গণহত্যার নীল নকশা: অপারেশন সার্চলাইট

লারকানা হাউসে বসেই ষড়যন্ত্র করে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে নিয়ে ১৯৭২ সালে সাংবাদিক রবার্ট পেইন তার ‘ম্যাসাকার’ বইয়ে লেখেন, ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত এক সামরিক বৈঠকে ইয়াহিয়া খান বাঙালিদের খতম করার সিদ্ধান্ত নেন। ওই সেনা বৈঠকে ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন, ‘কিল থ্রি মিলিয়ন অব দেম, অ্যান্ড দ্য রেস্ট উইল ইট আউট অব আওয়ার হ্যান্ডস।’ এই পরিকল্পনার পথ ধরে ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে ঢাকা পরিণত হয় লাশের শহরে।  

সেই বৈঠক যে আদৌ সামরিক বৈঠক ছিল না, তা বেরিয়ে আসতে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ গবেষকদের হাত ধরে। গবেষণায় বেরিয়ে আসে, ২৫ মার্চের রাতে গণহত্যার পরিকল্পনা হয়েছিল এক মাস আগে। গবেষকরা বলছেন, শেখ মুজিবুর রহমান কতটা শর্ত দিবেন আর দিবেন না, তার ওপর নির্ভর করেই বাঙালিদের ভয় দেখানোর মধ্য দিয়ে শেষ করার পরিকল্পনা হয়েছিল পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশে জুলফিকার আলী ভুট্টোর বাড়ি লারকানা হাউজে। তবে সেটি ভুট্টো করেছিলেন কৌশলে পাখি শিকারের নাম করে বৈঠক ডাকার মধ্য দিয়ে। এরপর হাসতে-হাসতেই ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যার প্রাথমিক পরিকল্পনা করে ফেলেন তারা। 

১৯৭২ সালে পাকিস্তান সরকার একটি কমিশনও গঠন করেছিল। সেখানে কর্মকর্তাদের সাক্ষ্য পাওয়া যায়। যদিও হামিদুর রহমান কমিশনের ওই রিপোর্ট সরকারিভাবে কখনও প্রকাশ করা হয়নি। তবে রিপোর্টের অনেক তথ্য পরবর্তীতে প্রকাশ করা হয়, যেখানে ২৫ মার্চের ‘অপারেশন সার্চলাইট’ এর জন্য প্রধানত জুলফিকার আলী ভুট্টো, জেনারেল ইয়াহিয়া, জেনারেল হামিদ ও টিক্কা খানকে দায়ী করা হয়। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন এ বিষয়ে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অপারেশন সার্চ লাইটের পরিকল্পনা নিয়ে বিশদ গবেষণা হয়নি বললেই চলে। তবে অপারেশন সার্চলাইট নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে কাজ হয়েছে। এই গণহত্যার পরিকল্পনা বিষয়ে তাদের অফিসারদের বয়ান থেকে যতটা নিশ্চিত হওয়া গেছে তা হলো, জুলফিকার আলী ভুট্টোর পরিকল্পনা ও কৌশল ইয়াহিয়া ও কয়েকজন জেনারেলের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়েছে। লারকানা হাউজের নাম বারবার সামনে আসে। ২৫ মার্চের গণহত্যা এবং ধ্বংসযজ্ঞ একদিনের সিদ্ধান্তে হয়নি। বহু আগে এর ছক আঁকা হয়েছিল।’ 

ইয়াহিয়া খান, টিক্কা খান ও ফরমান আলী

এক মাস আগের ভয়ঙ্কর পরিকল্পনার বাস্তবায়ন হতে শুরু করে ২৫ মার্চ থেকে। যদিও সেদিন সন্ধ্যা সোয়া সাতটায় যখন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার বিমান ঢাকা ত্যাগ করেছিল, তখনও কেউ জানতো না কী ভয়ঙ্কর হত্যাযজ্ঞের পরিকল্পনা হয়েছে। কেউ বুঝতেই পারেনি চরম বিশ্বাসঘাতকতার নজির রাখার নির্দেশ দিয়ে গেছেন তিনি।

‘অপারেশন সার্চলাইট’ ষড়যন্ত্রের প্রেক্ষাপট বলতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ড. এমএ হাসান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পর এদেশের মানুষ ভেবেছিল ক্ষমতার পালাবদল হবে। ১৯৭১ এর ২৮ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও সেনাপ্রধান ইয়াহিয়া খান যখন জুলফিকার আলী ভুট্টোর প্ররোচনায় জাতীয় বিধানসভার কার্যাবলী মার্চ পর্যন্ত স্থগিত করে দেন, তখনই যা বুঝার বুঝে গেছে মানুষ। আর ওরাও বুঝে গেছে আমরা পিছু হটবো না। এবং শেষ পেরেক হিসেবে আগে থেকেই হিসেব কষে রাখা অপারেশন সার্চলাইটের পথে এগিয়েছিল।’ 

লারকানা ষড়যন্ত্র বিষয়ে কতটা জানা গেছে প্রশ্নে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন ‘বৈঠকটা হয়েছিল ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি, লারকানায় ভুট্টোর বাড়িতে। সেখানে যারা যারা ছিলেন বলে নাম আসে তারা হলেন ইয়াহিয়া, সেনাপ্রধান জেনারেল হামিদ, প্রধান স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল এসজিএমএ পীরজাদা। অন্য আরও অনেকের নাম বের হয়নি। সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে জানা যায়, সেখানেই বাংলাদেশে গণহত্যার প্রথম পরিকল্পনা করা হয়।’

/ইউআই/এএআর/আপ-এসটি

আরও পড়ুন:

গণহত্যা দিবস: স্বীকৃতি আদায়ে আন্তর্জাতিক আইনি সংস্থা নিয়োগের পরিকল্পনা

‘পাকিস্তানের ধৃষ্টতার জবাব দিতেই গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রয়োজন’