জাবির সিনেটে উঠছে মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষকদের সুবিধা বাতিলের প্রস্তাব 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) কর্মরত মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ এক বছর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে অবসর গ্রহণের বয়স ৬৫ বছর নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট। শুক্রবার (২৪ জুন) বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সভায় এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন একাধিক সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় (অবসর গ্রহণ) (বিশেষ বিধান) আইন ২০১২ এর ৩ নম্বর ধারা অনুযায়ী এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’

তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষক অধ্যাপক আমির হোসেন বলছেন, সংস্থাপন মন্ত্রাণালয়ের জারি হওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের কর্মক্ষেত্রে অতিরিক্ত এক বছর কর্মরত থাকার আইন পরিবর্তনের অধিকার একমাত্র রাষ্ট্রের। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আইন মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষকদের জন্য প্রযোজ্য নয়। তার প্রমাণ ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষকদের চাকরির বয়স যথাক্রমে এক ও দুই বছর বৃদ্ধির নিয়ম। 

আমির হোসেনের কথার পরিপ্রেক্ষিতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বছর এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই বছর বৃদ্ধির নিয়ম চালু আছে।

এর আগে, গত বছরের ২৮ আগস্ট অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের বিশেষ সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবিধিবলী সংশোধন করে কর্মরত শিক্ষকদের চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের সময়সীমা নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এতে মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ এক বছর বৃদ্ধি করে ৬৬ বছর করা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের নভেম্বর ও এবছরের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক অধ্যাপক আমির হোসেনের আবেদনের প্রেক্ষিতে তার চাকরির মেয়াদ এক বছর বাড়ানো হয়। গত এপ্রিলে মেয়াদ বৃদ্ধির রেজিস্ট্রার স্বাক্ষরিত চিঠি তার কাছে পৌঁছানো হয়। কিন্তু ৯ মাসের মাথায় গত ১২ জুন অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেট সভায় চাকরির মেয়াদ বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১২’ অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধাসহ শিক্ষকদের অবসর গ্রহণের বয়স ৬৫ বছর নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

অভিযোগ উঠেছে, আগামী ৩০ জুন বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান সাময়িক উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের চাকরির মেয়াদ শেষ হবে। ইতোমধ্যে অনেক শিক্ষক উপাচার্য পদের জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন। সেই দৌড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষক, সাবেক উপ-উপাচার্য ও অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মো. আমির হোসেন এগিয়ে রয়েছেন বলে জানা গেছে। এ অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি অংশ মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত বাতিলের চেষ্টা করছেন।

এছাড়া অভিযোগ উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিজের সুবিধামতো আইনের ব্যবহার করছে। যে আইনের কথা বলে চাকরির মেয়াদ কমানো হচ্ছে, তা এত বছর কেন প্রয়োগ করা হয়নি সে বিষয়েও প্রশ্ন উঠেছে। 

এ বিষয়ে অধ্যাপক মো. আমির হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১২’ অনুযায়ী সিনেট সভায় মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত বাতিলের বিষয়ে আলোচনা করা হবে বলে জেনেছি। তবে এ আইন মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রপ্রদত্ত সুবিধা হরণ করার জন্য নয়। এতে যা আছে সবকিছু কর্মক্ষেত্র, পেশা ও প্রতিষ্ঠান বিষয়ক। 

তিনি আরও বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকার দেশের সার্বিক উন্নয়নের পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণকেও অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। তবে জাবি প্রশাসনের মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষকদের রাষ্ট্রপ্রদত্ত সুবিধা হরণ করার চেষ্টা শেখ হাসিনা সরকারের নীতি, আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী। একজন মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষক হিসেবে আমার চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর পর, তা পুনরায় হ্রাসের চেষ্টা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং বেদনাদায়ক।’

এ ‍বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, এটা অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, যেখানে রাষ্ট্রীয় নীতি হচ্ছে সরকারি-স্বায়ত্তশাসিত সব প্রতিষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরির বয়সসীমা এক বছর বর্ধিত করা হবে, সেখানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে চেষ্টা চলছে মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষককে বঞ্চিত করার। সব বিশ্ববিদ্যালয়ে এই নিয়ম মানা হলেও জাবি প্রশাসন ভর করেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর। যেখানে একই অপকর্ম করা হয়েছিল।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. দিল আফরোজা বেগম বলেন, বিষয়টি জটিল। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় আইনেও মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষকদের বিষয়ে স্পষ্ট করে বলা হয়নি। এর আগে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এরকম একটি অভিযোগ এসেছিল। তবে তা এখনও চলমান। সেটির অর্ডার হাতে না আসা পর্যন্ত কোনও মতামত জানাতে পারছি না।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক রাশেদা আখতার বলেন, যেই সিন্ডিকেটে চাকরির সময় বৃদ্ধির অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল, তাতে কিছু ভুল হয়েছে। অনলাইনে সঠিকভাবে সরকারি নির্দেশ ও কাগজপত্র যাচাই করে তা করা হয়নি। পরে ভুলগুলো ধরা পড়লে সিন্ডিকেটে উপস্থাপন করা হয়। আর অন্য বিশ্ববিদ্যালয় কী করলো তা আমাদের দেখার বিষয় নয়। আমরা রাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী চলি। এ বিষয়ে সিনেট সভার আগে আর কোনও কথা বলতে চাই না।

এ বিষয়ে জানতে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব জনাব মো. আবু বকর ছিদ্দীক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমকে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তারা রিসিভ করেননি।