ঈদসংখ্যা ২০২৩

আবদুল কাদের যেভাবে অন্ধ হলো

এক.
কবুতর হয়ে সাপটা আকাশে উড়তে শুরু করল। প্রথমে সোজা ওপরের দিকে। এরপর সামান্য কাত হয়ে পশ্চিমে। তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। পড়ন্ত সূর্য কিছুক্ষণ স্থির রইল। হতে পারে কবুতরকে পথের সন্ধান দিতেই এমন সিদ্ধান্ত। পেছনে একটি চিল উড়ছে। উপস্থিত সবে এতক্ষণ জাদুকরের জাদুতে মুগ্ধ হয়েছিল। কিন্তু এরপরই ভয় বাড়ছে! তখনই জাদুকর বলে, ভয় পাবেন না। আসলে ওই চিলটা আমি। কবুতরটা ছাড়লে আমার জাদুর ব্যবসা শেষ। তাই ধরতে ছুটছি। দর্শক যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। একজন বলে, উড়ন্ত কবুতর দেখতে সুন্দর। উড়ুক। ছেড়ে দেন ভাই।

জাদুকর তার কথায় কান না দিয়ে নিজের মতো বলেই যাচ্ছে। এদিকে কবুতরটা শত চেষ্টা করেও কারও দৃষ্টি অতিক্রম করতে পারল না। ততক্ষণে সূর্য প্রায় ডুবে ডুবে। যদিও বৈদ্যুতিক বাতির কারণে শহরের সবকিছুই স্পষ্ট লাগছে। তাছাড়া কমলাপুর রেলস্টেশনে কখনোই সন্ধ্যা নামে না। সারাক্ষণ মানুষের ভিড় লেগে থাকে। কেউ ঢাকায় আসে, কেউ ফিরে যায় গ্রামে। এদের এক-দুজন জাদুকরের দিকে তাকায়। ভালো লাগলে দাঁড়ায়। এভাবেই ভিড়টা বেড়ে চলছে। ভিড় ঠেলে একজন পুলিশ রাইফেল তাক করে কবুতরের দিকে!

কবুতর দেখা যাচ্ছে না! জাদুকরের সঙ্গে সবাই বারবার আকাশের দিকে চোখ রাখে। পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ কোথাও নেই! বিষণ্ন জাদুকর সব ছেড়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু বলছে না, নড়ছেও না। একে একে সব দর্শক বিদায় নেয়। একজন স্থির দাঁড়িয়ে আছে। ভিড় কমলে সে আরও কাছে এসে জাদুকরের কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনার দরজা খোলে—শোনেন জাদুবিদ্যাটা ভালোভাবে জানা দরকার আপনার। দর্শক বুঝে গেলে জাদুতে অধিবিদ্যা থাকে না, সাধারণ বিদ্যায় পরিণত হয়। জাদুকরের চোখ বেয়ে পানি নামে। তিনি আবার বলেন, আরে আপনি কাঁদছেন কেন! একবার ফেল করলে দ্বিতীয় চেষ্টায় সফল হবেন। এবার জাদুকর কান্নাভেজা কণ্ঠে বলে, জাদুবিদ্যায় ফেল করে কাঁদছি না, কাঁদছি প্রাণের ভাইকে হারিয়ে! যে ছিল পৃথিবীতে একমাত্র আপন। এই কথা শোনামাত্রই লোকটি হাঁ করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিছুই বলতে পারল না।


দুই.
কমলাপুর রেলওয়ে ব্রিজের ভিক্ষুক কাদির। বয়সের ভারে বেশ নুয়ে পড়েছে। তবু প্রতিদিন সকালে থালা হাতে ব্রিজের স্টেশনমুখী সিঁড়ির পাশে বসে। শুধু যে বসে হাতটা বাড়িয়ে রাখে এমন না, দাঁড়িয়েও বাড়িয়ে রাখে ভিক্ষার হাত। পথচারিরা হয়তো ভাবে, তাকে দেখেই ভিক্ষা চাইছে। তখন যে যার সামর্থ্যমতো দিয়ে যায়। আবার যারা এই পথে প্রতিদিন যাতায়াত করে, তাদের ইচ্ছে হলে ভিক্ষা দেয়। অথবা দেয় না। এতে কাদিরের কোনো অভিযোগ নেই।

কাদির সাধারণ পাঞ্জাবির সঙ্গে পুরাতন লুঙ্গি ও জুতা পরে আছে। হাতে যথারীতি লাঠি। মুখে আল্লাহর জিকির। টুপিটা কপাল থেকে চার ছয় আঙুল পেছনে। চোখে রোদ চশমা। অনেকেই জানে না এটি ব্যবহারের কারণ। যদিও এখনকার ভিক্ষুকেরা তা ব্যবহার করে থাকে। কাদির এটি ব্যবহার করে অন্ধ হওয়ার কারণে।

অন্ধ লোকটির মুখে শোনা যায় এক নির্মম বাস্তবতার গল্প। দুই ভাইয়ের গল্প। যা সামনে নিয়ে আসে বিক্ষুব্ধ সময়ের কথা। ছোট ভাইয়ের বয়স তখন তেরো আর বড়জনের পনেরো। দুই ভাই পাড়ামহল্লা মাতিয়ে বেড়াত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিশ বছরের মাথায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা। অথচ কারও ভাবনায় ছিল না পুনরায় এমন পরিস্থির মুখোমুখি হবে। ক্ষত-বিক্ষত হবে আবার পৃথিবী। অক্ষশক্তি ও মিত্রশক্তির অমানবিকতায় সাধারণ মানুষের জীবন হয়ে উঠবে বিষাদময়! স্তালিন, রুজবেল্ট, চার্চিল, কাই-শেকদের মিত্রশক্তি জয় লাভ করলেও তারা ঠেকাতে পারেনি বৈশ্বিক অর্থনীতির মন্দা। এডলফ হিটলারের পতনে যদিও আত্মসমর্পণ করে হিরোহিতো ও মুসোলিনি। তারপরও সিঙ্গাপুর থেকে অক্ষশক্তির পক্ষের ভারতনেতা সুভাষচন্দ্র বসু ‘আর্জি হুকমত এ আজাদ হিন্দ’ গঠন করেন। এরপরই ভারতবর্ষের হৃদয়ে স্বাধীনতার সুবাতাস বইতে শুরু করে। তখনও সেখানে ছায়া মেলে বসে আছে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। জহরলাল নেহেরুর ইচ্ছা—ভারতবর্ষ হবে হিন্দু রাষ্ট্র। অন্যদিকে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ইচ্ছা দ্বিজাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ‘পাকিস্তান’। এক রাষ্ট্র থাকলে একজনকে হতে হবে প্রাদেশিক নেতা। অথচ দুজনেরই খায়েশ রাষ্ট্রপ্রধান পদ। ফলে তারা আয়েশ করে হাত গুটায় ব্রিটিশকর্তা লর্ড মাউন্টব্যাটেনের দরবার হলে। ডাকা হয় সিরিল র‌্যাডক্লিফকে। তাকে দেয়া হয় ভারতবর্ষ বিভাজন রেখা টানার দায়িত্ব। যখন ভারতবর্ষে দাগ কাটা হয় তখন দুইটা শিবির তৈরি হয় সত্য। আদতে বাঙালি আর পাঞ্জাবিদের হৃদয়েই ছুরিটা টানা হয়। সেই রক্তের প্রবাহতা নেহেরু দেখেছিলেন। বুঝেছিলেন—এমন বিভাজন বাঙালি আর পাঞ্জাবি একটা সময়ে মানবে না। পুনরায় ভারতের সঙ্গে মিলিত হবে। কিন্তু পাকিস্তান ছাড় দেয়ার পক্ষে না। দুজনের স্বার্থবাদী আচরণে কেঁদে উঠল দুই সম্প্রদায়।

এদিকে বাঙালির সব ব্যথা ছাড়িয়ে রূপ নিল মহাব্যথায়। কলকাতা, পাকিস্তান আর বাংলার বাঙালিরা তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল! এমন খাণ্ডবদাহ সহ্য করার শক্তি ছিল না চাঁদপুর মতলবের গণেশ ঘোষ পরিবারের।


তিন.
ঘোষ পরিবারের দুই ভাইয়ের ছোটজন পরিমল। বড়জন হারাধন। বাবা গণেশ ঘোষ কুষ্ঠ রোগে মারা পড়লে মায়ের আশ্রয় বড় হতে থাকে দুই ভাই। জহর কাকুর ফার্মেসিতে কাজ শুরু করে হারাধন। মাসিক মায়না পাঁচ টাকা। তখনকার দিনে অনেকই বলা যায়। জহর কাকুর এই টাকা দেয়ার মূল কারণ—বিপদে ভাতিজাদের পাশে দাঁড়ানো। কিন্তু দেশ ভাগ শুরু হলে এক সকালে ঘুম ভাঙার পর দেখা যায়—তাদের মায়ের খোঁজ নেই! কোথাও নেই! তবু খোঁজ চলে আশপাশে। টিন পিটিয়ে জানানো হয় এলাকায় এলাকায়। জহর কাকু ঠিক ওই দিনই বিশেষ কাজে চিটাগাং যায়। এদিকে ফার্মেসিও বন্ধ। দুই ভাই যেন অসহায়! কার কাছে যাবে তারা? স্বজন-স্বজাতিরা টাকার বিনিময়ে মুসলমানদের কাছে ঘরবাড়ি ও জমি বুঝিয়ে রাতে রাতে দেশ ছাড়ছে। যার কাছে যায়—সেই-ই নেই। চারপাশে কেবল নেই আর নেই। দুই ভাই ভাবতেই পারল না—তাদের জীবনে এত বড় ট্রাজেডি নেমে আসবে! এদিকে তিন দিন গত হলেও তাদের মায়ের খোঁজ পাওয়া গেল না।

হারাধন ছোট ভাইকে বলে, মোনে অয় মায়ও আমগরে ফালাইয়্যা কলিকাত্তা চইল্যা গেছে। আর আইব না।

পরিমল বলে, না রে দাদা, মায় বিপদে পচ্ছে—সমির কাকুর ঋণ আনতে গেছে। আমাগ উচিত বাজে না ভাইবা মার খোঁজ করন।

কত কইরা কইলাম, যাওনের দরকার নাই। হুনেই না। আর হুনছি জহর কাকু কাইল আইব। তহন পুরা এলাকায় মারে খুজুম।

দাদা, মায়রে যদি আর না পাই, আমাগ কী অইব?

অত চিন্তা করিস না। আইব।


চুলায় আগুন জ্বলে না। কারণ তারা রান্না পারে না। তাই প্রতিদিন হোটেল থেকে খাবার কিনে খায়। সন্ধ্যায় জহর কাকুর দোকানের পাশ দিয়ে খাবার হাতে ফিরছে হারাধন। চোখ যায় ফার্মেসির দিকে, দোকানটি খোলা! খোলা কেন! কলাদি পাড়ার হাজি মমিনুর রহমান কাকা বসে আছেন। হারাধন দৌড়ে সেখানে যায়। এরপর যা শোনে তার জন্য কোনোভাবেই প্রস্তুত ছিল না সে। কিশোর হারাধনের মনে জেদ চাপে, যে করেই হোক, জহর কাকা আর মাকে খুঁজে বের করবেই। বাড়ি গিয়ে পরিমলকে বিস্তারিত বলে। পরিমল বয়সে ছোট হলেও বড়দের মতো বুদ্ধি রাখে। তার ইচ্ছা, জমিজমা মমিনুর রহমান কাকাকে দিয়ে দুই ভাই কলকাতায় চলে যাবে। হারাধন অমত করল না। কারণ, এত মুসলমানের ভিড়ে নিজেদেরকে বড়ই বেমানান লাগে। কিন্তু মুশকিলটা হলো, জমি বিক্রি করতে গিয়ে শুনে তাদের মা আগেই সব বিক্রি করে গেছে। রেখেছে পাড়ার মাতব্বর। হারাধন বলে, বাবার সম্পত্তি পাবে সন্তানেরা, মায়ের পক্ষে বিক্রি করা অসম্ভব!

হারাধন ও পরিমলের কাঁধে হাত রেখে মমিনুর রহমান বলেন, তোমাদের মায়ের গোপন ইচ্ছাটা অনুমান করছি। একজন লোভী নারী। নয়তো প্রকৃত মা সন্তানদের এভাবে রেখে যেতে পারে না। তোমরা এখনও বয়সে ছোট। বাবাহারা সন্তানদের প্রধান মা। তিনি মাতব্বরকে বলেছেন, তারা বয়সে এখনও ছোট—সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। আমি তাদেরকে বুঝিয়ে ভারতে নিয়ে যাব। সেখানেই তাদের নামে জমিজমা রাখব। সেটা করলে আপনাদের বিপদ হওয়ার কথা না। এমন অভয় সিদ্ধান্তেই মাতব্বর জমি রেখেছে। দুই ভাইয়ের চোখে পানি নামে তখন। পরিমল বলে, কাকু আমাদের কিছু টেহা দান করেন। ভারত চইল্লা যামু। সে যাবে, ভালো কথা। কিন্তু দূরের পথ। তোমরা চিনবে কেমন করে? বরং থেকে যাও। তোমাদের নামে জমিজমা লিখে দিব। আমার যেহেতু পুত্র সন্তান নেই। এই বাড়িতেই থাকবে তোমরা। কিশোর মন কোনো আশ্রয়ের সামনে নিজের জান ও জবানের জিম্মা করতে রাজি হলো না। অজেয়কে জয় করার তীব্র বাসনা চেপে বসল তাদের মাথায়।


চার.
দুই ভাই প্রথমে আসে ঢাকায়। এরপর যাবে যশোর। যশোর থেকে বেনাপোল হয়ে সোজা ভারতের গোপালনগর নয়তো চৌবেড়িয়া গিয়ে থামবে। কারণ, সেখানে তাদের আত্মীয়ের বাড়ি। তাদের মা সেখানেই থাকতে পারে। হারাধনের জেদ জহরের ওপর। মাকে আগেই সন্দেহ করত পরিমল। দুজনের মাখামাখি সম্পর্কটা ভালো লাগত না দুই ভাইয়ের।

হাজি মমিনুর রহমান রাতে জোরপূর্বক অনাথ দুই ভাইকে বাড়ি নিয়ে আসে। খাবার খেতে দেয়। চিন্তিত মন খাবারের দিকে মুখ নিতে পারে না। পরিমল বলে, মমিনুর কাকা জোর করে এনেছেন। না খেলে রাগ করবেন। খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। এখন তিনিই আমাদের মা-বাবা। কপালে যা আছে তাই হবে। হারাধন কিছু না বলে বিছানা পাতে। এমন সময় মমিনুর রহমান এগিয়ে এসে বলেন, তোমরা এখানে ঘুমাবে না। তোমাদের জন্য আলাদা ঘরের ব্যবস্থা আছে। কথাটা যেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায় না পরিমল। রাত বাড়ছে, সবাই ঘুমিয়ে পড়ছে। অথচ সিদ্ধান্তহীনতায় হারাধন। থাকবে নাকি চলে যাবে। থাকলে বিপদ কমার সম্ভবনা নেই। ওখানের মুসলমান এখানে আসছে, এখানের হিন্দু ওখানে যাচ্ছে। আসা যাওয়াদের কারণেই বাড়তে থাকবে আমাদের সমস্যা। এমন ভাবনায় যেন তার অস্থিরতা আরও বাড়ছে।

দ্বিতীয় দিন সকালে মমিনুর রহমান দুই ভাইকে নাশতা খেতে ডাকছেন। কোনো সাড়া নেই। ঘরের কাছে এসে দেখেন, দরজা খোলা। ভাবছেন—হয়তো আশপাশে ঘুরতে গেছে। ঠিক সময়ে চলে আসবে। এরপরও এদিকে সেদিক তাকিয়ে কয়েকবার ডাক দেন। আওয়াজ মিলে না, তাই সন্দেহ বাড়ে। এবার উচ্চৈঃস্বরে ডাকেন। তাও না। বিড়বিড় করে বলেন, হারামিরা গেল কই? ঘরের ভেতর ঢুকে দেখেন সব ঠিকঠাক আছে। শুধু তারাই নেই। মমিনুর গত দুই দিন তাদের সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো স্মরণ করেন। এত তাড়াতাড়ি এসব স্মৃতি হয়ে যাবে! নাহ্! এমনটা হতে দেয়া যায় না। তাই স্ত্রীর নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে তাদের খুঁজতে বের হলেন।


পরিমল বলে, অহন পথ ধরলে মমিনুর কাকু আমগরে খুঁইজ্যা বাইর করব। এরপর বাড়িত লইয়া যাইব। হের বাড়িত আমরা ভালা থাহুম, কিন্তু মা আর জহর কাকুর সামনে খাড়ইতে পারুম না। একবারেরলই অইলেও হেগো সামনে যামু।

পরিমল, ভারতের কেউ যদি আমগরে জাগা না দেয়?

মমিনুর কাকুর বাড়ি আবার চইল্যা আমু। মুসলমান অইয়া যামু।

পরিমলের চোখ বড় হয়, মুচকি হাসে। আর ভাবে, এই ভাবনাটা আমার মাথায় এলো না কেন!

অহনে যাইতে অইব। তয় সোজা ঢাক্কার রাস্তায় না যাইয়া অন্য পথ ধরন দরকার।

দক্ষিণ দিকে গেলে চাঁদপুর লঞ্চঘাট। উত্তর দিকে মাছুয়াখাল আর গৌরিপুর। সেখান থেকে বাসে ঢাকা যাওন যায়। হারাধন কয়, আমরা পূর্বের দিকে যাইতে থাহি। যেই কথা সেই কাজ। ধনারপাড় মোড় এসে দাঁড়ায় দুই ভাই। সিদ্ধান্তহীনতায় আবারও পড়ে। যাবে কোন দিকে। শেষে সোজা পূর্ব দিকে হাঁটা শুরু করে। দগরপুর এসে খিদে পায়। চায়ের দোকান থেকে হালকা খাবার খেয়ে আবার হাঁটা শুরু। কিন্তু, এতটা পথ তো হাঁটা যায় না! দেখে একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা পাড়ে বাঁধা। সেখানে ওঠে বসে তারা। মাঝি আসছে—তা দেখে দুই ভাই পাটাতনের নিচে লুকায়। মাঝি নৌকায় উঠে ততক্ষণে ইঞ্জিন চালু দেয়। নৌকা কিছুক্ষণ চলার পর পাটাতন উলটিয়ে বের হয় হারাধন আর পরিমল। তা দেখে অবাক হয় মাঝি! তোরা ক্যাডায় রে? কেমনে আইলি এইহান?

হারাধন বলে, আমরা হাওয়া থেইক্কা আইছি হাওয়ায় মিইশ্যা যামু।

মাঝি বলে, কথা ঠিক ঠিক ক দেহি নাইলে নামাইয়া দিমু।

আগে কন, এই নৌকা যাইব কোন দিগে?

পয়ালি বাজার যামু।

তোরা যাবি কই?

আমরাও হেদিগেই যামু।

ততক্ষণে দুপুরের খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। হারাধনকে কাছে ডাকে মাঝি। বৈঠা ধরে বসতে বলে। কয়ডা ভাত খাইয়্যা লই। এবার দুই ভাইয়ের পেটে কামড় দেয় চিন্তা নামক কীট! হারাধন বলে, এখন কী অইব! পরিমল বলে, এত চিন্তার কী আছে। ধরতে আইলে পানিতে ঝাঁপ দিমু।

কথা তো এইডা না রে, মানুষটায় অহন খাইব কী?

দাদা, বেকের খাওনের চিন্তা মাতায় আনলে আমগরে দিয়া কিচ্ছু অইব না। অহন আমার চিন্তায় আমি আর আপ্নে ছাড়া কেউই না।

আমরা তো হের খাওনডা শেষ কচ্ছি।

সকাল থেকে মেশিন নষ্ট ছিল। তাই আর ভাড়া টানা হয় না, ঠিক করতে করতে সময় লেগেছে কয়েক ঘণ্টা। ছোট ছেলে বাবাকে খাবার দিয়ে গেছে। ইচ্ছা ছিল পয়ালি গিয়েই খাবে। সেই খাবার নেই! খাবার গেল কই? নিশ্চয়ই এই হারামজাদা দুইটায় খাইছে! মাঝি চোখ বড় করেই তাদের দিকে তাকায়। ততক্ষণে পানিতে ঝাঁপ দেয় দুই ভাই!


পাঁচ.
বদরপুর গ্রামে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে তখন। দুই ভাই এই এলাকায়। জোড়পুলের টং-দোকানির কাছে খবর নিয়ে জানতে পারে আশপাশে মন্দির নেই। তবে পাশেই বদরপুর মাদরাসা মসজিদ। তাই রাতে সেখানে থাকার মনস্থির করে। ভাবনায় আর কোনো বিচ্যুতি ঘটে না। স্থানীয় মুসল্লিরা এশা আদায় শেষে বাড়ি ফিরলে দুই ভাই মসজিদে প্রবেশ করে। সারা দিনের ক্লান্ত শরীর। এক ঘুমে রাত পার। মোয়াজ্জিন ফজরের আজান দিতে আসেন। তাদের দেখে পরিচয় জানতে চান। পরিমল কিছুই না ভেবে বলে—আমি আবদুল কাদির। তখন হারাধন বলে, আমি ওসমান। দূর থেকে এসেছি। রাতে কোথাও থাকার জায়গা না পেয়ে এখানে ছিলাম।

মোয়াজ্জিন বলেন, ভালা কচ্ছ। ফজরে মুসল্লি কম অয়। অহন অজু কইরা আইয়ো। একলগে ফজর আদায় কইরা নাশতা খামু।

হারাধন মাথা নাড়ে। পরিমল বলে, এত্ত তাড়াতাড়ি?

বাবারা, সকালে তাত্তাড়ি খাইতে অয়। এরপর জমিনে যাইতে অইব কাম কত্তে।

পরিমল ভাবে, অহন খাইতে পাল্লে দুপুরের আগে চিন্তা করন লাগব না। ততক্ষণে সূর্য উঁকি দেয়। আলোকিত হয় পৃথিবী। মোয়াজ্জিন তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হয়। এরপর নাশতা সারে। মোয়াজ্জিন সাহেবের বাড়িটা পছন্দ হয় পরিমলের। ছিমছাম। নাশতা খাওয়া শেষে দুই ভাই বিদায় নেয়। হাঁটতে শুরু করে ঢাকার রাস্তায়। উঠে বসে গরুর গাড়িতে। গৌরিপুর বাস স্টেশনে এসে থামে সেটি। গাড়ি তো চাইলেই আর মিলে না। একটা গাড়ির জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। হঠাৎ হঠাৎ এক-দুইটা এলেও তাদেরকে উঠাতে চায় না কেউ। হেল্পারদের ভাবনা এরা ভাড়া দেবে না। একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে পরিমল গাড়ির নিচের বডিতে ঝুলতে শুরু করে। গাড়ি যখন টান দেয় ভয় পেয়ে চিৎকার করে পরিমল। হেল্পার তখনও গাড়িতে ওঠে না। তার কানে চিৎকার যায়। ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে সংকেত দেয়। তাকিয়ে দেখে নিচে ঝুলছে একটি বাচ্চা ছেলে। ধমক দেয় তাকে। কিন্তু সে বের হয়ে আসে না। কান্না করে বলে, আমারে ঢাক্কা নেওন লাগব। হেল্পারের মায়া হয়। এরপর ছাদে তুলে দেয়। পরিমল ছাদে উঠে খুশি। কারণ, এখানেই আছে তার দাদা হারাধন।


ছয়.
ড্রাইভার গাড়ির গতি হারিয়ে ফেললে অন্য গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা খায় পরিমল। এতে কপাল ও চোখে ব্যথা পায় সে। পরনের পাঞ্জাবি ছিঁড়ে কপাল ও চোখ বেঁধে দেয় হারাধন। গাড়ি চলন্ত অবস্থায় কোথায় চিকিৎসা করবে সে জানে না। গুলিস্তান এসে বাস থামে। ড্রাইভার এগিয়ে এসে বলে—দ্রুত ঢাকা মেডিকেল নিয়ে যাও। নয়তো সে আরও বেশি অসুস্থ হয়ে যাবে। চোখটাও নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তোমার বাপ-মা কোথায়?

হারাধন বলে, বাবায় মইরা গেছে।

মা কোথায়?

কাকুর লগে ভাইগ্যা গেছে। মারে খোঁজনের লই ভারত যাইত্যাছি।

ড্রাইভার কোনো কথা না বাড়িয়ে পকেট থেকে পাঁচ টাকা বের করে হারাধনের হাতে দেয়। বলে, দ্রুত ওরে চিকিৎসা করা। হারাধন ভাইকে কাঁধে নিয়েই হাঁটা শুরু করে। সামনে যাকে পায় তার কাছেই বলে, ও ভাই, ঢাকা মেডিকেল আর কত দূর? সবাই বলে, ওই তো ঢাকা মেডিকেল। ওই তো...আর কিছুদূর হাঁটো। পেয়ে যাবে। দুঃসময়ের পথ শেষ হতে চায় না, টের পায় হারাধন।

হাসপাতাল গিয়ে কান্নাকাটি শুরু করে হারাধন। তাড়াতাড়ি ভাইয়ের চিকিৎসা করা দরকার। জরুরি বিভাগে নেয়া হয় পরিমলকে। বাইরে বসে কান্না করছে হারাধন। পৃথিবীতে এই ভাইডা ছাড়া আপন কেউ নাই আমার! ভাইডারে হারাইতে চাই না। চিকিৎসা চলে অনেক দিন। হারাধনের ইচ্ছা ছোট ভাই আগের মতোই দেখতে পাবে। আমাকে দেখতে পাবে। কিন্তু ডাক্তার জানায়, ভিন্ন কথা! যা শোনা মাত্রই ভেঙে পড়ে হারাধন। কী করবে কিছু বুঝতে পারছে না সে। ইতোমধ্যে হাতের টাকা খরচ হয়ে গেছে। কীভাবে যশোর বেনাপোল যাবে জানে না। পরিমল বলে, এইহানে থাহি আমি। আপনে গিয়া মার খোঁজ করেন। জহর কাকুর খোঁজ করেন। সুস্থ অওনের পর ডাক্তার ছাইড়্যা দিলেও আমি হাসপাতাল থাহুম। আপনে আইলেই লগে যামু। 


সাত.
পরিমল দিনের পর দিন ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করে। ভাই আর ফেরে না। এদিকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও তাকে ছেড়ে দিয়েছে। অন্ধ চোখ নিয়ে পরিমল কোথায় যাবে জানে না। কিন্তু অন্ধ হলেও তো খেতে হবে। তা দেবে কে? ঘটনাক্রমে পরিমল ভিক্ষুকচক্রের হাতে পড়ে। এই চক্রটি ছিল উগ্রবাদী। পালটে ফেলে পরিমলের পোশাক। চোখে পরানো হয় কালো চশমা, সাদা পাঞ্জাবি, পায়জামা। মাথায় বসিয়ে দেয়া হয় একটি টুপি। পরিমল অমত করল না। বরং মেনে নিল নিয়তি। তারা নতুন নাম রাখতে চাইল আবদুল্লাহ। তখন পরিমল বলে, আমার একটা মুসলমান নাম আছে। আবদুল কাদির। আমার পছন্দের নাম।

আমাদের দলে কাদির নামে আরও দুজন আছে যে।

তাহলে আমি কাদির নম্বর তিন। বলতে পারেন—কানা কাদিরও। কানা কাদিরের জীবনে বেশ কয়েকবার মহাজনের বদল ঘটলেও ভাগ্যের আর বদল ঘটে না। সে নিজেও ভাগ্যের বদল ঘটাতে চায় না—তার একমাত্র অপেক্ষা ভাই হারাধনের জন্য।

বাঙালির জীবনে সাতচল্লিশের পর একাত্তর আসে, তবু ফিরে আসে না হারাধন। অথচ নব্বই বছর বয়স্ক পরিমল এখনও অপেক্ষা করছে।

তখনই একটি কবুতর উড়ে এসে কমলাপুর রেলওয়ে ব্রিজের রেলিংয়ে বসে। এদিক-সেদিক তাকায়। এরপর আবার উড়তে শুরু করে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামার পরও উড়ছে...