জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

বছরের একদিনই মর্যাদা পায় দেশের সবচেয়ে বড় শহীদ মিনার

বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রথম সোপান হিসেবে কাজ করেছে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন। আর এই দিনে যাদের রক্তের বিনিময়ে বাঙালি জাতি পেয়েছে মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার, তাদের স্মরণে গড়ে তোলা হয়েছে স্মৃতিস্তভ। দিনটিকে পালন করা হয় মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। দিনটিকে ভাষা শহীদদের স্মরণ করে দেশের সকল স্মৃতি স্তম্ভেই অর্পণ করা হয় শ্রদ্ধাঞ্জলি। রাজধানীর অদূরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) শহীদ মিনারেও বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বস্তরের অংশীজনরা শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেন। তবে দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে, ভাষা শহীদদের প্রতি এই সম্মান শুধু দিবস কেন্দ্রিক। বছরের এই এক দিনই (২১ ফেব্রুয়ারি) সম্মান জানাতে শহীদ মিনার ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। অন্যান্য দিনে থাকে না শহীদ মিনারের যথাযথ মর্যাদা।

বলা হয়ে থাকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এই স্মৃতিস্তম্ভটিই দেশের সবচেয়ে বড় শহীদ মিনার। এর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয় ২০০৪ সালের ৬ নভেম্বর। ২০০৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক খন্দকার মুস্তাহিদুর রহমান এর উদ্বোধন করেন। ৫২ ফুট ব্যাস ও ৭১ ফুট উচ্চতার এই শহীদ মিনারের স্থপতি রবিউল হুসাইন। বায়ান্নর সকল অর্জনের সম্মানে এর ব্যাস রাখা হয়েছে ৫২ ফুট এবং একাত্তরের অবিস্মরণীয় মর্যাদার সম্মানে উচ্চতা ৭১ ফুট রাখা হয়েছে। এছাড়া আটটি সিঁড়ির উপর ত্রিভুজাকৃতির তিনটি স্তম্ভ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এ মিনারটি। স্তম্ভ তিনটি স্বাধীনতা সংগ্রামে শহীদদের ত্যাগের মহিমা প্রকাশ করছে।

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের সাথে জড়িত এই স্থাপনার মর্যাদা চোখে পড়ে শুধু আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের দিন। পুরো বছরজুড়ে অবহেলা-বঞ্চনা-অমর্যাদায় পড়ে থাকা শহীদ মিনারটি শুধু ভাষা দিবসের আগের দিন ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করা হয়। এছাড়া ভাষা দিবসের দিন যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা হলেও সারা বছর জুড়েই এর মূল বেদীতে বসে গল্প-আড্ডা, অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্ন করা, মাদকগ্রহণসহ নানান ভাবে অসম্মান করছে বর্তমান প্রজন্মের কিছু শিক্ষার্থী।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আনিছা পারভীন মনে করেন, ‘আমাদের দীর্ঘ সংগ্রাম, স্বায়ত্তশাসনসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর প্রতীক এই শহীদ মিনার। বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনে যারা ভূমিকা রেখেছে, যারা মাতৃভাষার দাবিতে নিজেদের জীবন বিসর্জন দিয়েছে তাদের স্মরণে তৈরি এই স্মৃতিস্তম্ভের রক্ষণাবেক্ষণ করা জরুরি। শুধু একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমরা তা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখবো, এমন হওয়া উচিত নয়। বরং শহীদ মিনারের ভাব-গাম্ভীর্য রক্ষা করে সারাবছরই রক্ষণাবেক্ষণ করাও আমাদের দায়িত্ব।’

সপ্তাহের ছুটির দিনগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বহিরাগতদের প্রচণ্ড ভিড় হয়। এসময় শহীদ মিনার এলাকাতে জনসমাগম হয় অনেক বেশি। এর আশেপাশে বসে বিভিন্ন অস্থায়ী খাবার ও খেলনার দোকান। নিরাপত্তা বেষ্টনী না থাকায় এসময় শহীদ মিনারের মূল বেদিতে গিয়ে মানুষজন ছবি তোলেন, আড্ডা দেন, গানের আসর বসান। তবে মূল বেদিতে জুতা নিয়ে ওঠা কিংবা বসা নিয়ে মাঝে মাঝে সচেতন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বাগবিতণ্ডার ঘটনাও ঘটে।

জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক সামি আল জাহিদ প্রীতম বলেন, ‘দেশের সবচেয়ে বড় শহীদ মিনারের অবস্থান এখানে হলেও এর ভাব-গাম্ভীর্য ও তাৎপর্য আমরা ধারণ করতে পারিনি আদৌ। সারাবছরই অবহেলার শিকার হচ্ছে এটি। অতিরিক্ত বহিরাগত আগমন, মূল বেদিতে জুতা পায়ে বসে থাকা, বাদামের খোসা, খাবারের উচ্ছিষ্টাংশ ফেলে শহীদ মিনার ও এই প্রাঙ্গণ নোংরা করে রাখা জানান দেয় কতটা উদাসীন আমরা।’

তিনি মনে করেন, ‘আমাদের মাথানত না করার শিক্ষা দেয় শহীদ মিনার। আমাদের সবার নিজ জায়গা থেকে আরও বেশি সচেতন হওয়া প্রয়োজন। আমাদের সকলের উচিত শহীদ মিনারের প্রকৃত ভাব-গাম্ভীর্য ও পবিত্রতা রক্ষায় মনেপ্রাণে একুশের চেতনা ধারণ করা।’

জাবি-শহীদ-মিনার-ি02

বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর কর্মসূচির প্রাণকেন্দ্র এই শহীদ মিনার। মাঝে মাঝে বিভিন্ন সামাজিক এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর নিজ উদ্যোগে শহীদ মিনারে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা করতে দেখা যায়। তবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শহীদ মিনারের চারপাশে কোনও নিরাপত্তা বেষ্টনী না থাকায় প্রতিনিয়ত মর্যাদা হানি হচ্ছে শহীদ মিনারটির।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরতে আসা আহসান হাবিব বলেন, ‘মাঝে মাঝেই এই ক্যাম্পাসে আসি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষার্থীদের অযত্ন-অবহেলার শিকার হচ্ছে শহীদ মিনারটি। অনেকে মূল বেদীতে উঠে শুয়ে-বসে থাকছে। ভাবতেই অবাক লাগছে এই করুণ অবস্থা দেখে।’

গত এক সপ্তাহ ধরে শহীদ মিনার এলাকা পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, শহীদ মিনারের মূল বেদিতে জুতা পায়ে কেউ কেউ গল্প-আড্ডা করছে। এদের অধিকাংশই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। আবার কেউ কেউ ছবি তুলছে। কেউ কাটছেন জন্মদিনের কেক। আবার কেউ বসে বসে ধুমপানের জন্য এই জায়গাটিকেই বেছে নিয়েছেন।

এমন কর্মকাণ্ডে শহীদ মিনারের অসম্মান হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে তাদের অধিকাংশই কথা বলেননি। তবে দুয়েকজন তাদের ‘ভুলের’ কথা স্বীকার করে ‘ভবিষ্যতে এমন হবে না’ বলে জানান।

শহীদ মিনারের নিয়মিত তত্ত্বাবধানের বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদ শাখার পরিচালক মো. আব্দুর রহমান সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘আমাদের সম্পদ শাখায় যথেষ্ট জনবল নেই। পুরো ক্যাম্পাসজুড়ে মাত্র তিন জন লোক কাজ করে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়তন তো ছোট নয়। এজন্য অনেক সময় সম্পদের ক্ষয়-ক্ষতি হয়। তবে এসব জনগুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব প্রশাসনের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এজন্য শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং দর্শনার্থীদের নিজ উদ্যোগ ও সচেতনতার বিকল্প নেই।’