বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সাথে ভারতীয় বাহিনীর সংযোগে তৈরি মিত্র বাহিনীর হাতেই পতন ঘটে পাক হানাদারের।
ডিসেম্বরের ১৬ তারিখে হানাদার বাহিনীর আত্মসমপর্ণের মধ্যে দিয়ে সমাপ্তি ঘটে যুদ্ধের। যুদ্ধের দিনগুলো বড় দ্রুতই চলে যেতে থাকে। রণাঙ্গন থেকে ঘণ্টায় ঘণ্টায় নতুন খবর আসে। যুদ্ধের খবরের পাশাপাশি আমাদের বিরুদ্ধে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের নানা তৎপরতার খবরে আতঙ্কিত করে তোলে আমাদের। সেই সঙ্গে আসে কমিউনিস্টদের সাহায্যের খবরও। তবুও আমাদের সৌভাগ্য যে, সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন, সোভিয়েত ব্লকের সারা দুনিয়ার মস্কপন্থী কমিউনিস্ট পার্টিগুলো দৃঢ়ভাবে আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। আমাদের বিজয়ে অনেক সহায়তা করেছিল। খবর পেলাম ডিসেম্বরের দশ তারিখেই ময়মনসিংহ শহর মুক্ত হয়ে গেছে। ১৬ ডিসেম্বর পাক বাহিনীর চূড়ান্ত আত্মসমর্পণের পর আর ভিনদেশে বসে থাকতে পারছিলাম না। অস্থির হয়ে উঠেছিলাম মুক্ত স্বদেশের মাটি স্পর্শ করার জন্য। আঠারো কী উনিশ তারিখেই সীমান্ত পাড়ি দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখলাম।
মানুষের অন্তরে বয়ে চলছে আনন্দের ঝরনাধারা। পরিচিত যার সঙ্গে দেখা হয় সেই-ই বুকে জড়িয়ে ধরে। কেমন আছেন—এ প্রশ্ন কেউ জিজ্ঞেস করে না। কেউ বিড় বিড় করে বলেন, বেঁচে আছেন? পাকিস্তনি বর্বরদের সেই মারণযজ্ঞের ভেতরও যার জানটা কেবল বেঁচে আছে সেইতো মহাভাগ্যবান। কেমন আছেন—এ প্রশ্ন তখন অবান্তর। কত প্রিয়জনের মৃত্যুর খবর শুনতে শুনতেই না হালুয়াঘাট থেকে ময়মনসিংহ শহরের পথটুকু পাড়ি দিলাম। এর একটু পরেই হঠাৎ কানে এলো এক মর্মান্তিক সংবাদ। পাক সেনাদের আত্মসমর্পণের মাত্র দুদিন আগে চৌদ্দ ডিসেম্বর ওদের এদেশীয় দালালরা বেশ কয়েকজন বুদ্ধিজীবীকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করেছে। তাদের বিকৃত মরদেহ পাওয়া গেছে ঢাকার রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে।
সম্ভবত ডিসেম্বরের ২০ তারিখ ময়মনসিংহ শহরে এলাম। স্ত্রী পুত্র আত্মীয়-স্বজনদের সাথে মিলিত হলাম দীর্ঘ নয় মাস পর। একাত্তরে আমার বয়স ছিলো পঁয়ত্রিশ। এ বয়সে ত্রিকালদর্শী দার্শনিক হয়ে গেলাম। ব্রিটিশ শাসনের আর পাকিস্তানের জন্ম-মৃত্যু দর্শন করলাম। একই সঙ্গে বাংলাদেশের জন্মও। বাংলাদেশের জন্মের ক্ষণটি, মোটেই ভাবতে পারিনি যে, এত অল্প দিনের মধ্যে শেষ হবে। ভাবিনি এত দ্রুতই পাকিস্তানের ভূত দেখতে হবে।
শ্রুতিলিখন : শ্যামল চন্দ্র নাথ