আশ্বাস আর নির্দেশেই সীমাবদ্ধ কেমিক্যাল গুদাম সরানোর প্রসঙ্গ

চকবাজার ট্র্যাজেডি২০১০ সালে নিমতলী ট্র্যাজেডির পর জোরেশোরে শোনা যায় পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক দ্রব্যের গুদাম সরিয়ে নেওয়ার কথা। এরপর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন,  শিল্প সচিবসহ প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা বেশ কয়েকবার গুদাম সরানোর ঘোষণা, আশ্বাস ও নির্দেশ দেন। কিন্তু বাস্তবায়ন আর হয়নি আজও। যার ফলশ্রুতিতে বুধবার আবারও অগ্নিকাণ্ড এবং প্রাণহানির ঘটনা ঘটলো।

বুধবার (২০ ফেব্রুয়ারি) রাতে চকবাজারে একটি ভবনে থাকা কেমিক্যালের গুদামে আগুন লাগার পর পুরান ঢাকায় কোনও ধরনের দাহ্য পদার্থ ও কেমিক্যালের গুদাম থাকতে দেওয়া হবে না বলে ফের ঘোষণা  দিয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটির (ডিএসসিসি) মেয়র সাঈদ খোকন। তিনি বলেন, ‘এসব গুদাম উচ্ছেদের জন্য কঠোর থেকে কঠোরতর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ, পরিবেশ অ্যাক্টিভিস্ট, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, এ ধরনের ঘোষণা আজকে দেওয়ার দরকার হতো না, যদি আমরা নিমতলীর ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতাম। কেবল দাহ্যবস্তু সরিয়ে নেওয়ায় মনোযোগী না হয়ে আগুনের সূত্রপাতের কারণের দিকেও মনোযোগ দেওয়া জরুরি।

তারা বলছেন, বাসা থেকে বের হতে না পারায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানুষ পুড়ে মারা যায়। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো নিয়ে স্থানীয়রা  যদি নিজেরা কাজ করে তাহলে দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব।

চকবাজারের দুর্ঘটনাস্থল২০১৪ সালের ৩ জুন শিল্প সচিব বলেছিলেন, ‘কেমিক্যাল পল্লিতে সাততলা ১৭টি ভবন তৈরি করে গুদাম সরানো হবে।’ পরের বছর ২ ফেব্রুয়ারি কেরানীগঞ্জে ২০ একর জায়গায় পল্লি স্থাপন করার কথা বলেন তিনি।

২০১৭ সালে ফেব্রুয়ারিতে মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, ‘১ মার্চ থেকে পুরান ঢাকার কেমিক্যাল গুদাম স্থানান্তরের কাজ শুরু হবে।’ এর কয়েকদিন পরই তিনি সব কেমিক্যাল কারখানা সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেন।

ঘোষণা দিয়েও বছরের পর বছর তা কার্যকর না করতে পারার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সাঈদ খোকন বলেন, ‘ওই এলাকায় শত শত বাড়িতে কেমিক্যাল  রাখা হয়। আমাদের পক্ষে তো এত নজরদারি করা কঠিন। তারপরও আমরা এবার উদ্যোগ নিয়েছিলাম ওই এলাকার প্রতিটি বাড়ি ধরে ধরে ইন্সপেকশন করবো। অলরেডি কাজও শুরু করে দিয়েছি। কিন্তু হঠাৎ করেই এই দুর্ঘটনা ঘটে গেলো।’

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) এক হিসাবে দেখা গেছে, পুরান ঢাকায় ২৫ হাজার কেমিক্যাল বা রাসায়নিক দাহ্য বস্তুর গুদাম আছে। এসবের মধ্যে ১৫ হাজার আছে বাসাবাড়িতেই। মাত্র আড়াই হাজার গুদামকে ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছে সিটি করপোরেশন। বাকি ২২ হাজারের বেশি গুদামই অবৈধ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার শিক্ষক ও দুর্যোগ পুনর্বাসন বিশেষজ্ঞ গওহর নঈম ওয়ারা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মূল সমস্যা হচ্ছে অগ্নি ব্যবস্থাপনা। কেমিক্যাল থাকলে বা না থাকলেও আগুন ধরতে পারে। কাজেই গুদাম সরিয়ে নিয়ে যেখানে যাবে সেখানেও তো আগুন লাগতে পারে। আমাদের ব্যবস্থাপনা নিয়ে ভাবতে হবে।’

চকবাজারে অগ্নিকাণ্ডের ধ্বংসস্তূপনিমতলীর মতোই এখানেও মানুষ বের হতে না পেরে মারা গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সিস্টেমগুলো কাজ করছে না। চোরের ভয়ে প্রত্যেক বাড়িতে এমনভাবে গ্রিল দিয়েছে যে আগুন লাগলে তা ভেঙে বের হওয়ার অবস্থা নেই। এগুলো নিয়ে কেউ কথা বলে না।’

অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা  নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘কোনও জায়গায় দমকল বাহিনী আগুন নেভানোর আগেই অনেক কিছু ঘটে যায়। ফলে কমিউনিটিভিত্তিক একটি ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। সরকার শক্তিশালী, তারা চাইলেই এটি করতে পারে।’

বাপা’র সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন বলেন, ‘কেমিক্যাল গুদাম সরিয়ে নিতে কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কারণেই এই দুর্ঘটনা।  ২০১০ সালের নিমতলীর ঘটনার পর দাহ্য পদার্থের গুদাম আলাদা জায়গায় সরিয়ে নেওয়া হবে সিদ্ধান্ত ছিল। কেমিক্যাল পল্লির কথাও শুনেছিলাম। তারপর ভেতরে ভেতরে কী হলো আমরা জানি না। ব্যবসায়ী মহলকে সহাযোগিতা করতে হবে। জীবনের বিনিময়ে ব্যবসা করা ভালো না। এতগুলো মানুষ নিহতের ঘটনায় দায় তাদেরও আছে।’

চকবাজারে আগ্নিকাণ্ড

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করেন গবেষক আফসান চৌধুরী। তার মতে, ‘এই দুর্ঘটনার দায় গোটা ব্যবস্থার। আমাদের চোখে কী পড়ছে না তা? নিমতলীর ঘটনার পর ৩৮টি সুপারিশ দেওয়া হয়েছিল। সেগুলোর কয়টা বাস্তবায়ন হয়েছে? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, এসব দাহ্য পদার্থ সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। আবার ফিরে এসেছে। প্রশ্ন হলো, ফিরে যেন না আসতে পারে সেটা দেখবে কে?’

কেমিক্যাল পল্লিতে সরিয়ে নেওয়ার কাজ কতদূর  প্রশ্নে শিল্প সচিব আব্দুল হালিম বলেন, ‘কেমিক্যাল পল্লি প্রকল্পটি ২০২১ সাল পর্যন্ত। ৫০ একরের প্রজেক্ট। প্রায় ৯৫০ গুদাম সরানো যাবে।’

২০২১ সালের মধ্যেই গুদাম সরবে কিনা প্রশ্ন করা হলে তিনি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, ‘প্রকল্পটি ২০২১ সাল পর্যন্ত। সরিয়ে নেওয়ার কাজ সহজ হবে না। তারা এই ব্যবসা নিয়ে দূরে যেতে চান না। ঢাকার যেকোনও পাশে বা উত্তরে নিয়ে যাবো, তারা সেদিকে যাবে না। ফলে কেরানীগঞ্জ বা আশপাশেই তাদের নিতে হবে।’