পর্যটন খাতে টেকসই উন্নয়নের পরামর্শ আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের

পাটা এনটিএফএফ-২০১৬ সম্মেলন

পর্যটন খাতে বাংলাদেশের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত, বৃহৎ উপকূলীয় অঞ্চল, ওয়াইল্ড লাইফ, হেরিটেজ, সংস্কৃতির মতো সম্ভাবনাগুলো বিশ্বের সামনে সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারলে বাংলাদেশ পর্যটন খাতে শক্ত অবস্থান করতে সক্ষম হবে। তবে এজন্য টেকসই অবকাঠামো উন্নয়ন, সমন্বিত পরিকল্পনা, পর্যটকবান্ধব সেবা নিশ্চিত করতে হবে। বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে আলাপকালে এমন কথাই বলেছেন আন্তর্জাতিক পর্যটন বিশেষজ্ঞ, শিক্ষাবিদ ও এ খাতের সংশ্লিষ্টরা।

গত ২৩-২৫ নভেম্বর কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত হয় প্যাসিফিক এশিয়া ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশনের (পাটা) অন্যতম বৃহৎ ইভেন্ট ‘পাটা নিউ ট্যুরিজম ফ্রন্টিয়ার ফোরাম’ (পাটা এনটিএফএফ-২০১৬) সম্মেলন। এই সম্মেলনে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১৭টি দেশের পর্যটন বিশেষজ্ঞ, শিক্ষাবিদ,ট্যুর অপারেটর, আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধি, শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যম কর্মীসহ ২৪০ জন অতিথি অংশ গ্রহণ করেন। সম্মেলনে বাংলাদেশের পর্যটন খাতের অগ্রগতির সঙ্গে থাকার আশ্বাস দেয় জাতিসংঘ পর্যটন সংস্থা ইউএনডব্লিওটিও, পাটা ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা।

বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের  (বিটিবি) উদ্যোগে পর্যটন নগরী কক্সবাজারে এ সম্মেলনে অতিথিরা নিজেদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন এবং পরামর্শ দেন। সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে রামু ও মহেশখালীর বিভিন্ন স্থান দেখানো হয়। সম্মেলনের শেষের দিনে বিভিন্ন সেশন অনুষ্ঠিত হয়। সেশনে অতিথিরা টেকনিক্যাল ট্যুরের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন এবং পর্যটন খাতের উন্নয়নে নিজেদের পরামর্শ তুলে ধরেন।

বাংলাদেশ পর্যটন খাত এগিয়ে যাচ্ছে, তবে টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে শক্ত অবস্থান তৈরি সম্ভব বলে মনে করেন প্যাসিফিক এশিয়া ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশনের (পাটা) চেয়ারম্যান অ্যান্ড্রু জোনস। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে বাংলাদেশ অনেক সমৃদ্ধ। পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য প্রচারণা যেমন করতে হবে, তেমনি পর্যটকবান্ধব উন্নয়ন প্রয়োজন। টেকসই অবকাঠামো উন্নয়ন না হলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সহজ নয়। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করে অবকাঠামো উন্নয়ন প্রয়োজন। ’

ইউএনডব্লিওটিও-এর পরিচালক জু জিং এবং ড. মারিও হার্ডি

বাংলাদেশে পর্যটকদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ আছে বলে মনে করেন জাতিসংঘ পর্যটন সংস্থা ইউএনডব্লিওটিও-এর এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের পরিচালক জু জিং। তিনি বলেন, ‘পর্যটন খাতের বিভিন্ন উদ্যোগে বাংলাদেশ সরকারের সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। পর্যটন স্থান সংশ্লিষ্ট স্থানীয় অধিবাসীদের অংশিদারিত্ব বাড়াতে হবে। তাদের প্রশিক্ষিত করলে তারাও সুবিধাভোগী হবেন, পর্যটকদের প্রতি তাদের দায়িত্বশীলতা বাড়বে। স্থানীয়দের অংশগ্রহণ ছাড়া পর্যটকরা সংস্কৃতিকে উপভোগ করতে পারবেন না।’

উন্নয়ন প্রসঙ্গে জু জিং বলেন, ‘অপরিকল্পিত উন্নয়নে পর্যটন খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশের প্রয়োজন টেকসই পর্যটকবান্ধব উন্নয়ন। অবকাঠামো উন্নয়ন ও সেবা নিশ্চিত করতে হবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বজায় রেখে।’

তবে অতিরিক্তি পর্যটক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে,এজন্য কোনও কোনও ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন বলে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের জিএলএফ ফ্লিমর্সের প্রধান নির্বাহী রব হোলমেস। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন,‘পর্যটন খাত আয়ের অন্যতম মাধ্যম হতে পারে। তবে সেটা সম্ভব টেকসই উন্নয়ন ও পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে। কেন একজন পর্যটক আসবেন ? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে হবে। একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে, প্রাকৃতিক পরিবেশ জীববৈচিত্র্য ও সৌন্দর্য বিনষ্ট হলে পর্যটকরা আর আগ্রহী হবেন না। অতিরিক্ত পর্যটক আগমনের ফলে বিশ্বের অনেক স্থান আর্কষণ হারিয়েছে, সেখানে এখন আর পর্যটকরা যান না। ফলে পর্যটকদের যেমন আকৃষ্ট করতে হবে, একই সঙ্গে নিয়ন্ত্রণও জরুরি। সেজন্য সঠিক পরিল্পনার প্রয়োজন। বাংলাদেশের সম্ভবনা রয়েছে। উপযুক্ত পরিকল্পনার মাধ্যমে বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে পারবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজম্যান্ট বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. শাকের আহমেদ বলেন, ‘কক্সবাজারের মাধ্যমে বাংলাদেশ পর্যটন খাতে বিশ্বের কাছে অন্যতম আর্কষণ। দেশের বিশ্ব বিদ্যালয়গুলোতে পর্যটন বিষয়ক শিক্ষা বাড়ছে। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে যে দক্ষ জনগোষ্ঠী প্রয়োজন, তা বাংলাদেশে বাড়ছে। সরকার, বেসরকারি খাত সকলের সমন্বিত উদ্যোগে এগিয়ে যাওয়ার সময় এখন।’  

পাটা এনটিএফএফ-২০১৬ সম্মেলন

ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত পর্যটকের চাপ নিয়ন্ত্রণের কৌশল ও পরিকল্পনা প্রয়োজন বলেন মনে করেন প্যাসিফিক এশিয়া ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশনের (পাটা) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. মারিও হার্ডি। তিনি বলেন, ‘পর্যটক আকৃষ্ট করা যেমন চ্যালেঞ্জ, তেমনি ভারসাম্য রক্ষা করাও একটি চ্যালেঞ্জ। পর্যটকদের চাহিদা, একই সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষার স্বার্থে পর্যটন স্পটগুলোর অবকাঠামো উন্নয়ন ও বিন্যাস প্রয়োজন।  বাংলাদেশের কক্সবাজার এবং আশপাশের উপকূলীয় পর্যটন বিকাশের সুযোগ রয়েছে।’
দেশ বিদেশি আন্তর্জাতিক পর্যটন বিশেষজ্ঞ, শিক্ষাবিদ ও এ খাত সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ নিয়েই পর্যটকবান্ধব সমন্বিত উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে বলে জানান বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন। তিনি বলেন, ‘এই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ, শিক্ষাবিদদের সুপারিশ আমরা পেয়েছি। একটি টেকসই উন্নয়ন ও  ব্র্যান্ডিং করার সক্ষমতা হবে।’

মেনন বলেন,  ‘আমরা নতুনভাবে বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে চাই। কক্সবাজার ও এর আশপাশের পরিচিত-অপরিচিত স্পটগুলোকে আন্তর্জাতিকভাবে তুলে ধরা হবে। এ অঞ্চলে ট্র্যাকিং, ডিজিটাল গেমস, ওয়াইল্ড লাইফ ওয়াচিংয়ের সম্ভাবনা রয়েছে।’

উন্নয়ন প্রসঙ্গে রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘কক্সবাজার বিমানবন্দরে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট আসবে এবং রেল যোগাযোগ চালু হবে ২০১৮ সালের মধ্যেই। এর মাধ্যমে কক্সবাজার বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করবে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়েরর মাধ্যমে একটি মাস্টার প্ল্যান তৈরির কাজ হচ্ছে।’ 

পর্যটনবান্ধব পরিবেশ রক্ষা প্রসঙ্গে মেনন বলেন, ‘কক্সবাজারে অপরিকল্পিত স্থাপনা নিয়ে এতদিন আইনি বাধা ছিল। অবৈধ স্থাপনা দ্রুত সময়ের মধ্যে উচ্ছেদ করা হবে। এক্ষেত্রে যত কঠোর হতে হয়, আমরা হবো।’

/সিএ/ এপিএইচ/