মন্ত্রীর ক্ষমতা দেখালেন মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান!

মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একাডেমিক স্বীকৃতি বাতিলের আদেশ প্রত্যাহার করার ক্ষমতা কেবল মন্ত্রণালয়ের। মন্ত্রীর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ছাড়া বাতিল আদেশ প্রত্যাহারের সুযোগ নেই। অথচ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ বা পরামর্শ ছাড়াই শূন্য পাস করা ১২টি মাদ্রাসার একাডেমিক স্বীকৃতি বাতিল আদেশ প্রত্যাহার করেছে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড। এই ঘটনা শিক্ষা বোর্ডের এখতিয়ার-বহির্ভূত বলছে মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, মন্ত্রীর ক্ষমতা দেখিয়েছেন মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক একেএম ছায়েফ উল্যা।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তারা বলছেন, নিয়ম অনুযায়ী কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একাডেমিক স্বীকৃতি আদেশ দিয়ে বাতিল করা হলে ওই বাতিল আদেশ প্রত্যাহার করতে পারে না শিক্ষা বোর্ড। সংশ্লিষ্ট কমিটির সুপারিশ ও মন্ত্রীর অনুমোদনের পর মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় প্রত্যাহার করা যায়। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া যদি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান তা করে থাকেন, তাহলে মন্ত্রীর ক্ষমতা দেখিয়েছেন তিনি।

মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই সম্প্রতি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একাডেমিক স্বীকৃতি বাতিলের আদেশ প্রত্যাহার করেছেন। এই ঘটনায় চেয়ারম্যানের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ। গত ১০ সেপ্টেম্বর মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব (মাদ্রাসা) আব্দুল খালেক স্বাক্ষরিত চিঠিতে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে।

ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালের অফিস আদেশ মোতাবেক বেসরকারি মাদ্রাসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রাথমিক পাঠদান অনুমতি, একাডেমিক স্বীকৃতি এবং অতিরিক্ত শ্রেণি, শাখা, বিষয় ও বিভাগ খোলার বিষয় মূল্যায়নের জন্য অতিরিক্ত সচিবকে (মাদ্রাসা) আহ্বায়ক করে সাত সদস্যবিশিষ্ট কমিটি এবং ২০১৭ সালের মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ সৃষ্টির পর একইভাবে আট সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ওই কমিটির একজন সদস্য। কমিটির কার্যপরিধি অনুযায়ী একাডেমিক স্বীকৃতি বাতিলের আদেশ প্রত্যাহারের জন্য মন্ত্রী বা সচিব বরাবর কমিটি সুপারিশ করবে। এ ক্ষেত্রে মন্ত্রী চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন। কমিটি গঠনের পর থেকে এ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড ২০১৭ সালের ১২ নভেম্বর ১২টি মাদ্রাসার একাডেমিক স্বীকৃতি বাতিলের আদেশ প্রত্যাহার করেছে, যা এখতিয়ারবহির্ভূত বলে প্রতীয়মান হয়।

মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন জেলার ১২টি মাদ্রাসার একজন শিক্ষার্থীও ২০১৭ সালের দাখিল পরীক্ষায় পাস করেনি। শুধু তা-ই নয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কাঙ্ক্ষিত শিক্ষার্থীও নেই। আর একটি মাদ্রাসা থেকে ২০১৭ সালের দাখিল পরীক্ষায় একজন পরীক্ষার্থীও অংশ নেয়নি। এ অবস্থায় মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠানগুলোর একাডেমিক স্বীকৃতি বাতিল করে।

একাডেমিক স্বীকৃতি বাতিল করা মাদ্রাসাগুলো হলো, গোপালগঞ্জ সদরের করপাড়া ইউনিয়ন আলিম মাদ্রাসা, টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার কুড়িআটা দাখিল মাদ্রাসা, একই উপজেলার ডুবাইল ইমামবাড়ি দাখিল মাদ্রাসা, জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার কাটাহার রউফিয়া দাখিল মাদ্রাসা, কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার কর্পুরা কারিমিয়া বালিকা দাখিল মাদ্রাসা, ঝালকাঠি সদর উপজেলার মোকাররমপুর দরবার শরীফ দাখিল মাদ্রাসা, একই জেলার নলছিটি উপজেলার দক্ষিণ আওক্ষির মেহেদিয়া দাখিল মাদ্রাসা, পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার লেমুয়া চন্দ্রকান্দা আলিম মাদ্রাসা, কুমিল্লা সদর উপজেলার শাহে মদিনা হরমুজের নেছা আমড়াতলী দাখিল মাদ্রাসা, এই জেলার বরুয়া উপজেলার আগানগর ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসা এবং ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার দক্ষিণ ওসমানগঞ্জ মোজাফফরিয়া দাখিল মাদ্রাসা।

এসব প্রতিষ্ঠানের মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার (এমপিও) সাময়িকভাবে বন্ধ এবং কেনও স্থায়ীভাবে বন্ধ করা হবে না তা জানতে নোটিশ করা প্রয়োজন বলে ২০১৭ সালের ১০ ডিসেম্বর মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ মন্ত্রণালয়ের কাছে সিদ্ধান্ত চায়। শিক্ষা বোর্ডের ওই চিঠির পর কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ ১২টি মাদ্রাসার এমপিও বন্ধের নির্দেশনা জারি করে। নিয়ম অনুযায়ী মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতর প্রতিষ্ঠানের এমপিও বন্ধ করে দেয়।

এত কিছুর পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানতে পারে একাডেমিক স্বীকৃতি বাতিল আদেশ প্রত্যাহার করেছে শিক্ষা বোর্ড। কিন্তু মন্ত্রণালয়কে আগে এ বিষয়ে কিছুই জানানো হয়নি। বাতিল আদেশ প্রত্যাহারের জারি করা চিঠি পেয়ে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের কাছে ব্যাখ্যা চায়। ২০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ব্যাখ্যা পাঠাতে বলা হলেও গত বৃহস্পতিবার (২৮ সেপ্টম্বর) সন্ধ্যা পর্যন্ত ওই চিঠির জবাব দেয়নি শিক্ষা বোর্ড।

এদিকে, এমপিও বন্ধ থাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। একাডেমিক স্বীকৃতি না থাকায় প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু চেয়ারম্যানের জবাব না পাওয়ায় কিংবা প্রতিষ্ঠানের এমপিও বন্ধের আদেশ প্রত্যাহারের বিষয়টি সুরাহাও হচ্ছে না। ফলে একাডেমিক স্বীকৃতি ও এমপিও ফিরে পাওয়ার সব সুযোগ বন্ধ হয়ে রয়েছে। দীর্ঘদিন এ অবস্থার নিরসন না হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে বলে মনে করছেন শিক্ষক ও সংশ্লিষ্টরা।

এ অভিযোগের বিষয়ে জানতে গত তিন দিন মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক একেএম ছায়েফ উল্যার সঙ্গে যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি। মোবাইল ফোনে মেসেজ পাঠালেও কোনও জবাব দেননি তিনি।