ সালে কয়েকজন সম্পাদক মিলে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘বিটপ’স রিভিউ’স’। পত্রিকাটির প্রকাশকালে একটি মধ্যাহ্ন ভোজন অনুষ্ঠানে টেড হিউজের পরিচয় ঘটল আরেক কবি সিলভিয়া প্লাথের সঙ্গে। পরিচয়ের অল্প কয়েক মাসের মধ্যেই পরিণয়। তারিখটা ১৬ জুন। সংসার জীবনে এসে টেড হিউজের প্রথম পাণ্ডুলিপি ‘দি পোয়েট্রি সেন্টার’ কর্তৃক পরিচালিত একটি প্রতিযোগিতায় দেয়ার জন্য তাঁকে উৎসাহ দেন সিলভিয়া। বিচারক ছিলেন দাপুটে সব কবি। ম্যারিয়ান মুর, ডব্লিউ. এইচ. অডেন, স্টেফেন স্পেনডার। পাণ্ডুলিপি ‘দি হাওক ইন দি রেইন’ এর জন্য টেড প্রথম পুরস্কার তুলে নেন নিজ ঘরে। ব্যাস, এটি পাবার পর পেয়ে যান কবি হিসেবে আন্তর্জাতিক খ্যাতি। জীবিকার প্রয়োজনে বিয়ের পরপরই ছুটেন দু’জনই আমেরিকাতে। সিলভিয়া স্মিথ কলেজে আর টেড ম্যাসাচুসেটস এ শিক্ষকতা শুরু করেন। বসবাসও শুরু করেছিলেন সেখানে। কিন্তু বছর দুয়েক পর (১৯৫৯) আবার ফিরে গেলেন লন্ডনে। এই সময়টাতে প্লাথ ও হিউজের গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা প্রকাশ হতে থাকে। সিলভিয়া প্লাথ প্রকাশ করেন ‘The Colossus’ আর টেড হিউজ ‘Lupercal’.
নারীসঙ্গ টেড হিউজকে উন্মাদ করে ফেলেছিল। তিনি তাঁর প্রেমিকাদের ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’ নামে সম্বোধন করতেন। তাঁর জীবনে নারী অধ্যায়কে বর্ণনা করতে তিনি কবিতার ভাষায় বলেন, ‘Which bed ? Which bride ? Whiche breast’s comfort?
১৯৬০ সালের এপ্রিলে তাঁদের প্রথম সন্তান ফ্রিডা রেবেকা পৃথিবীতে আসে। তার পৃথিবীতে আসার পর লন্ডন শহর হিউজের কাছে কেমন শ্রীহীন হয়ে পড়ে। যার ফলে ১৯৬১ তে হিউজ দম্পত্তি পাড়ি জমান ডিভন-এ। পুরোনো একটি বাসা কিনে স্থায়ীভাবে থাকার সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা। সেখানে পরিচয় হয় আসিয়া নামের এক সুন্দরীর সঙ্গে। তাৎক্ষণিক তার প্রতি ঝুঁকে পড়ে টেড হিউজ। এখানে থাকা অবস্থায় তাঁদের ঘরে আগমন ঘটে দ্বিতীয় সন্তানের। তার নাম রাখা হয় নিকোলাস। কিন্তু তাঁদের এই দ্বিতীয় সন্তান পৃথিবীতে এসে খুব বেশিদিন শান্তিতে কোলে চড়তে পারেনি মা-বাবার। শুরু হয় দাম্পত্য কলহ। সংকট তীব্রতায় রূপ নেয়। ১৯৬৩ সালে ১১ ফেব্রুয়ারি আত্মহত্যা করেন সিলভিয়া প্লাথ। আত্মহত্যার দুইদিন আগে টেড হিউজকে একটি চিঠি লেখেন তিনি। সেখানে তিনি জানান, ‘আমি লন্ডন ছেড়ে চলে যাচ্ছি। আর কোনোদিন তোমার মুখ দেখতে চাই না আমি।’ বিচ্ছেদপূর্ণ এই চিঠি পেয়ে টেড হিউজ লেখেন দীর্ঘ কবিতা ‘লাস্ট লেটার’। সেখানে তিনি লেখেন, ‘Over everything, Late afternoon, Friday, / My last sight of you alive. / Burning your letter to me, in the ashtray, / With that strange smile. / Had I bungled your plan ?’
টেড হিউজের প্রেমিকা আসিয়াও ১৯৬৯ সালে আত্মহত্যা করেন সিলভিয়ার মতো একই পদ্ধতিতে। জলন্ত গ্যাস চুল্লির ভেতর মাথা ঢুকিয়ে। মৃত্যুর আগে নিজের ৪ বছরের কন্যা সুরাকেও হত্যা করান তিনি। আত্মহত্যা করার আগে তিনি একটি চিরকুট লিখে যান। সেখানে তিনি বলেন, ‘ভেবে দেখলাম, টেড হিউজের কোথাও নেই আমি। তাঁর চিন্তার মধ্যে কেবল শুধুই সিলভিয়া’। এরপর তিনি প্রেমে পড়েন ব্রেন্ডা হেডেনসহ অনেক রমণীর। তবে নার্স ক্যারল অর্চার্ডকে তিনি শেষ পর্যন্ত বিয়ে করেন ১৯৭০ সালে। এই অর্চার্ডই হিউজের মৃত্যু (১৯৯৮) পর্যন্ত সঙ্গে ছিলেন। নারীসঙ্গ টেড হিউজকে উন্মাদ করে ফেলেছিল। তিনি তাঁর প্রেমিকাদের ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’ নামে সম্বোধন করতেন। তাঁর জীবনে নারী অধ্যায়কে বর্ণনা করতে তিনি কবিতার ভাষায় বলেন, ‘Which bed ? Which bride ? Whiche breast’s comfort?’
আত্মহত্যার দুইদিন আগে টেড হিউজকে একটি চিঠি লেখেন তিনি। সেখানে তিনি জানান, ‘আমি লন্ডন ছেড়ে চলে যাচ্ছি। আর কোনোদিন তোমার মুখ দেখতে চাই না আমি।’
তবে সিলভিয়া প্লাথকে তিনি আজীবন স্মরণে রেখেছিলেন সেটা আমরা দেখতে পাই তাঁর মৃত্যুর এক মাস আগে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘বার্থডে লেটারস’ এর মাধ্যমে। সেখানে প্রতিটি কবিতায় প্লাথের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। ৮৮টি কবিতা জুড়ে শুধু সিলভিয়া আর সিলভিয়া। সিলভিয়ার প্রতিচ্ছবি হিসেবে এই কাব্যগ্রন্থটি আজও সর্বাধিক গ্রহণযোগ্যতার দাবি রাখে। অবশ্য ১৯৭১ সালে প্রকাশিত সমালোচক এ. আলভেরেজ সিলভিয়া প্লাথের আত্মহত্যা বিষয়ে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। গ্রন্থটির নাম দেন তিনি ‘দি সাভেজ গড’। সাব টাইটেল ‘এ স্টাডি অব সুইসাইড’। সাহিত্য-শিল্প চর্চাকারীরা যে কিছুটা আত্মবিধ্বংসী হয়ে ওঠে সে কথাটি তিনি ওখানে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বারবার বোঝাতে চেষ্টা করেছেন। উক্ত লেখায় আত্মহত্যার মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণও গভীর ভাবনা জাগায় পাঠকদের।
তাঁর উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে আছে, দি আয়রন ম্যান (১৯৯৮), ওল্ফ ওয়াচিং (১৯৯০), ফ্লাওয়ার্স অ্যান্ড ইনসেক্টস (১৯৮৬), সিলেক্টেভ পোয়েম’স (১৯৫৭-১৯৮১), মুরটাউন ডায়েরি (১৯৮৯), কেভ বার্ডস (১৯৭৯), ক্রো (১৯৭১) এবং লুপারক্যাল (১৯৬০)। তিনি তাঁর মৃত্যুর বছরে (১৯৯৮) দি বার্থডে লেটারস সর্বশেষ বই বের হয়। এছাড়াও তিনি ওভিড ও ইসকালেসসহ ক্ল্যাসিক লেখকদের লেখা অনুবাদ করেন। তিনি ১৯৮৪ সাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ইংল্যান্ডে কবি শ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত ছিলেন। তাঁর মৃত্যু বরণের তারিখটা ছিল ১৯৯৮, ২৮ অক্টোবর।
পুনশ্চ : লেখাটি তৈরিতে সবচেয়ে বেশি সাহায্য গ্রহণ করা হয়েছে জোনাথন বেট রচিত টেড হিউজ : দি আনঅথরাইজড লাইফ বইটির।