আলোচিত বই নেই, লেখকেরা ব্যস্ত আত্মপ্রচারে!

একুশে গ্রন্থমেলা, ছবি: সংগৃহীত
একুশের বইমেলা প্রায় শেষের পথে। এখন পর্যন্ত আলোচিত কোনও বইয়ের নাম শোনা যায়নি। মেলায় আগত পাঠকদের সঙ্গে কথা বলো তেমন কোনও বইয়ের নাম জানা যায়নি। একেক পাঠক একেক বইয়ের নাম বলছেন। খোদ লেখকরা আলোচিত বইয়ের কথা বলতে পারছেন না। কোন বইটি আলোচিত, হুট করে করা এই প্রশ্নের জবাব চট করে কেউই দিতে পারেননি।

লেখকদের মতে, নতুন-পুরনো লেখকদের আত্মপ্রচারে ব্যস্ত থাকা, লেখকদের মধ্যে পারস্পারিক যোগাযোগ স্থাপিত না হওয়া এবং বইমেলাকে কেবল বই বিক্রির জায়গা হিসেবে সীমাবদ্ধ করাতেই এমন অবস্থা দেখা দিয়েছে। আগে এই একমাসে লেখকদের মধ্যে পরম্পরা তৈরি হওয়া থেকে শুরু করে পরস্পরের কাজকে জানার চর্চা ছিল। আর এখন বইমেলা লেখকদের আত্মপ্রকাশ আর আত্মপ্রচারে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে।

লেখকেরা বলছেন, কার কী বই বের হলো, মেলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বই কোনটি— এগুলো নিয়ে কাটাছেঁড়া দূরে থাক, ভালো ও আলোচিত বইয়ের নামই তারা জানতে পারেন না। মেলা শেষে বই বিক্রির হিসাব দেখলে তবে বোঝা যায়, পাঠক কোন বইগুলোকে গ্রহণ করেছে।

বাংলা একাডেমি বলছে, জায়গা আগের মতো থাকলেও লেখকদের মধ্যে কয়েকটা প্রজন্ম তৈরি হওয়ায় মেলবন্ধন কমে এসেছে।

এই একমাস তবে লেখকেরা কী নিয়ে ব্যস্ত থাকেন? এ বিষয়ে কথা হয় কয়েকজন লেখকের সঙ্গে। তারা বলছেন, বছর পাঁচেক হলো লেখক-প্রকাশকদের ব্যস্ততা অন্যদিকে বেড়েছে। তারা এখন গণমাধ্যমে এবং পাঠক ও বিক্রেতার কাছে আত্মপ্রকাশেই ব্যস্ত থাকেন বইমেলার পুরোটা সময়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিজের বইয়ের বিজ্ঞাপন দেওয়া ছাড়া অন্য বই নিয়ে, বইয়ের আধেয় নিয়ে আলাপে আগ্রহই নেই বেশিরভাগ লেখকের।

16924174_10212441486779051_1764543707_nলেখকেরা বলছেন, বইমেলার শুরু থেকে গণমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানানো, নিজের বইয়ের পরিচিতি তুলে ধরা, মেলা শেষে টকশোতে উপস্থিত হওয়া নিয়েই ব্যস্ত থাকেন লেখকেরা। ফলে তাদের মধ্যে সৃজনশীল আড্ডা একেবারেই চোখে পড়ে না। তার ওপর, একসঙ্গে কয়েকজন তরুণকে আড্ডা দিতে দেখলেই পুলিশ তাদের সরিয়ে দেয়। এ কারণেও আড্ডার সুযোগ মিলছে না লেখকদের।

প্রতিবছর মেলায় আড্ডার দেওয়া বা বসার জায়গা নিয়ে সমস্যা হয় জানিয়ে লেখক সাখাওয়াত টিপু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গেল ক’বছর সামাজিক মাধ্যমে আন্দোলনের পর বসার জায়গা মিলেছিল। এবার তা নেই। এটা নিয়ে সংবাদমাধ্যমগুলোও নিরব।’

আড্ডা থেকে অনেক সৃষ্টিশীল চিন্তার জন্ম হয়েছে উল্লেখ করে টিপু আরও বলেন, ‘সাহিত্যতত্ত্ব, সাহিত্য আন্দোলন, নতুন চিন্তার সূত্রপাত— এর অনেক কিছুই আড্ডার ফসল। আড্ডা বহুচিন্তার সামাজিকায়ন। এটা ব্যক্তিকে মানুষের বা সমাজের কাছে নিয়ে যায়। আগের আড্ডা অনেক বেশি সামাজিক ছিল। কিন্তু ভার্চুয়াল জগৎ বাস্তব আড্ডাকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।’

লেখক শাকুর মজিদ এ বছর ২২ ফেব্রুয়ারি প্রথমবারের মতো বইমেলায় গিয়েছেন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মেলায় গিয়ে দেখলাম সবই আছে, শুধু ক্লান্ত হলে বসে বিশ্রামের কোনও জায়গা নেই। কারও সঙ্গে কথা বলতে হলে দাঁড়িয়ে বলতে হয়। কোনও প্রকাশক ডেকে নিয়ে স্টলে বসতে দিলে তবেই একটু রক্ষা।’

মেলার ব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গে শাকুর মজিদ বলেন, ‘মেলার আয়োজন করে বাংলা একাডেমি। মেলার আগে এ নিয়ে কেবল প্রকাশক সমিতির নেতাদের সঙ্গে বসে তারা মেলার সাজসজ্জা, স্টল বিভাজন চূড়ান্ত করে। এসময় দর্শনার্থীদের বসার জায়গা বা লেখক-পাঠক সংযোগ ঘটানোর মতো সুস্থ কোনও পরিসরও মেলার ডিজাইনে রাখা হয় না। প্রকাশকরাও যেন চান, মেলায় আগত দর্শনার্থীরা বই কিনে বাড়ি চলে যাবেন। বই বিপণন ও প্রচারের কাজটাও লেখকদের করে নিতে হয়। বিক্রির টাকাটা যায় প্রকাশকের পকেটে। সব মিলিয়ে মেলার পরিবেশ প্রকাশকবান্ধব, এখানে লেখক-পাঠকেরা উপেক্ষিত।’

16901674_10212441486659048_568711553_nলেখক আবিদ আনোয়ার বইমেলার এ বছরের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘মন টানে কিন্তু গিয়ে কোথাও আরাম করে বসে কথা বলার জায়গা নেই। তাই অসুস্থ শরীর নিয়ে মেলায় যেতে ভরসা পাই না।’

তিনি বলেন, ‘আগে বিকাল থেকেই লেখকেরা জড়ো হতেন, কথা বলতের, আড্ডা চলতো। এখন এসবের বালাই নেই, লেখকেরাও যেন বই বিক্রি করতেই মেলায় যান। আর অনলাইনে আত্মপ্রচারের কাজ তো আছেই।’

বাংলা একাডেমির সচিব মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নিরাপত্তার কারণে এবার বসার ব্যবস্থাটা সেভাবে করা যায়নি। তবে বাংলা একাডেমি অংশে বসার জায়গা আছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকায় এটা করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু এতে লেখকদের পারস্পরিক লেনদেন আটকে থাকার কথা না।’

/টিআর/এসটি/

আরও পড়ুন:

নিষ্ক্রিয়দের ডাকছেন খালেদা জিয়া: বিএনপিতে নতুন হাওয়া