জঙ্গিবাদ নির্মূলে গণমাধ্যমকে আরও সতর্ক হতে হবে

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সবার সম্মিলিত চেষ্টায় যেমন স্বাধীনতা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে, ঠিক তেমনই আবারও এক হয়ে জঙ্গিবাদ নির্মূলে কাজ করতে হবে। এখন দরকার সরকার ও জনতার যৌথ আন্দোলন। শুধু স্যোশাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে জঙ্গিবাদ নির্মূল করা সম্ভব না। চলমান জঙ্গি সংকটের প্রেক্ষাপটে সোশ্যাল মিডিয়া, তার যোগসূত্র ও ভূমিকা বিষয়ে বাংলা ট্রিবিউনের বিশেষ বৈঠকিতে বক্তারা এসব কথা বলেন।

বাংলা ট্রিবিউন বৈঠকি

‘সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে জঙ্গিবাদ’ শীর্ষক এই বৈঠকিতে বক্তারা বলেন, মূলধারার গণমাধ্যমকে আরও বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে হবে। কেননা, সন্দেহের জায়গা থেকে স্যোশাল মিডিয়ার ওপর নির্ভরশীলতা তৈরি হয়। বক্তারা বলেন, জঙ্গিরা অনেক বেশি সংঘবদ্ধভাবে এবং সক্রিয়ভাবে তাদের কর্মকাণ্ডগুলো স্যোশাল মিডিয়া পরিচালনা করে কিন্তু তার পাল্টা জবাবের জায়গায় এখনও দ্বিধাবিভক্তি রয়ে গেছে।

বিজিবি’র মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ

বৈঠকিতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-র মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ বলেন, জঙ্গিবাদবিরোধী প্রচারণায় গণমাধ্যমে ইতিবাচক ভূমিকা আছে। তবে কোনও কোনও ক্ষেত্রে জঙ্গিবাদ বিস্তৃতি ঘটাতে কিছু গণমাধ্যম সহায়তাও করছে। মনে রাখতে হবে, জঙ্গিদের টার্গেট ছিল প্রচার পাওয়া। তাই এ ব্যাপারে গণমাধ্যমকর্মীদের আরেকটু সংহত হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। এ প্রসঙ্গে পাশের দেশ ভারতের উদাহরণ টেনে বিজিবি’র মহাপরিচালক বলেন, ‘আমরা যখন একটা সংকটের সময় পার করছি তখন সতর্ক হওয়া এবং সহায়ক ভূমিকার দরকার আছে।’

আবু সায়িদ খান

স্যোশাল মিডিয়া কোনওভাবে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব কিনা এমন প্রশ্নে নেতিবাচক উত্তর দিয়েছেন টেলিকম বিশেষজ্ঞ আবু সায়িদ খান। তিনি বলেন, ‘তারা ( সোশ্যাল মিডিয়া) বাংলাদেশে সরকার কেন কারও কথাই শুনবে না। সম্প্রতি অ্যাপল আমেরিকান সরকারের কথা শুনতে চায়নি। এটা তাদের ব্যবসা। মনে রাখতে হবে, ফেসবুক-গুগলকে তখনই গভার্নেন্সের আওতায় আনতে পারবেন যখন তারা বাংলাদেশে বসে ব্যবসা করবে। যেহেতু এদেশে তাদের শারীরিক উপস্থিতি (অফিস অর্থে) নেই, তারা বাংলাদেশ সরকারের কথা শুনতে বাধ্য নয়।’

তিনি বলেন, তবে তাদের নিজস্ব যে মনিটরিং (পর্যবেক্ষণ) রয়েছে তার আওতায় স্পর্শকাতর বা উদ্দেশ্যমূলক কনটেন্ট নজরে এলে তারা সেটা ডিলিট করে (মুছে দেয় )। মূলধারার মিডিয়াগুলোতে জনগণের কাছে তাদের গুরুত্ব বিশ্বাসযোগ্যভাবে তুলে ধরতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা এখনও তাদের সঠিক প্রচার সংখ্যাটিই জানতে পারি না। জনগণের এটা জানা থাকা জরুরি।

একাত্তর টিভির পরিচালক (বার্তা) সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা

মূলধারার মিডিয়ায় অনুধাবনের জায়গায় সমস্যা আছে উল্লেখ করে একাত্তর টেলিভিশনের পরিচালক (বার্তা) সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বলেন, নানা সময়ে কোনও কোনও মূলধারার মিডিয়ার উস্কানি ছিল। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রায় প্রতিটা মিডিয়ার স্যোশাল মিডিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ততা আছে। মূলধারার মিডিয়ার কোনও কোনও ক্ষেত্রে অনিচ্ছাকৃত দায়ভারও আছে। অনেক ক্ষেত্রে তারা সামিল হয়েছে দেরিতে এবং এখনও সংঘবদ্ধ হতে পারেনি।

অধ্যাপক জিয়া রহমান

বৈঠকিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. জিয়া রহমান বলেন, ইন্টারনেট মনিটরিং এর দরকার আছে। পশ্চিমাদেশগুলোতে মাল্টিকালচারিজমের মধ্যে একক সংস্কৃতি হারালেও তারা কিন্তু তাদের মূল্যবোধ লালন করে। আমাদের এখানে কমিটমেন্টের অভাব আছে। জঙ্গিবাদের উত্থানে যারা কাজ করছে তাদের যে কমিটমেন্ট এবং তাদের যে সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা সেটাকে পাল্টা আঘাতের কোনও জায়গা তৈরি হয়নি। সেই জায়গাটা তৈরি করতে হবে।

বাংলা ট্রিবিউনের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক জুলফিকার রাসেল

বাংলা ট্রিবিউনের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক জুলফিকার রাসেল জঙ্গিবিরোধী কনটেন্টের ক্ষেত্রে জঙ্গিদের যে সংঘবদ্ধ অনলাইন আক্রমণ তার উল্লেখ করে বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সংখ্যাগত বিশালতার কারণে তাদের সঙ্গে পেরে ওঠা কঠিন হয়।কিন্তু আমরা নিজস্ব কৌশলে সেটা প্রতিহত করার চেষ্টার মধ্যে আছি।

সুমন আহমেদ সাবির

তথ্য প্রযুক্তিবিদ সুমন আহমেদ সাবির বলেন, এখন ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণের কথা বললেই সম্ভব হবে না। কোনটা আমাদের সমাজের জন্য খারাপ সেটাকে বৈশ্বিকভাবে বোঝানোর সক্ষমতা তৈরি করতে হবে। গুগল, ফেসবুক এবং আমরা মিলিয়ে একাত্ম হতে পারলে সম্ভব, তবে সেটা কঠিন। এর সঙ্গে রাজনীতি জড়িত। কিছু মানুষতো চাইছে প্রচার হোক। তিনি আরও বলেন, সেক্ষেত্রে আমার মনে হয়, শিক্ষার জায়গাটায় কোনটা গ্রহণ করব বা করবো না সেটার দিকে জোর দিতে হবে।

আরিফ জেবতিক

ব্লগার ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট আরিফ জেবতিক বলেন, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদকে সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে মূলধারার মিডিয়ার ব্যর্থতা ছিল কিনা আলাপ করা জরুরি। আমরা ২০১৩ সালে ‘আমার দেশ’ পত্রিকাকে নিয়ন্ত্রণ করতে বলার তিন মাস পর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। যখন জঙ্গিবাদের সুস্পষ্ট মদদদাতাকে গ্রেফতার করা হলো বাংলাদেশের ১৬ সম্পাদক বিবৃতি দিয়েছিলেন। ইতিহাস তাদের ক্ষমা করবে না।পরবর্তী হত্যাকাণ্ডের রক্ত এই সম্পাদকদের হাতে লেগে আছে বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি। মিডিয়াকে গণমাধ্যম হিসেবে গড়ে উঠতে হবে। তরুণদের জন্য খেলার মাঠ নাই, টিএসসিতে কিছু করতে দেওয়া হয় না। তরুণ সমাজ করবেটা কি?

মিথিলা ফারজানা

মিথিলা ফারজানার সঞ্চালনায় বৈঠকিতে অংশ নিয়ে বক্তারা আগামী সময়ে করণীয় বিষয়ে আলোচনাকালে বলেন, সমাজের প্রতিটা ক্ষেত্রে জঙ্গিবাদের প্রসার বন্ধে কার্যকর ভূমিকা নিতে জনসম্পৃক্ততা নিশ্চিত করতে হবে। ১ জুলাই গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারি রেস্তোরাঁয় হামলার পর কল্যাণপুরের অভিযানের মধ্য দিয়ে জনগণের মধ্যে কাউন্টার টেররিজমের ধারণা পরিপক্কতা পেয়েছে বলেও মত দেন তারা।বৈঠকিটি সরাসরি সম্প্রচার করে একাত্তর টেলিভিশন।

/ইউআই/টিএন/