জলবায়ুর পরিবর্তন আর মেঘনার করাল গ্রাসে সর্বস্ব হারিয়ে প্রতিবছর উদ্বাস্তু হচ্ছেন নদীপারের হাজার হাজার মানুষ। এসব ভাসমান মানুষের বেশিরভাগেরই ঠিকানা এখন মেঘনার বুকে জেগে ওঠা নতুন চর, বেড়িবাঁধ কিংবা আশ্রয়কেন্দ্রে। এমনই একটি চরের নাম ঢালচর। তবে এই চরে আশ্রয় নিলেও তাদের জীবনে স্বস্তি নেই, অর্ধ শতাব্দী ধরে তাদের লড়াই করতে হচ্ছে দস্যু, লুটেরা, ভূমিখেকোদের সঙ্গে। নোয়াখালী ও ভোলার মাঝামাঝি মেঘনার বুকে জেগে ওঠা এই চরে নেই প্রশাসনের সরাসরি তদারকি। নামমাত্র পুলিশ ক্যাম্প থাকলেও প্রভাবশালীদের ইচ্ছায় চলে এখানকার আইন-কানুন। চরটি সরেজমিন ঘুরে করা ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ পড়ুন তৃতীয় পর্ব।
ষাটের দশকের পর থেকে নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলা ও ভোলার মনপুরা উপজেলার মাঝামাঝি স্থান ঢালচরে বসবাস করে আসছেন অন্তত পাঁচ হাজার নদীভাঙা ভূমিহীন পরিবার। দীর্ঘ এ সময়ে অসংখ্যবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঝড় জলোচ্ছ্বাস মোকাবিলা করে টিকে থাকতে হয়েছে এখানকার ভূমিহীন মানুষগুলোকে। কিন্তু এখনও নিজের দখলে থাকা সরকারের জমিটুকুর স্বীকৃতি মেলেনি। উপরোন্তু সরকারের ভূমি অফিসের নজর পড়েছে অসহায় এই মানুষগুলোর ভিটামাটিতে। অনুসন্ধানে এমন ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে।
হাতিয়া উপজেলা ভূমি অফিসের রেকর্ড অনুযায়ী, ১৯৫০ সালের দিকে মেঘনার বুকে চরটি জেগে উঠলেও ৪০ দশকের দিকে চরটি ডুবোচর হিসেবে ছিল। পরবর্তীতে ১৯৬০ সালের ১১ মে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের পূর্ব পাকিস্তান রাজস্ব বোর্ডের সদস্য এইচবিএইচ বার্নওয়েল ৯১৭ এম এ ই নং স্মারকে ঢালচরকে নোয়াখালী জেলার আওতাধীন নবগঠিত ভূখণ্ড হিসেবে সিদ্ধান্ত দেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ৫১নং তৌজিভুক্ত করে বন্দোবস্ত কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। স্বাধীনতার পূর্বে ১৯৬০-৬১ সালে প্রথম পর্যায়ে হাতিয়া উপজেলাধীন ঢালচরে এক হাজার ১৫৩টি নথি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। প্রতি নথিতে আড়াই একর করে ভূমি দেওয়া হয়। সে সময় উপজেলা সব রেজিস্ট্রি অফিস ৭২টি নথি রেজিস্ট্রেশন করে। একটি মামলায় ওই চরের বিষয়ে আদালতের স্থিতাবস্থার আদেশ থাকায় নথিগুলোর কার্যক্রম স্থগিতাবস্থায় রাখা হয়েছে। পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালের কৃষি খাসজমি ব্যবস্থাপনা ও বন্দোবস্ত নীতিমালা জারির পর আরও এক হাজার ৪০০টি পরিবারের মধ্যে সর্বমোট চার হাজার ২৮২ দশমিক ৫০ একর ভূমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, নোয়াখালীর হাতিয়া ও ভোলার মনপুরা উপজেলার মধ্যবর্তী মেঘনার বুকে জেগে ওঠা এই চরটি নিয়ে দুই জেলার মধ্যে সীমানা বিরোধ রয়েছে। সম্প্রতি এই চরটিকে মনপুরা উপজেলার অন্তর্ভুক্ত রেখে সীমানা নির্ধারণ করে পিলার স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। সে অনুযায়ী পিলার স্থাপন করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ভোলার মনপুরা উপজেলার উপজেলা ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার মো. জাহাঙ্গীর হোসেন এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন দেন উপজেলা সহকারী কমিশনারকে (ভূমি)। এতে তিনি লিখেছেন, ‘ঢালচর বন্দোবস্ত দেওয়ার উপযোগী। নকশায় প্লট কেটে বন্দোবস্ত দেওয়া যেতে পারে। অন্যথায় চরটি জবরদখলের আওতায় চলে যাবে।’ অথচ এই চরে বর্তমানে সরকারিভাবে ভূমি বন্দোবস্ত পেয়ে শত শত ভূমিহীন পরিবার বসবাস করছে। যাদের অধিকাংশ হাতিয়া উপজেলার বিভিন্ন স্থান থেকে নদীভাঙনের কারণে সর্বস্ব হারিয়ে এই চরে এসে আশ্রয় বেঁধেছেন। চরের কোথাও কোনো খালি জায়গা নেই।
মনপুরা উপজেলা ভূমি অফিসের এই কর্মকর্তার প্রতিবেদন অনুযায়ী, যদি এই চরে প্লট কেটে আবার ভূমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয় তাহলে বর্তমানে বসবাসরত শত শত ভূমিহীন পরিবারকে উচ্ছেদ হতে হবে। ভূমি অফিসের এমন সিদ্ধান্তকে ভূমিহীনরা তাদের উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র হিসেবেই দেখছেন। তাদের দাবি, যদি এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তাহলে তাদের উচ্ছেদ করে প্রভাবশালীরা এতে বিভিন্ন ধরনের প্রজেক্ট গড়ে তুলবেন। এরই মধ্যে চরের একটি অংশে মাছের খামার ও রেস্ট হাউজ নির্মাণ করা হয়েছে।
ষাটোর্ধ্ব গিয়াস উদ্দিন হাওলাদার বলেন, বাবা দেখো এই চরে কতো মানুষ ঘরবাড়ি। কিন্তু ওরা (মনপুরা উপজেলা ভূমি অফিস) বলে এখানে নাকি কোনো মানুষ নেই। জনমানবশূন্য চর। ওরা কী আমাদের দেখে না। আমরা তো সরকারকে খাজনা দিয়ে জমি বন্দোবস্ত পেয়েছি। সেগুলো মিথ্যা হলে আমাদের দখলে থাকা খাস জমি আমাদের মাঝে আবার বন্দোবস্তের ব্যবস্থা করা হোক। কিন্তু আমাদের কেন উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। আমাদের উচ্ছেদ করা হলে প্রভাবশালীরা এই চর দখল করে মাছের প্রজেক্ট করবে।
এই প্রতিবেদন সম্পর্কে জানতে মনপুরা উপজেলার উপজেলা ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার মো. জাহাঙ্গীর হোসেনের সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
জানতে চাইলে হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ নূর-ই-আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি ঢালচরের বিষয়টি এরই মধ্যে শুনেছি। এ নিয়ে অনেক মামলা মোকদ্দমা রয়েছে। সমস্যাটি সমাধানে প্রশাসনিক উদ্যোগ নেওয়া হবে।
এদিকে চরটিতে আদালতের স্থিতাবস্থা বজায় রাখার আদেশ ও মালিকানা সংক্রান্ত মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়ার পরেও চরটিকে ভোলা জেলার অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে ১৯৮৯ সালের ১ জুলাই তথা কথিত ডেমপিয়ার এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড ডেইরি ফার্মের অনুকূলে এটিকে অবমুক্ত ঘোষণা করে তৎকালীন ভূমি মন্ত্রণালয়। এ ঘোষণার বিরুদ্ধে মামলার বিবাদী বোর্ড অব রেভিনিউ ভূমি মন্ত্রণালয়ের আদেশ চ্যালেঞ্জ করে প্রতিবাদ জানান। তাদের দাবি, উচ্চ আদালতের স্থিতাবস্থা থাকা অবস্থায় মন্ত্রণালয় এ সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। কিন্তু এরপরেও ওই চরে ফার্মটির নামে জমি দখল করে মাছের খামার তৈরি করা হয়েছে। পাশাপাশি বর্তমানে মনপুরা ভূমি অফিসের এমন উদ্যোগে ভূমিহীনরা তাদের উচ্ছেদ ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন।
জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, রাষ্ট্র কখনোই তার নাগরিকদের সঙ্গে এমন আচরণ করতে পারে না। রাষ্ট্রের দায়িত্ব তার সম্পদের সুষম বণ্টন করে তার নাগরিকদের সমান সুযোগ করে দেওয়া। আমার মনে হচ্ছে এক্ষেত্রে সেটা লঙ্ঘিত হচ্ছে। আর তা যদি হয়, এর দায়দায়িত্ব সরকারের ওপর বর্তাবে।
আরও পড়ুন:
ভূমিহারা মানুষের আশ্রয়ের আকুতি! (ভিডিও)
ভূমিহীনের চরে সাবেক সচিবের অট্টালিকা!