‘কমিশনারের অফিসে গেছি, তবুও তালিকায় নাম উঠে নাই’

আশ্রয়কেন্দ্রে ক্ষতিগ্রস্তদের ভিড়‘আগুনে আমার ঘরের সব জিনিস পুড়ে গেছে।  কমিশনার অফিসে নামের তালিকা করতেছে। কিন্তু, ওই তালিকায় আমার নাম নাই। তালিকায় নাম লেখাইতে আমি কমিশনারের অফিসে গেছিলাম। তারা কয়, বাড়ির মালিকরে নিয়া আসো। বাড়ির মালিকরে কইলাম, হেয় (তিনি) যাইবো না। এহন কি করি? এই বস্তিতেই থাকছি, এহন তালিকায় নাম উঠবো না কেন?’ মিরপুর ৬ নম্বর ঝিলপাড় বস্তির আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত শামসুন্নাহার বাংলা ট্রিবিউনকে এসব কথা বলেন।

ঝিলপাড় বস্তির চলন্তিকা মোড় অংশের বাবু মিয়ার বাড়িতে দুটি ঘরে পরিবার নিয়ে থাকতেন শামসুন্নাহার। তার স্বামী সাহাবুদ্দিন মিরপুর এলাকাতেই সবজি বিক্রি করতেন। তাদের গ্রামের বাড়ি ভোলার ধনিয়া ইউনিয়নে।  ২০ বছর যাবত এই বস্তিতে  তাদের বসবাস।

শামসুন্নাহার বলেন, ‘গতকাল (রবিবার) গেছিলাম, আজকেও (সোমবার) গেছিলাম। কিন্তু কাজ হয় নাই। আমার তো কিছুই নাই। তালিকায় নাম থাকলে সরকারের সাহায্য তো পাইতাম। নাম না উঠলে কিছুই পামুনা। কিন্তু, বাড়িওয়ালা কমিশনারের অফিসে যাইবো না কয়।’

শুধু শামসুন্নাহার নয়, তার মতো অনেকেরই নাম ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকায় এখনও ওঠেনি। এ বিষয়ে বাড়ির মালিকরাও সহযোগিতা করছে না বলে অভিযোগ ক্ষতিগ্রস্তদের। এদিকে, আগুনের তিন দিন পার হলেও বস্তির ক্ষতিগ্রস্ত লোকের সংখ্যা ও পরিবারের হিসাব জানাতে পারেননি জনপ্রতিনিধিরা। তারা বলছেন, তালিকা প্রস্তুতের কাজ চলছে।

মিরপুর ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার হাজী রজ্জব হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আগুনের ঘটনার পর থেকে আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরির কাজ করছি। এটি এখনও চলামান রয়েছে। এখন পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্তদের সংখ্যা কত তা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব হচ্ছে না। তবে বস্তিতে যারা ভাড়াটিয়া হিসেবে ছিল, তাদের বেশি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।’ 

রজ্জব হোসেন বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দাদের দিনে তিন বেলা খাবার দিচ্ছি আমরা। আপাতত স্থানীয় পাঁচটি স্কুলে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যতদিন তাদের ঘরবাড়ি তৈরি না হবে, ততদিন সরকারের পক্ষ থেকে আমরা  খাবারের ব্যবস্থা করবো।’

আগুনের ঘটনাটি নাশকতার অংশ কি না? জানতে চাইলে রজ্জব হোসেন বলেন, ‘এটি একটি দুর্ঘটনা। বস্তির এই জায়গাটি গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের। এখানে এমন কেউ নেই যে সরকারি জায়গা দখল করবে। দখলদারিত্বের কোনও বিষয় এখানে নেই। তাই নাশকতার প্রশ্নও আসে না।’

শুক্রবার (১৬ আগস্ট) সন্ধ্যায় এই বস্তিতে আগুনের ঘটনা ঘটে। মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে পুরো বস্তিতে। ঝিলপাড় বস্তি পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে।

পুড়ে যাওয়া জিনিসপত্র ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের উপ-পরিচালক (অ্যাম্বুলেন্স) আবুল হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,  ‘মিরপুর ঝিলপাড় বস্তিতে প্লাস্টিকের পাইপ ব্যবহার করে প্রতিটি বাড়িতেই গ্যাস সংযোগ নেওয়া হয়েছিল। এগুলো অনেক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ছিল। আমরা আগুন নিয়ন্ত্রণের জন্য সেখানে কাজ করার সময় সেগুলো থাকতে দেখেছি। অনিরাপদভাবে অনেক বিদ্যুতের সংযোগও থাকতে দেখা গেছে। আগুনের কারণে গ্যাসের প্লাস্টিকের পাইপগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে এগুলো বৈধ ছিল, না কি অবৈধ ছিল সে বিষেয়ে আমরা এখনও তথ্য পাইনি। আগুনের ঘটনায় তদন্ত চলমান রয়েছে। তদন্ত শেষে এ বিষয়ে বলা যাবে।’

বস্তিতে কি পরিমাণ গ্যাস-বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ ছিল? জানতে চাইলে মিরপুর ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার হাজী রজ্জব হোসেন বলেন, ‘গ্যাস-বিদ্যুতের বৈধ সংযোগ যেমন ছিল, আবার অনেক অবৈধ সংযোগও ছিল। কতগুলো ছিল তা নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। একটি ঝিলের উপর পাটাতন করে বস্তিবাসী এখানে ঘর তুলে বসবাস শুরু করেছে। প্লাস্টিকের পাইপ ব্যবহার করে যে তারা এসব গ্যাসের সংযোগ নিয়েছিল, তা আমাদের জানা ছিল না।’  

সোমবার (১৯ আগস্ট) মিরপুর ৬ নম্বর ঝিলপাড় বস্তির চলন্তিকা মোড়ের জিকা গার্মেন্টস সংলগ্ন বঙ্গবন্ধু স্কুলের বাইরে সরেজমিনে দেখা গেছে, বস্তির ক্ষতিগ্রস্তদের ভিড়। স্কুলের পাশে সড়কে থাকা নারীদের হাতে একটি করে শাড়ি আর পুরুষদের হাতে একটি করে লুঙ্গি। সংসদ সদস্য ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লার পক্ষ থেকে সবাইকে এই কাপড় দেওয়া হয়েছে। কাপড় বিতরণের পর হাতে বাটি আর ছোট-ছোট হাড়ি নিয়ে ভিড় করছে লোকজন। দুপুরের খাবার সংগ্রহ করতে এই ভিড়। এদিকে বস্তির ভেতরে পুড়ে যাওয়া লোহার আসবাবপত্র ও ঘরের টিন সংগ্রহ করছে ভাঙারি ব্যবসায়ীরা। তারা বাড়ি-বাড়ি ধরে চুক্তিভিত্তিক দরে সেগুলা কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। বস্তির ভেতর থেকে সেগুলো সংগ্রহ করছেন।

ঝিলপাড় বস্তিতে বাবু মিয়ার বাড়িতে দুটি ঘর ভাড়া নিয়ে বসবাস করতেন শাহাবুদ্দিন। তার গ্রামের বাড়ি বরিশালের ভোলার ধনিয়া ইউনিয়নে। তিনি বলেন, ‘গ্রামের ভিটা-মাটি সব একবার নদী ভাঙনে হারিয়েছি। এরপর ঢাকা শহরে আইয়া পড়ছি। এই বস্তিতে থাকতাছি ২০ বছর হলো। লেবারি কাম (দিন মজুরের কাজ) করি। যাও কিছু জিসিনপত্র করছিলাম, তাও আগুনে পুইড়া গেছে। আগুনের দিন থেকে টানা তিন দিন একই লুঙ্গি পইরা ছিলাম। আজ সরকারের পক্ষ থেকে মাইকিং কইরা শাড়ি-লুঙ্গি দিছে।’

ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দা শিল্পী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এখানে এক বেলা খাবার পাইলে আরেক বেলা পাই না।  বস্তির লোক ছাড়াও অনেক লোক খাবার নিতে আসে। এই কারণে যারা বস্তির বাসিন্দা তারা ঠিকমতো খাবার পান না।’