নিখোঁজ কাহিনী

দুই ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলতে বলতে চলে যান প্রকৌশলী রাহাত

রাহাত বিন আব্দুল্লাহরাজধানীর মোহাম্মদপুরের চন্দ্রিমা হাউজিংয়ের একটি নির্মাণধীন ভবনের প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করতেন রাহাত বিন আব্দুল্লাহ। থাকতেন পাশেরই এক বাসায় সাবলেটে। গত মাসের ১৮ তারিখে নিখোঁজ হন তিনি।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন,সেদিন কর্মস্থলে বসে ছিলেন রাহাত। সকাল ১১টার দিকে হঠাৎ দুই ব্যক্তি তার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে কর্মস্থল থেকে চলে যান রাহাত। এরপর থেকে তার আর কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। যার ভবনের নির্মাণ প্রকৌশলী হয়ে কাজ করতেন রাহাত, তিনি মোহাম্মদপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছেন। ঘটনার এক মাস পেরিয়ে গেছে, কিন্তু খোঁজ মেলেনি রাহাতের। মঙ্গলবার সন্দেহভাজন জঙ্গি হিসেবে নিখোঁজ থাকা র‌্যাবের তালিকায় পাওয়া গেছে রাহাতের নাম।

গতকাল সরেজমিন চন্দ্রিমা হাউজিংয়ের ই ব্লকের ১০ নম্বর সড়কের ১০ নম্বর নির্মাণধীন ওই বাসায় কথা বলে নানারকম তথ্য পাওয়া গেছে। নির্মাণাধীন ওই ভবনের ঠিকাদার আমিনুল ইসলাম জানান,গত ১৮ জুলাই সকালে রাহাত বিল্ডিংয়ের নিচতলায় চেয়ারে বসেছিলেন। এসময় মধ্য বয়সী এক ব্যক্তি ও এক তরুণ তার সঙ্গে এসে কথা বলেন। তারপর তাদের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে ১০ নম্বর সড়ক ধরে এগিয়ে যান  রাহাত। তারা এমনভাবে কথা বলছিলেন যেন আগে থেকেই পরিচিত। ১০ নম্বর সড়ক ধরে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পর আর ফিরে আসেননি রাহাত। এরপর থেকে তার মোবাইল ফোনও বন্ধ রয়েছে।

আমিনুল ইসলাম জানান,মোবাইল ফোন বন্ধ পেয়ে তিনি বিষয়টি ভবন মালিক আলী আশরাফ, রশীদ ও মোকলেসুর রহমানকে জানান। তারা বিষয়টি পুলিশকে জানান। ওইদিন সন্ধ্যায় মোহাম্মদপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন তারা। কিন্তু পুলিশ তাকে আর খুঁজে পায়নি।

কর্মস্থলের পাশেই এক বাসায় থাকতেন রাহাত বিন আব্দুল্লাহ। তার সঙ্গে একই কক্ষে থাকতেন আল-আমিন। আল-আমিন জানান, নিখোঁজ হওয়ার তিন মাস আগে থেকে তারা এক সঙ্গে একই রুমে থাকতেন। রাহাত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। অন্যদের ধর্ম-কর্ম করার পরামর্শ দিতেন। কিন্তু তিনি হঠাৎ করে একদিন নিখোঁজ হয়ে গেলেন। কেন তিনি নিখোঁজ হলেন বা কোথায় গেলেন তা অনুমান করতে পারছেন না তিনিও।

আল-আমিন জানান,রাহাত দু’টি মোবাইল ফোন ব্যবহার করতেন। নিখোঁজ হওয়ার দিন তার দামি মোবাইলটি ঘরে চার্জে দেওয়া ছিল। সঙ্গে আরেকটি মোবাইল ছিলো, সেটিও বন্ধ হয়ে যায় কিছুক্ষণের মধ্যেই।রাহাত বিন আব্দুল্লাহ

বাসার কেয়ারটেকার মাসুদুর রহমান জানান, রাহাত খুব ভালো ছিলেন। ভদ্র ও শান্তশিষ্ট। নামাজ-কালাম পড়তেন। আমাদেরও পড়তে বলতেন। কিন্তু কখনও জোরাজুরি করতেন না। এরকম একটি ছেলে হঠাৎ নাই হয়ে যাবেন, তা কোনওভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।

রাহাতের কর্মস্থলের এক শ্রমিক জানান,ঘটনার দিন রাহাতের সঙ্গে যে দুই ব্যক্তি দেখা করতে আসেন,তাদের চিনতেন না তিনি।রাহাত এসময় বলেন,আমি তো আপনাদের চিনি না, আমি আপনাদের সঙ্গে যাবো কেন? তারপরেও তাদের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে বলতে যেতে দেখা যায়। ওই দুই ব্যক্তি তাকে জোর করে কিন্তু তুলে নিয়ে যায়নি।

নিখোঁজ রাহাতের বাবা শেখ আব্দুল্লাহ বিন আকবর পেশায় স্কুল শিক্ষক। থাকেন যশোরের কতোয়ালী থানার বাবলাতলী রোডের শেখহাটি এলাকায়। মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, 'আমি বুঝতে পারছি না আমার ছেলে কোথায় গেছে। সব কিছুই তো স্বাভাবিকভাবে চলছিল। হঠাৎ করে জানতে পারলাম ছেলে আমার নিখোঁজ। আমরা দৌঁড়ে ঢাকায় গেলাম। থানা-পুলিশ করলাম। কিন্তু রাহাতের কোনও খোঁজ পেলাম না।'

রাহাতের বাবা আরও বলেন, ‘গত বছর ছেলেটা বিয়ে করেছে। তার স্ত্রী রেহানা সন্তান সম্ভাবা। এমন সময়ে ইচ্ছে করেই তার নিখোঁজ হওয়ার তো কথা না। শুনেছি নিখোঁজ হওয়ার আগের দিন ঠিকাদারের সঙ্গে তার ঝামেলা হয়েছিলো।’

স্বজনেরা জানান, দুই ভায়ের মধ্যে বড় রাহাত যশোরের পুলিশ লাইন্স স্কুল থেকে ২০০৭ সালে এসএসসি পাস করেন। এরপর ভর্তি হন যশোর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে। ২০১১ সালে সেখান থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটিতে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হন। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজও করতেন। চন্দ্রিমা হাউজিংয়ের ব্যক্তি মালিকানাধীন ওই ভবনের নির্মাণ প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দেওয়ার আগে একটি ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানে সাইট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করেছেন।

রাহাতের নিখোঁজের জিডির তদন্তাকারী মোহাম্মদপুর থানার এসআই বুলবুল জানান, রাহাতের মোবাইল ট্র্যাকিং করে দেখা গেছে ঘটনার দিনি তিনি শ্যামলী পর্যন্ত গিয়েছিলেন। এরপর থেকে তার মোবাইল বন্ধ হয়ে যায়। তার নাম ও ছবি দিয়ে সকল ইমিগ্রেশনে বার্তা পাঠানো হয়েছিলো। কিন্তু তিনি দেশের বাইরে চলে গেছেন এমন কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি।

এসআই বুলবুল আরও জানান, রাহাতের ফেসবুক ঘেঁটে ইসলাম ধর্মীয় অনেক পোস্ট দেখা গেছে। যা সাম্প্রতিক জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে মিল রয়েছে।

এই প্রতিবেদক নিজেও রাহাতের ফেসবুক ঘেঁটে এমন অনেক পোস্ট দেখতে পান যেখানে কোরআন হাদীসের নানারকম বাণী উল্লেখ রয়েছে। এছাড়া, রাহাতের এক স্বজন লিখেছেন, আব্বু তুই কোথায় আছিস কেমন আছিস? সারাদিন বুকের ভেতর হাহাকার আব্বু তুই কোথায় আছিস কেমন আছিস, ভাল থাকিস ভাল রাখো আল্লাহ ওকে ভাল রাখো।

আরও পড়ুন-

টঙ্গীতে জঙ্গি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে র‌্যাবের অভিযান, জেএমবি'র দক্ষিণাঞ্চল প্রধানসহ ৪ জঙ্গি আটক

জঙ্গি হামলার ঝুঁকিমুক্ত নয় মসজিদ-মাদ্রাসা-দরগা

নিখোঁজ তরুণদের নিয়ে চুপ থাকার পরামর্শ জঙ্গি পাতায়!

/এনএল/এমএসএম/আপ-এফএস/