সম্মেলন আয়োজনের কোনও নিয়মই মানেনি ইউনূস সেন্টার!

বাতিল বলেও অভিজাত হোটেলে সম্মেলন করলো ইউনূস সেন্টার (ছবি: ইউনূস সেন্টারের ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া)আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজনের প্রচলিত নিয়মকানুনের কোনোটিই ঠিকঠাক মানেনি ইউনূস সেন্টার। অতিথিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যথাসময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানানো, যথাযথ প্রক্রিয়ায় জানানো, বাতিল ঘোষণা করে পরদিন অন্য ভেন্যুতে সম্মেলন করার বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া- এসব কোনটাই করেনি ইউনূস সেন্টার।

আন্তর্জাতিক সম্মেলনের ধারণার সঙ্গে এসব প্রক্রিয়া অবলম্বন না করাটা মানানসই নয় বলে জানিয়েছে নিয়মিত আন্তর্জাতিক সভা-সমাবেশের আয়োজনকারী আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা। তারা বলছেন, নিরাপত্তা ইস্যুটি ‘রুটিন ওয়ার্কের’ মতো, আয়োজক সংগঠন নিজের স্বার্থেই আগেভাগে কাজটি সেরে রাখার কথা। পুলিশ বলছে, নিরাপত্তা ইস্যুতে সাভারের জিরাবোতে আয়োজন বাতিল করার পর অন্য কোনও ভেন্যুর বিষয়ে ইউনূস সেন্টার থেকে অনুমতি নেওয়া হয়নি।

আন্তর্জাতিক কয়েকটি সংস্থার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিদেশি অতিথিদের নিয়ে এ ধরনের আয়োজনে ‘অতিথিদের প্রোফাইল’ এর ওপর নির্ভর করে নিরাপত্তার বিষয়টি কেমন হবে। এগুলো এক সপ্তাহ বা একদিনের সিদ্ধান্তের বিষয় নয়। আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজনের অভিজ্ঞতা থেকে সংস্থাগুলোর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোনও হোটেলে অনুষ্ঠান করার ক্ষেত্রেও আন্তর্জাতিক অতিথিদের বিষয়ে পুলিশকে অবহিত করাটা স্বাভাবিক নিয়মের মধ্যেই পড়ে।

জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে তাদের আয়োজনের প্রক্রিয়াগুলো নিয়ে কথা হয়। বিদেশি অতিথিদের ক্ষেত্রে প্রত্যেকের প্রক্রিয়া এক ও অভিন্ন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সরাসরি তত্ত্বাবধানে কাজগুলো করা হয়। নিরাপত্তার ধরন কী রকম হবে তা অনুষ্ঠানের প্রোফাইলের ওপর নির্ভর করে। সংস্থাগুলোর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুলিশকে অবহিত না করে কোনও আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠান হয় না। কারণ এখানে নিরাপত্তার বিষয়টি জরুরি। পাঁচ তারকা হোটেলে হলেও কোনও না কোনও পক্ষ থেকে পুলিশকে জানাতে হয়।  

জাতিসংঘের ঢাকা অফিসের মানবাধিকার কর্মকর্তা জাহিদ হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আয়োজক সংগঠন বিদেশি অতিথিদের যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাইবে। দায়িত্বটা তারই। এটি মন্ত্রণালয় ও দূতাবাসের মাধ্যমে করা হয়ে থাকে, কারণ এখানে ঝুঁকির ব্যাপার থাকে। পারমিশন নেওয়াটা পুরো প্রক্রিয়ার স্বাভাবিক একটি অংশ। বড় বড় অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে এসব নিয়ে যথেষ্ট সতর্ক থাকার বিষয় আছে।’

অভিজাত হোটেলে সম্মেলন করলো ইউনূস সেন্টার (ছবি: ইউনূস সেন্টারের ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া)ইউনূস সেন্টার বলছে, সামাজিক ব্যবসা দিবস উপলক্ষে শুক্রবার জিরাবোর সামাজিক সম্মেলন কেন্দ্রে আন্তর্জাতিক সম্মেলন শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পুলিশের অনুমতি না মেলায় অনুষ্ঠান বাতিল হওয়ার পর রাজধানীর হোটেল লা মেরিডিয়ানে ছোট পরিসরে সম্মেলনটি করা হয়েছে। অতিথিরা ওই হোটেলেই অবস্থান করায় তাদের হোটেলের একটি হলে এনে অনুষ্ঠানটি করা হয়েছে। বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ‘নলেজ’ ছিল। তবে স্থানীয় থানা বলছে, তাদের কাছে কোনও অনুষ্ঠানের খবর নেই।

সামাজিক ব্যবসা দিবস উপলক্ষে ২৮ ও ২৯ জুলাই ৭ম আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন করে ইউনূস সেন্টার। হঠাৎ বৃহস্পতিবার (২৭ জুলাই) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে তারা অনুষ্ঠানটি বাতিলের কথা জানায়। পরে কোনও ঘোষণা ছাড়াই ২৮ জুলাই হোটেল লা মেরিডিয়ানে সম্মেলনটি করে তারা।  ফেসবুকে সেটি লাইভও করা হয়।

ইউনূস সেন্টারের তথ্যমতে, আনুমানিক দুই হাজার জনের এই সম্মেলনে ৫০টি দেশ থেকে চারশ’র বেশি বিদেশি অতিথি ও অংশগ্রহণকারী যোগদানের জন্য নিবন্ধন করেছিলেন। খুব স্বল্পসময়ের নোটিশে সঠিকভাবে সঠিক জায়গায় আবেদন না করায় জিরাবোতে এই অনুষ্ঠান আয়োজনে পুলিশ নিরাপত্তা দিতে অপারগতা জানিয়েছিল।

নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অনেকগুলো প্রক্রিয়া থাকলেও পুলিশকে অবহিত করাটা দায়িত্ব উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক সংস্থা শাপলা নীড়ের অ্যাডভোকেসি কর্মকর্তা আতীকা বিনতে বাকী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যে যে দেশের প্রতিনিধি এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন, সেসব দেশের দূতাবাস তাদের দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সরাসরি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে সিকিউরিটি নিশ্চিত করতে পারে। আমরা অনুষ্ঠান আয়োজনের ক্ষেত্রে দেখেছি কোনও না কোনোভাবে পুলিশকে ইনফর্ম করার রেওয়াজ আছে। সেটি আয়োজক সংগঠন ও হোটেল কর্তৃপক্ষ উভয়েই করতে পারে।’

নিজেরা বাতিল ঘোষণা করা সম্মেলন হঠাৎ করেই পরদিন হোটেল লা মেরিডিয়ানে করার অনুমতি নেওয়া হয়েছিল কিনা জানতে চাইলে ইউনূস সেন্টারের সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার (মিডিয়া ও আউটরিচ) সাব্বির আহমেদ ওসমানি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা কোনটা কিভাবে করছি তা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নলেজে ছিল। বৃহস্পতিবার আয়োজন বাতিল করার পর প্রায় আড়াই’শ অতিথির সময় ও খরচ- কিভাবে কী করবো, ভাবতে গিয়েই এভাবে সম্মেলন করার পরিকল্পনা হয়। সবকিছু অনেক বেশি তাড়াহুড়ার মধ্যে হয়েছে। উনারা (পুলিশ) জানতেন।’

বাতিল বলেও অভিজাত হোটেলে সম্মেলন করলো ইউনূস সেন্টার (ছবি: ইউনূস সেন্টারের ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া)স্থানীয় থানা বলছে তারা জানত না- এমন তথ্যে সাব্বির আহমেদ বলেন, ‘আজকেও আমাদের অফিসে সেই অতিথিদের অনেকে এসেছেন। পুলিশের সবই নলেজ আছে। আর যে হোটেলে অনুষ্ঠানটি হয়েছে সেটিতেই বেশিরভাগ অতিথি থাকছিলেন। ফলে তাদের এখান থেকে সেখানে যাওয়ার বিষয়ও ছিল না।’

এ ধরনের আয়োজনে অন্তত দশ-পনেরো দিন আগে পুলিশকে অবহিত করার প্রয়োজন থাকলেও ইউনূস সেন্টার কেন নিরাপত্তার চিঠিটি সাতদিন আগে দিলো- জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা ১৯ তারিখ থেকে কাজ করছি। এর আগে ছয়বার এ সম্মেলন করেছি আমরা। এবারও সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। এ ধরনের কোনও সমস্যা হবে এটি আমাদের ধারণায়ও ছিল না।  এতো অতিথি আসার যাবতীয় প্রক্রিয়া পরিকল্পনা মাফিক হয়েছে।’

বৃহস্পতিবার সম্মেলন বাতিল করে শুক্রবার হোটেলে অনুষ্ঠানটি করা এবং ফেসবুক লাইভের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনাটি আগেই বিকল্প হিসেবে তৈরি ছিল কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘জিরাবোতে অনুষ্ঠান করা যাবে না জানার পরই খোঁজ করতে থাকি কিভাবে কী করা যায় এবং লা মেডিরিয়ানে এটি করা সম্ভব হয়।’

খিলক্ষেত থানার ওসি শহীদুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘হোটেল লা মেরিডিয়ানে ড. ইউনূস তাদের প্রোগ্রাম করেছেন, তবে কেউ অনুমতি নেয়নি। সাভারে তাদের নিরাপত্তার কারণে অনুমতি দেওয়া না হলে তারা এখানে শিফট করে প্রোগ্রাম করেছে।’

অনুমতির বিষয়টি প্রোগ্রামের উপর নির্ভর করে বলে মনে করেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গুলশান বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মোশতাক আহমেদ। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘লা মেরিডিয়ানে সবসময় বিদেশি গেস্ট থাকে। ইউনূস সেন্টারের অনুষ্ঠানের জন্য অনেক আগেই তারা আসছিল। এখানে তারা বৈঠকও করেছেন।’

/ইউআই/এআরআর/এএম