শিশু দত্তক

আইনি কাঠামো না থাকায় জটিলতা

পলিথিনে মোড়ানো শিশু আয়ান আফরাজ

দেশে সন্তান দত্তক নেওয়ার কোনও আইন না থাকায়, সন্তানহীন দম্পতি কোনও শিশুকে দত্তক নিতে পারছেন না। সন্তান দত্তক নেওয়ার জন্য অনেকে আগ্রহী হলেও শেষ পর্যন্ত আইনি জটিলতার কারণে তারা পিছিয়ে যাচ্ছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইনি জটিলতা নিষ্পত্তির জন্য একটি ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোর্ট থাকা প্রয়োজন।

সম্প্রতি বাংলা ট্রিবিউনে ‘ডাস্টবিনে পলিথিনে মোড়ানো ছিল শিশুটি’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হলে তাকে দত্তক নেওয়ার জন্য অনেকেই আগ্রহী হয়ে ওঠেন। অভিভাবকহীন চিকিৎসারত এই শিশুটিকে দত্তক নিতে অনেকেই যোগাযোগ করেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। কিন্তু সেখান থেকে জানানো হয়,কেউ ইচ্ছা করলেই শিশুটিকে নিতে পারবেন না,এ জন্য  প্রয়োজনীয় আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে।

আইনি জটিলতার কারণেই কেউ আর শিশুটিকে দত্তক নিতে এগিয়ে আসেননি।দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী শিশুটি ঠাঁই পেয়েছে সমাজসেবা অধিদফতরের আওতাধীন সরকারি শিশু নিবাস কেন্দ্রে। পারিবারিক আদালতের মাধ্যমে গিয়ে মামলা করাটাকে অনেকেই জটিল প্রক্রিয়া বলে মন্তব্য করছেন। তারা বলছেন, প্রক্রিয়াটি আরেকটু সহজ করা হলে অভিভাবকহীন শিশুরা যেমন অভিভাবক পেত, তেমন নিঃসন্তান দম্পতি, কিংবা যারাই নিতে চান, তারা সন্তান হিসেবে দত্তক নিতে পারতেন।

জানা যায়,মুসলিম আইন অনুযায়ী মুসলিম দম্পতি কোনও শিশুকে দত্তক নিতে পারেন না। তবে পারিবারিক আদালতের মাধ্যমে আবেদন করে কোনও দম্পতি শিশু লালন পালন করার জন্য নিতে পারেন। বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে ধর্ষণের শিকার নারীদের গর্ভে জন্ম নেওয়া শিশুদের পুনর্বাসনের জন্য ১৯৭২ সালে একটি বিশেষ আইন করা হয়। কিন্তু ১৯৮২ সালে শিশু পাচারসহ নানা কারণে সরকার আইনটি বাতিল করে। আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করলেও শিশু দত্তক নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনুস্বাক্ষর করেনি।    

বাংলা ট্রিবিউনে প্রকাশিত প্রতিবেদনে শিশু আয়ান আফরাজকে দত্তক নিতে চেয়েছিলেন তারানা পিয়া। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী  তারানা আদালতের মাধ্যমে সন্তান দত্তক নেওয়াটা ঝামেলার মনে করেন। তিনি বলেন,আমি বেসরকারি চাকরি করি। আদালতের মাধ্যমে দত্তক নিলে দিনের পর দিন সেখানে সময় দেওয়া আমাদের মতো মানুষদের জন্য কষ্টকর। তার চেয়ে বরং যিনি সন্তান নিতে চান তার বিষয়ে সব ধরনের খোঁজ-খবর সরকারি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোই নিতে পারে। যেমন আমার জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট, কোথায় থাকি, কোথায় চাকরি করি-সব খোঁজ তারাই নিতে পারে। একই সঙ্গে শিশুটিকে লালন করার মতো যথেষ্ট আর্থিক সঙ্গতি আমার রয়েছে কিনা, সেটাও তারা যাচাই করতে পারে। সবকিছু দেখে যদি তারা ইতিবাচক মনে করে তাহলেই শিশুটিকে দত্তক দেওয়ার ব্যবস্থাও করতে পারে। আর সবার পক্ষে আদালতে যাওয়াও সম্ভব নয়। আমাদের মতো যারা ঢাকার বাইরে থাকেন তাদের পক্ষে সম্ভব নয় ঢাকায় গিয়ে মামলা চালানো।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কুমিল্লা থেকে এক নারী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, দু’টি সন্তান থাকার পরও তিনি আয়ানকে দত্তক নিতে ইচ্ছুক ছিলেন। কিন্তু আইনি জটিলতার কারণে তিনি শিশুটিকে নিতে পারছেন না। 

শিশু দত্তক নেওয়ার ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, বাংলা ট্রিবিউনকে বললেন সমাজসেবা অধিদফতরের অধীনে থাকা শিশুমনি নিবাসের উপ-তত্ত্বাবধায়ক বিলকিস বেগম। তিনি বলেন, যে কেউ ইচ্ছে করলেই কোনও শিশুকে দত্তক নিতে পারেন না। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের পারিবারিক আদালতে গার্ডিয়ানশিপ নেওয়ার জন্য মামলা করতে হয়। মামলায় শিশুকে বড় করার আর্থ-সামাজিক পরিবেশ, সামর্থ্য, পারিবারিক পরিবেশসহ অনেক কিছু দেখে দত্তক নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়।

মামলার রায় যদি শিশুকে দত্তক নেওয়ার পক্ষে যায়, তা হলে রায়ের কপি নিয়ে তাকে আসতে হয় সরকারি এই শিশুনিবাস কেন্দ্রে। তখন অধিদফতরের পরিচালকের কাছে আবেদন করলে তিনি বিষয়টির মীমাংসা করেন। তিনি অনুমোদন দিলে শিশুটিকে দত্তক নেওয়া যাবে।

জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, মুসলিম ধর্মে সন্তান দত্তক নেওয়া নিষেধ রয়েছে। মুসলিম আইন পরিবর্তন করার কথা বললেও বিষয়টি অতো সহজ নয়। সেক্ষেত্রে এটিকে বাইপাস করে কীভাবে বিষয়টির সুরাহা করা যায় সেটা নিয়ে ভাবা দরকার। আর অবশ্যই আইনটির পরিবর্তন হওয়া উচিত। বর্তমান সময়ে নানা কারণে অনেক দম্পতি নিঃসন্তান। তারা চাইলেও শিশুনিবাসসহ কোথাও থেকে একটি শিশুকে দত্তক নিতে পারছেন না। তাই এখন খুব বেশি প্রয়োজন একটি ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোর্ট,যেখানে সব ধর্মের জন্য ইস্যুগুলো একইভাবে বিবেচিত হবে।

সালমা আলী বলেন, আমরা বছরের পর বছর এই আইনটির কথা বলে এলেও কেবল পিছিয়েই যাচ্ছি। খুব কনজারভেটিভ (রক্ষণশীল) হয়ে যাচ্ছি। আমরা কেন সঠিক খোঁজ-খবর নিয়ে একটা নিঃসন্তান দম্পতিকে সন্তান দিতে পারছি না, সে প্রশ্নও করেন তিনি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সমাজসেবা অধিদফতরের একজন কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমরা বিশ্বাস করি, সরকারি-বেসরকারি যে কোনও শেল্টার হোমের চেয়ে পরিবারে একটি শিশু ভালো থাকবে। ভালো পরিবেশ পাবে। কিন্তু আমাদের কিছু করার নেই। আইনটি সহজ হলেই কেবল এটি সম্ভব।

/এমএসএম/

আরও পড়ুন:

জঙ্গিবাদবিরোধী প্রচারণায় সেই আসাদুল্লাহ গালিব

হাসপাতালে শাহ আহমদ শফী

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি ইমামকে গুলি করে হত্যা

‘সন্তানদের রক্তাক্ত লাশ রেখে সাততলা ভবন খুঁজছিলেন তানজিনা’