শ্রমজীবীদের সংকট কাটবে কবে?

করোনা মহামারির কারণে গত বছর মে দিবসের আগে-পরে দেশে টানা ৬৬ দিনের লকডাউন ছিল। এবারও করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে একই সময়ে চলছে কঠোর বিধি-নিষেধ। এতে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন শ্রমিক শ্রেণির একটি বড় অংশ। পরিবার-পরিজন নিয়ে কষ্টে জীবন-যাপন করতে হচ্ছে তাদের। কাজের জন্য রাস্তায় নামতে না পারা ঘরবন্দি শ্রমজীবী এই মানুষেরা দিন গুণছেন সুদিন ফেরার আশায়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় এক মাস ধরে চলমান লকডাউনে সব চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবহন শ্রমিক, দিনমজুর, কুলি, নির্মাণ শ্রমিক, পর্যটন শিল্প-হোটেল-রেস্তোরাঁর কর্মী, হকার শ্রেণি, নরসুন্দরের মতো অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা। বাংলাদেশে শ্রমশক্তির বড় অংশ রয়েছে এসব অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। তাদের না আছে কাজ, না আছে শ্রম আইনে তাদের কাজের স্বীকৃতি।

সীমিত পরিসরে পোশাক ও শিল্পকারখানা খুললেও সেখানকার শ্রমিকেরাও আছেন চাকরি হারানোর ঝুঁকি এবং আসন্ন ঈদে বেতন-বোনাস না পাওয়ার আশঙ্কায়। সীমিত পরিসরে দোকানপাট খোলা হলেও বেচাকেনা না হওয়ায় পোশাক শ্রমিকদের মতো সেখান কর্মীদের মধ্যেও একই আশঙ্কা কাজ করছে। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় এই দুই খাতের শ্রমিকদের দীর্ঘ পথ হেঁটে কর্মস্থলে যাতায়াত করতে হচ্ছে।

সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত যারা

করোনার কারণে এখন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবহন শ্রমিকেরা। গণপরিবহন চলাচল বন্ধ থাকায় এই খাতের ৭০ লাখ শ্রমিক মানবতার জীবন-যাপন করছেন। কর্মহীন এই পরিবহন শ্রমিকরা গণপরিবহন চালুর দাবিকে ইতোমধ্যে আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাস চালুর দাবি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। সংগঠনের সভাপতি মসিউর রহমান রাঙ্গা ও মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ যৌথ বিবৃতিতে বলেছেন, সারাদেশের পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের মধ্যে সাংঘাতিকভাবে ক্ষোভ বিরাজ করছে। বাস চালুর দাবিতে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ চলছে। সামনে ঈদ। লাখ লাখ শ্রমিক কর্মহীন অবস্থায় আছে।

কী বলছেন শ্রমিকরা

যাত্রাবাড়ি-গাবতলী রুটের একটি বাসের হেলপার জহিরুল। বাস চলাচল বন্ধ হওয়ার পরই বেকার হয়ে পড়েন। বাস চালু হতে পারে এমন প্রত্যাশায় গ্রামের বাড়িতেও যাননি। পরে বাধ্য হয়ে এখন যাত্রাবাড়ি চৌরাস্তা ও মাছ বাজার এলাকায় ঘুরে ঘুরে মাস্ক বিক্রি করছেন। তবে তাতে তার নিজের চলার মতো অর্থ আসে না বলে জানান। তার প্রত্যাশা দ্রুত যেন গণপরিবহন চালু হয়।

নির্মাণ শ্রমিক লকডাউনের আওতাভুক্ত হলেও সরকারি ও বেসরকারি প্রকল্পের বেশিরভাগ কাজ বন্ধ থাকায় তাদের বড় অংশ কর্মহীন। ফলে কাজ হারাচ্ছেন এ খাতের শ্রমিকেরা। অনেকে কাজ পেলেও আগের চেয়ে কম মজুরি পাচ্ছেন।

কেরানীগঞ্জের একটি আবাসিক এলাকার নির্মাণ শ্রমিক মাসুদ হোসেন জানান, লকডাউন শুরু হওয়ার পর বেশিরভাগ ভবন নির্মাণের কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। এ কারণে তাদের অনেক সহকর্মী গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে।  তার মতো যারা আছেন তাদের আগের চেয়ে কম মজুরিতে কাজ করতে হচ্ছে। তারপরও মাঝে মধ্যে কাজ না পেয়ে বসে থাকতে হচ্ছে।

কিছুটা স্বস্তিতে কৃষিখাত

অবশ্য বোরো মৌসুমের ধান কাটা শুরু হওয়ায় আপাতত কিছুটা স্বস্তিতে রয়েছেন কৃষি শ্রমিকেরা। দেশের অনানুষ্ঠানিক এ খাতের নারী-পুরুষ মিলে আড়াই কোটি শ্রমিকের বড় একটি অংশের এই মুহূর্তে কর্মে নিয়োজিত। তবে ধানাকাটা-মাড়াই মিলে দেড় থেকে দুই মাস তাদের কাজ করার সুযোগ থাকবে। এরপর বিকল্প কর্মসংস্থান না পেলে তারা আবারও কর্মহীন হয়ে পড়বেন।

ক্ষতি হলো কতটা

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) ও সুইডেনের ওয়েজ ইন্ডিকেটর ফাউন্ডেশন (ডব্লিউআইএফ) দেশের চারটি খাতের শ্রমিকদের নিয়ে একটি জরিপ করেছে। তাদের জরিপ অনুযায়ী তৈরি পোশাক, চামড়া, নির্মাণ ও চা—এই চার শিল্প খাতের শ্রমিকদের ৮০ শতাংশ, অর্থাৎ প্রতি ১০০ জন শ্রমিকের মধ্যে ৮০ জনেরই মজুরি কমেছে।

এদিকে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক জরিপে বলা হয়, করোনার গত এক বছরে দেশের দুই কোটি ৪৫ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। করোনার দ্বিতীয় ধাক্কার ফলে এ হার আবারও বাড়তে পারে—এমন আশঙ্কার কথাও জানিয়েছে তারা।

সম্প্রতি প্রকাশিত সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) এর এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনার সংকটকালে দেশের শ্রমিকদের মাত্র আট শতাংশ সরকারের দেওয়া খাদ্য ও অর্থ সহায়তা পেয়েছে। করোনার সময় কেবল শহর অঞ্চলে ১০ লাখ শ্রমিক চাকুরিচ্যুত হয়েছে বলে তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক মে দিবস উপলক্ষে এক বিবৃতিতে বলেন, দেশে করোনা লকডাউনে শ্রমজীবীদের জীবনমান আরও শোচনীয় হয়েছে। নতুন করে তিন কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। পাটকল-চিনিকল বন্ধ করায় লক্ষাধিক শ্রমিক-কর্মচারী এখন বেকার। শ্রমিক-মেহনতিদের ঘরে ঘরে হাহাকার। তাদের জন্য বরাদ্দ করা যৎসামান্য টাকা নিয়ে চলছে চরম অনিয়ম, দুর্নীতি আর দলীয়করণ। ভোটের অধিকার না থাকায় গরিব শ্রমজীবীরা আরও নিঃস্ব ও ক্ষমতাহীন হয়েছে।

গার্মেন্টস শ্রমিক ফ্রন্টের সভাপতি আহসান হাবিব বুলবুল ও সাধারণ সম্পাদক সেলিম মাহমুদ  বিবৃতিতে বলেন, করোনার লকডাউনের মধ্যেও পোশাক শ্রমিকরা দেশের অর্থনীতি ও রফতানির প্রয়োজনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উৎপাদনের চাকা সচল রেখেছেন। কিন্তু সরকার শ্রমিকদের এই ত্যাগের কোনও স্বীকৃতি দেয়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শ্রম ও কর্ম সংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন, ‘ছাঁটাই করা হয়েছে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে যতটা বলা হয়েছে ততটা নয়। মালিকপক্ষ শ্রমিকদের একটি অংশ ছাঁটাই করে তাদের পাওনা বুঝিয়ে দিয়েছে। আইনে যেহেতু এই বিধান রয়েছে সেক্ষেত্রে আমাদের করণীয় নেই। তবে অনেকে পাওনা বুঝিয়ে না দিয়ে ছাঁটাই করেছে। তারা আমাদের কাছে অভিযোগ করেছে। আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।’

আরও পড়ুন-

গৃহশ্রমিকরা তবে যাবেন কোথায়?

ভালো নেই গার্মেন্ট শ্রমিকরা