ঢাবির হলে ‘গণরুম সংস্কৃতি’ কি বন্ধ হবে?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) আবাসিক হলগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ‘গণরুম সংস্কৃতি’ বিলুপ্ত করতে আলোচনা চলছে জোরেশোরেই। কিন্তু এ অভিযোগও চর্চায় আছে যে, গণরুমগুলো মূলত নিয়ন্ত্রণ করে বিভিন্ন রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলো। ছাত্র সংগঠনের নেতারা গণরুমের শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করেন বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নে। হলের রাজনীতিতে নিজের অবস্থান শক্ত করতে তারাই সিট পাইয়ে দেন অনুগামীদের। তাই রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলোর ছত্রচ্ছায়ায় এই সংস্কৃতি বন্ধ হবে কিনা তা নিয়েও আশঙ্কা আছে, যা ক্রমেই বাড়ছে।

করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে দীর্ঘ প্রায় দেড় বছর বন্ধ থাকার পর হলগুলো সম্প্রতি চালু হয়েছে। আর নতুন করে হল চালুর প্রস্তুতির সময় থেকে এই গণরুম সংস্কৃতি বন্ধে উদ্যোগ নিয়েছে ঢাবি প্রশাসন। সহযোগিতা কামনা করেছেন সকল ছাত্র সংগঠনগুলোর। ছাত্র সংগঠনগুলোকে নিয়ে বৈঠকও করেছে প্রশাসন। সেই বৈঠকে গণরুম বন্ধসহ ছাত্রত্ব শেষ হয়ে যাওয়াদের হল ছাড়ার বিষয়েও আলোচনা হয়। এসব বিষয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগসহ প্রগতিশীল সকল ছাত্র সংগঠনগুলো প্রশাসনকে সর্বোচ্চ সহযোগিতার আশ্বাসও দেয়।

সব মিলিয়ে এবার অন্তত হলের সিট সংকট কিছুটা কমার প্রত্যাশায় ছিল সাধারণ শিক্ষার্থীরা। কিন্তু ৫ অক্টোবর শর্তসাপেক্ষে অনার্স চতুর্থ বর্ষ ও মাস্টার্সের শিক্ষার্থীদের জন্য হল খুললেও সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, সার্জেন্ট জহুরুল হক হল, হাজী মুহাম্মদ মহসিন হলে অবস্থান করতে দেখা যায় ছাত্রত্ব শেষ হয়ে যাওয়া ছাত্র সংগঠনের নেতাদের। আগামী ১০ অক্টোবর থেকে বাকি আবাসিক শিক্ষার্থীদের হলের ওঠার সিদ্ধান্ত জানানো হলেও বঙ্গবন্ধু হল, সূর্য সেন হল ও জগন্নাথ হলে অবস্থান করতে দেখা যায় এই সকল বর্ষের ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের কর্মীদের। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. মো. আকরাম হোসেন বলেন, ওরা হয়তো রুম ক্লিনিংয়ের জন্য এসেছে। হলের গেটে শিক্ষার্থীরা নাম এন্ট্রি করে তারপর এসেছে। ক্লিনিং শেষে তারা চলে যাবে।

১০ অক্টোবর থেকে বাকি শিক্ষার্থীদের হলে ওঠার বিষয়ে জানতে চাইলে বিজয় একাত্তর হলের প্রভোস্ট ও প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ড. আবদুল বাছির বলেন, ‘১০ তারিখ থেকে আবাসিক শিক্ষার্থীরা হলে উঠবে। গণরুমের শিক্ষার্থীরা এখনও হলের আবাসিক শিক্ষার্থী না। শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে এলে তাদের সিট বরাদ্দের তালিকা হলের নোটিস বোর্ডে টাঙিয়ে দেওয়া হবে। তারপর তারা হল ফি দিয়ে ভর্তি হয়ে স্ব-স্ব রুমে থাকবে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখবো। আমরাও চাই না গণরুম থাকুক। গণরুম সংস্কৃতি বিলুপ্তির জন্য আমরা অবশ্যই প্রশাসনকে সহযোগিতা করতে চাই। সেজন্য আমরা বলেছি, প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের জন্য যেন নিয়মতান্ত্রিকভাবে হলে সিট বরাদ্দ নিশ্চিত করে। এটার সঙ্গে আনুষাঙ্গিক অনেক বিষয় জড়িত। এই শর্তগুলো পূরণ সাপেক্ষে সবার সহায়তা নিয়ে যেন সিট বরাদ্দ দেওয়া হয়। সে জন্য আমরা বাংলাদেশ ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে অবশ্যই সহায়তা করবো এবং সংশ্লিষ্ট সকলেই যেন সহায়তা করে সে ব্যাপারেও আমরা সচেষ্ট আছি।

গণরুম-২

সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সালমান সিদ্দিকী বলেন, প্রশাসন বলছে গণরুম থাকবে না। কিন্তু গণরুমে যেসকল শিক্ষার্থী ছিল তাদের আবাসন কীভাবে নিশ্চিত হবে- এখন পর্যন্ত সে ধারণা তাদের কাছে নাই। আমরা বিভিন্ন সময় দেখেছি গণরুম বিলুপ্ত করতে প্রশাসন উদ্যোগ নিয়েছে কিন্তু তাদের সহযোগিতা নিয়েই গণরুমগুলো টিকেছিল। আমরাও চাই গণরুম না থাক এবং একজন শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ার পর প্রশাসনের তার আবাসন নিশ্চিত করা উচিৎ ছিল। সেটা কিন্তু প্রশাসন এখনো করতে পারছে না। 
গণরুম বিলুপ্ত করতে হলে শিক্ষার্থীদের আবাসন নিশ্চিত করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলে থার্ড ইয়ার পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা আবাসিক না। তাহলে এতোদিন যারা গণরুমে ছিল তাদের হলের বাইরে রেখে আসলে গণরুম বিলুপ্ত হল না। ছাত্রলীগের যে দখলদারিত্বের রাজনীতি, ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি, পেশীশক্তি নির্ভর রাজনীতি- এই রাজনীতিকে টিকিয়ে রাখতে প্রশাসন তাদের সহযোগিতা করতে চায় বলেই মুখে বললেও তা কার্যে পরিণত করেন না। 

শিক্ষার্থীদের আশঙ্কা

বিষয়টি নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করলেও প্রকাশ্যে তেমন কিছু বলছেন না শিক্ষার্থীরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিজয় একাত্তর হলের এক শিক্ষার্থী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন গণরুম উঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু আমরা ইতিমধ্যে বিভিন্ন হলের গণরুমে প্রথম বর্ষের বন্ধুদের উঠে যেতে শুনেছি। বিজয় একাত্তর হল বাদে বাকি হলগুলোতে প্রশাসনের তৎপড়তা তেমন একটা চোখে পড়েনি। প্রশাসন এখন থেকে কঠিন অবস্থানে না থাকলে আদৌ গণরুম সংস্কৃতি চর্চার বিলোপ ঘটানো সম্ভব না।

এ বিষয়ে কথা হয় সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে। তিনিও নাম প্রকাশ না করার শর্ত দিয়ে বলেন, সিদ্ধান্তটি ইতিবাচক ও শিক্ষার্থীবান্ধব। কিন্তু এটা বাস্তবায়ন করা একরকম অসম্ভব বলেই মনে করি। অন্তত যতোদিন এই হলগুলো ছাত্র রাজনীতির বলয়ে থাকবে।