বিএনপির নতুন কমিটি ঘিরে চাপা ক্ষোভ: বিতর্কিতদের প্রাধান্য

বিএনপি

দলীয় গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করে বিএনপির নতুন কমিটির আকার ঢাউস হলেও বেশিরভাগ পদপ্রাপ্ত নেতাই নাখোশ। এর মধ্যে পদের ধারাবাহিকতা না থাকায় দায়িত্বশীলদের মধ্যেও ক্ষোভ রয়েছে। পাশাপাশি কিছু পদে বিতর্কিত নেতাদের নির্বাচিত করায় ‘যোগ্যদের’ মধ্যেও অসন্তোষ কাজ করছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন পদবঞ্চিত নেতা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। এছাড়া নতুন কমিটিতে দলটির দফতর বিভাগে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আধিপত্য বিস্তার নিয়েও নেতাকর্মীদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। বিএনপির একাধিক স্তরের নেতার সঙ্গে আলাপকালে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

দফতর রিজভীর নিয়ন্ত্রণে

কমিটি পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, বিএনপির দফতর বিভাগ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ। এই বিভাগের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ জারি রয়েছে। বিএনপির নেতাকর্মীরা অভিযোগ করেন, সাধারণভাবে দফতরের সঙ্গে মহাসচিবের কাজ বেশি। কিন্তু নতুন কমিটিতে মহাসচিবের ক্ষমতা পুরোই খর্ব হবে বলে মনে করেন এই কর্মীরা।

নতুন কমিটিতে দফতরের দায়িত্বে রয়েছেন রিজভী নিজেই। ধারণা করা হচ্ছে, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিবের পদ পেলেও রিজভী প্রচারের লোভে দফতরের দায়িত্ব ছাড়তে অনীহা প্রকাশ করেছেন। এই পদে ও দায়িত্বে আসাদুজ্জামান রিপন যোগ্য হলেও তাকে দফতরবিহীন বিশেষ সম্পাদক করা হয়েছে নতুন কমিটিতে। প্রচার সম্পাদক হিসেবে শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানিকে দায়িত্ব দেওয়া হলেও এতে তিনি নাখোশ হয়েছেন।

জানা গেছে, সহ-দফতর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু, সহ-দফতর সম্পাদক মুনির হোসেন, সহ-দফতর সম্পাদক বেলাল হোসেন, সহ-প্রচার সম্পাদক আমিরুল ইসলাম আলিম, সহ-প্রচার সম্পাদক আসাদুল করিম শাহীন। তাদের সবাই রিজভী গ্রুপের বলে বিএনপিতে পরিচিত। আরেক সহ-প্রচার সম্পাদক শামীমুর রহমান শামীম আগেই সহ-দফতরের দায়িত্বে ছিলেন। নতুন কমিটিতে পদাবনতি হওয়ায় তিনি অব্যাহতি চেয়েছেন। কমিটি ঘোষণার পর থেকে তাকে বিএনপির কার্যালয়ে ও চেয়ারপারসনের গুলশান অফিসে দেখা যায়নি।

বিএনপির চেয়ারপারসন অফিসের একজন কর্মকর্তা জানান, শামীম মহাসচিব লবির নেতা হওয়ায় রিজভী গ্রুপে কোণঠাসা হয়ে পড়বেন তিনি-এ শঙ্কা থেকেই সহ-প্রচারের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চেয়েছেন শামীম। বাংলা ট্রিবিউনকে শামীমুর রহমান বলেন, ‘আমি ৫ মাসের বেশি সময় জেলে ছিলাম। ১৬ ঘণ্টা রাজনীতি করেছি। ছিলাম সহ-দফতর। এখন আরও নিচের পদে সহ-প্রচার করা হয়েছে। আমাকে অবমূল্যায়িত করা হয়েছে। তাই, মহাসচিব বরাবর চিঠি দিয়ে নিজের নাম প্রত্যাহার চেয়েছি।’

জ্যেষ্ঠতার লঙ্ঘনে নাশোখ বেশি কমিটিতে

দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি, স্থায়ী কমিটি এমনকি নির্বাহী সদস্য তালিকা তৈরিতেও জ্যেষ্ঠতার রীতি লঙ্ঘন করা হয়েছে। দ্রুত কমিটির সদস্যদের নাম যুক্ত করায় এই ভুল হয়েছে বলে মনে করেন বিএনপির অনেক নেতাকর্মী।

বিএনপির দফতরের একজন দায়িত্বশীল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের প্রধান কারণ, নেতারা যাদের নাম প্রস্তাব করেছেন, কমিটি প্রণয়নকারীরা সে নামের তালিকা অনুযায়ী সরাসরি পদ দিয়েছেন। জ্যেষ্ঠতার কোনও মেইনটেন করা হয়নি। এ কারণেই জ্যেষ্ঠতার লঙ্ঘন চোখে পড়েছে বেশি।

স্থায়ী কমিটিতে লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমানের নাম আগে থাকলেও তাকে নতুন কমিটিতে নিচে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটি কোনও দরকার ছিল না বলে মনে করেন বিএনপিপন্থী এক বুদ্ধিজীবী। ওই বুদ্ধিজীবী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এগুলোর কোনও দরকার ছিল? কারা কমিটি করেছে কে জানে? কত কথা শোনা যাচ্ছে চারপাশে!’

স্থায়ী কমিটিতে স্থান পাওয়া বিষয়ে অনেকটাই নিশ্চিত ছিলেন আবদুল্লাহ আল নোমান ও সাদেক হোসেন খোকা। এর মধ্যে নোমানকে নিয়ে পুরো বিএনপিতেই আলোচনা ছিল। ভদ্র-সজ্জন হিসেবে পরিচিত হলেও তাকে শেষ মুহূর্তে নেওয়া হয়নি।

বিএনপির একাধিক সূত্র জানায়, স্থায়ী কমিটিতে নাম ছিল নোমান ও খোকার। তবে চট্টগ্রাম বিএনপির দুই প্রভাবশালী নেতার পক্ষ থেকে ভেটো যাওয়ায় শেষ মুহূর্তে তাদের নাম কেটে ফেলা হয়। কমিটির নাম ঘোষণার পর থেকে দলে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন আবদুল্লাহ আল নোমান।

এ প্রসঙ্গে এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ‘নোমানের ক্ষেত্রে ইনজাস্টিজ হয়েছে।’ তার ভাষ্য, অনেক নেতা তার কাছে গিয়েও নাকি বলেন, বসিয়ে দিয়েছি তো।

তবে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পদবঞ্চিতদের আগামী কাউন্সিল পর্যন্ত অপেক্ষার কথাই বললেন। তিনি বলেন, ‘যারা যোগ্য, তাদের বিশেষ কমিটিতে আনা হবে।’  

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আ স ম হান্নান শাহ বলেন, ‘মান্নান ভূঁইয়ার আশপাশে যারা ঘুরঘুর করতেন। যারা নেত্রীকে গালি দিয়েছেন, তারেক রহমানকে গালি দিয়েছেন, আজ তাদের রিকমেন্ডেশনে আমি জানতে পেরেছি, অনেকে অনেক কমিটির সদস্য হয়ে গেছেন।’

কমিটি বর্ধিত করা প্রসঙ্গে আগামী কাউন্সিল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের এমন বক্তব্য সঠিক নয় মন্তব্য করে হান্নান শাহ বলেন, ‘যেহেতু দলের মধ্যে যোগ্য নেতাকর্মীর সংখ্যা বেড়েছে, সেহেতু গঠনতন্ত্র সংশোধন করে কমিটি বাড়ানো যেতেই পারে।’

জ্যেষ্ঠতার লঙ্ঘন চূড়ান্ত ঠেকেছে নির্বাহী সদস্যদের নাম প্রণয়নে। বিশেষ করে ছাত্রদলের বর্তমান নেতৃত্বের মধ্যে রাজীব আহসান, আকরামুল হাসান, মামুনদের নাম সাবেক কেন্দ্রীয় নেতাদের নামের আগে থাকায় ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

ছাত্রদলের একজন সহ-সভাপতি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যে সব সাবেক ছাত্রনেতা সদস্য হয়েছেন, তারা সবাই নাখোশ। তারা সবাই  সিনিয়র।’

সাবেক সহ-দফতর সম্পাদক আবদুল লতিফ জনি নিজেকে ভালো অবস্থানে দেখতে চেয়েছিলেন। নতুন স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদের সন্ধান পরবর্তী তার নানা কাজে সহযোগিতা করেন জনি। ধারণা করা হচ্ছিল, দলের পক্ষে ভারতে আটক সালাহ উদ্দিনের খোঁজ খবর রাখায় তাকে পুরস্কৃত করতে পারেন খালেদা জিয়া। যদিও কমিটি প্রণয়নকারীরা তাকে পদ থেকে একেবারেই বাতিল করে দিয়ে সাধারণ সদস্য হিসেবে রেখেছেন। তারেক রহমানের ঘনিষ্ট বলে পরিচিত ডা. মাজহারুল ইসলাম দোলনও হয়েছেন সদস্য। মির্জা আব্বাসের স্ত্রী আফরোজা আব্বাসকে দেওয়া হয়েছে মহিলা বিষয়ক সহ-সম্পাদকীয় পদ। এতে আব্বাস পরিবারে ক্ষোভ আছে বলেও জানা গেছে নানা সূত্রে।

এমকে আনোয়ার ও রফিকুল ইসলাম মিঞাকে নিয়ে ক্ষোভ

একজন আমলা অন্যজন আইনজীবী। এমকে আনোয়ার ও রফিকুল ইসলাম মিঞাকে নিয়ে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে কমিটি ঘোষণার পরই। এই দু’জন বিগত তিন বছরে কোনও ধরনের আন্দোলনে দেখা যায়নি। এমনকি পুরো সময় তারা আত্মগোপনে থাকার চেষ্টা করেছেন। বিশেষ করে এম কে আনোয়ারের ফোনালাপের কারণে নেতাকর্মীদের মধ্যে তাকে নিয়ে বিচ্যুতি তৈরি হয়েছে। একজন কনিষ্ঠ নারীনেত্রীর সঙ্গে উত্তেজক ফোনালাপ নিয়ে গত দুই বছর ধরে তরুণ নেতাকর্মীদের মধ্যে সমালোচনা আছে। এছাড়া রফিকুল ইসলাম মিঞার বক্তব্য সাহসী হলেও রাজপথ থেকে দূরে থেকেছেন তিনি। মাঝখানে পুরো সময়টিতে তিনি আত্মগোপনে ছিলেন। অন্য নেতারা যখন আদালতে মামলা থেকে জামিন নিতে ব্যস্ত থেকেছেন, এই নেতা তখন ছিলেন পলাতক।

বড় উপদেষ্টা কাউন্সিল কেন

নতুন কমিটিতে খালেদা জিয় তাকে পরামর্শের জন্য ৭৩ জনের একটি উপদেষ্টা কাউন্সিল করেছেন। এই কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে আনকোরা সদস্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এই সংখ্যা নিয়ে সমালোচনা শুরু হয় নাম ঘোষণার পরই। এর মধ্যে ফজলুর রহমান পটল মারা গেছেন সম্প্রতি।

উপদেষ্টা কমিটি নিয়ে দুই ধরনের ক্ষোভ রয়েছে। একটি হচ্ছে, যাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, অনেকের রাজনৈতিক কোনও যুক্ততা কখনোই ছিল না। দ্বিতীয়ত, অনেক নেতাকে যুক্ত করা হয়েছে, যারা মনে করেন, এই পোস্ট আলঙ্করিক।

অধ্যাপিকা তাজমিরী ইসলাম, অধ্যাপিকা ডা. শাহিদা রফিক, ড. ইনামুল হক চৌধুরী, ডা. সিরাজুল ইসলাম, অধ্যাপক সুকোমল বড়ুয়া, বিজন কান্তি সরকার, সঞ্জীব চৌধুরীসহ কয়েকজন কেবলমাত্র লেখালেখির কারণে দলের এই পোস্টে নিয়োগ পেয়েছেন। এই বিষয়টি নেতাদের মধ্যে আলোচনার সৃষ্টি করেছে।

স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার মনে করেন, ‘দিন যত যাচ্ছে, দল বড় হচ্ছে। বড় দলে সবাইকে নিয়েই কাজ করতে হয়।’

স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য স্বপরিচয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, ‘ম্যাডাম তো কাউন্সিলেই জানিয়েছেন, বিষয়ভিত্তিক উপদেষ্টা কমিটি হবে। এটা হতে পারে, যাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাদের বিষয়ভিত্তিক কাজে যুক্ত করা হবে।’

বিএনপির সুহৃদ হিসেবে পরিচিত ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীও সম্প্রতি এক খোলা চিঠিতে খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা কাউন্সিলের সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা কাউন্সিলে ১৫ জন উপদেষ্টা থাকার কথা, অবশ্য প্রয়োজনে সংখ্যা বাড়ানোর ক্ষমতা চেয়ারম্যানকে দেওয়া আছে। তাই বলে কি অতিরিক্ত ৫৮ জন উপদেষ্টা? বাজারে প্রচলিত ধারণা যে, স্বাধীনতার চেতনা ও মুক্তচিন্তার পর্যাপ্ত একাডেমিকদের সঙ্গে বিএনপির যোগাযোগ নেই।

এছাড়া গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও নিতাই রায়ের মেয়েরা কমিটিতে স্থান পাওয়ায় নেতাকর্মীদের মধ্যে সমালোচনা আছে। কমিটিতে মোট ১০ নেতার স্ত্রী, ১১ নেতার ছেলে, ৬ ভাই বোন স্থান পেয়েছেন। 

মানবতাবিরোধী অপরাধীর সন্তানকে পুনর্বাসনের সমালোচনা

নির্বাহী কমিটিতে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত আবদুল আলীম ও সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সন্তানদের স্থান পাওয়া অযৌক্তিক ও ভুল সিদ্ধান্ত বলে মনে করেন বিএনপির কেউ-কেউ। এ নিয়ে পরিচয় প্রকাশে নারাজি প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ। ঢাকা মহানগরের সাবেক এক প্রভাবশালী মুক্তিযোদ্ধা নেতা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘একাত্তরের চ্যাপ্টার তো শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু এই দুজনের সন্তানের নাম দিয়ে ফের সমালোচনা আনা হল। এটা দরকার ছিল না।’

/এমএনএইচ/

আরও পড়ুন: ‘তুইও মরবি, আমাদেরও মারবি’