বঙ্গবন্ধুর খুনিকে ফেরত আনার তিন কৌশল
যেভাবে থাইল্যান্ড থেকে ফেরত আনা হয় বঙ্গবন্ধুর খুনি বজলুল হুদাকে
থাই পররাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগের ফলশ্রুতিতে বঙ্গবন্ধুর খুনি বজলুল হুদার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা হয়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যার অভিযোগে মামলা করার পর বিপদেই পড়ে যায় বজলুল হুদা। মামলার প্রথম পর্যায়ে সে দাবি করতে থাকে, যাকে খোঁজা হচ্ছে সেই ‘খুনি বজলুল হুদা’ অন্য ব্যক্তি। তার এ দাবি পরে মিথ্যা প্রমাণ হয়।
কোর্টে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রধান যুক্তি ছিল, সামরিক ক্যুর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়নি। কয়েকজন বিপথগামী সামরিক অফিসার ট্যাংক রেজিমেন্টের সহায়তায় এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটায়। এ ছাড়া এই হত্যাকাণ্ডের সময় রাষ্ট্রপ্রধান ছাড়াও তাঁর পরিবারের সদস্য, আত্মীয় ও অন্য ব্যক্তিরাও নিহত হন। পরে নভেম্বরে চার নেতাকেও হত্যা করা হয়।
এই হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের ১৯৭৫ সালে ঢাকা থেকে থাইল্যান্ডে পাঠানো হয়। তখন ব্যাংককে ফারুক, রশিদরা স্বীকার করেছিল যে তারাই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে। বজলুল হুদাসহ অন্যরাও আত্মস্বীকৃত খুনি। এ কারণে এটি ক্যু নয়। আর তা প্রমাণের জন্য ঢাকায় যে কাগজপত্র পাঠানো হয়েছিল সেটি কোর্টে উপস্থাপন করা হয়। অবশেষে কোর্ট রায় দেন বজলুল হুদা বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান হত্যায় জড়িত।
এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করে বজলুল হুদা। কিন্তু সেখানেও অপরাধ প্রমাণ হয় এবং তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো উচিত মর্মে নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু কোনও কোর্টে তাকে শাস্তি দেওয়া হয়নি।
তৎকালীন রাষ্ট্রদূত আকরামুল কাদের বলেন, ‘ঢাকা ১৯৯৮ সালের এই রায়ে অত্যন্ত খুশি হয়েছিল। পরে বজলুল হুদা প্রধান বিচারপতির আদালতে আপিল করে। সেখানেও একই ফল আসে। আমরা মামলায় জিতে যাই এবং বঙ্গবন্ধুর খুনিকে দেশে ফেরত পাঠানোর আদেশ দেওয়া হয়।’
প্রত্যর্পণ চুক্তির অধীনে ফেরত আসেনি
বজলুল হুদাকে ফেরত আনার জন্য প্রত্যর্পণ চুক্তিতে দ্রুত বাংলাদেশ সই করে এবং অনুসমর্থন করে। থাইল্যান্ড চুক্তিটি সই করলেও প্রক্রিয়াগত কারণে অনুসমর্থন করতে দেরি হচ্ছিল। কিন্তু অনুসমর্থন ছাড়া এ চুক্তির অধীনে কাউকে ফেরত পাঠানো সম্ভব ছিল না।
সাবেক রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘এটি অনেকে জানে না যে প্রত্যর্পণ চুক্তির অধীনে বজলুল হুদাকে ফেরত পাঠানো হয়নি। কারণ, তাকে যখন ফেরত পাঠানো হয় তখনও চুক্তিটি কার্যকর হয়নি।’
চূড়ান্ত চেষ্টা
অনুসমর্থনে দেরি হওয়ায় খুনিকে ফেরত আনতে রাষ্ট্রদূত ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেন। থাই পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ডেপুটি ফরেন মিনিস্টারকে তিনি রাজি করিয়ে ফেলেন খুনিকে ফেরত পাঠানোর জন্য প্রয়োজনীয় অনুমোদন জোগাড় করে দিতে।
এদিকে ওই সময় বজলুল হুদা নিজেকে স্টেটলেস তথা রাষ্ট্রহীন ব্যক্তি দাবি করে বাংলাদেশে ফেরত যেতে অস্বীকৃতি জানায়। খুনি এ বিষয়ে রাজার কাছে ক্ষমাও ভিক্ষা চায়।
আকরামুল কাদের বলেন, ‘এ পর্যায়ে এসে আমার কাজ জটিল হয়ে পড়ে। কারণ, রাজার কাছ থেকে ক্ষমাভিক্ষা পেয়ে গেলে বজলুল হুদাকে দেশে ফেরত পাঠানো সম্ভব হতো না।’
জটিল কাজ
বজলুল হুদার এই চালের বিপরীতে দ্রুত কার্যক্রম শুরু করেন রাষ্ট্রদূত। আগেই থাই পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ডেপুটি ফরেন মিনিস্টারকে রাজি করিয়ে ফেলেছিলেন। এখন তাদের মাধ্যমে কেবিনেট থেকে অনুমোদন আদায় করার অনুরোধ করলে রাজি হন তারা। পরে অনুমোদনও দিয়ে দেয় ক্যাবিনেট।
এদিকে রাষ্ট্রদূতের চেষ্টা ছিল ক্ষমাভিক্ষার আবেদন রাজপ্রাসাদে পৌঁছার আগেই খুনিকে দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা।
রাষ্ট্রদূত বললেন, ‘বজলুল হুদার বড় দুর্বলতা ছিল সরকারি সিস্টেমের বাইরে থেকে প্রভাব খাটানোর উপায় ছিল না। পুরোটা নির্ভর করছিল থাই সরকারের মনোভাবের ওপর। ওই ক্ষেত্রে আমি একটি জায়গা তৈরি করতে পেরেছিলাম। খুনি তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করলেও সফল আমরাই হয়েছি।’
বিভিন্ন মহলের চাপ
‘ব্যাংককে বিএনপি ঘরানার একটি দল বজলুল হুদার বিষয়ে সোচ্চার ছিল এবং অবধারিতভাবে তারা আমাদের পরিকল্পনা ও কাজে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। এটি সরাসরি চাপ ছিল না। কিন্তু পরোক্ষভাবে আমাদের প্রভাবিত করেছিল’, জানালেন আকরামুল কাদের।
ওই সময় বজলুল হুদাকে ফেরত পাঠানো হলে তার বোন ও আব্দুল আজিজ পাশার সহধর্মিণী আকরামুল কাদেরকে দেখে নেওয়ার হুমকিও দেয়।
আকরামুল কাদের বলেন, ‘আমি যখন ২০০১ সালে দেশে ফেরত আসি তখন কিছুটা আতঙ্কে ছিলাম। বিশেষ করে র্যাব গঠনের পর। সব সময় বাসায় থাকতাম। আমার মনে আছে এ সংক্রান্ত কিছু কাগজ আমি পুড়িয়েও ফেলেছিলাম।’
ফেরত আনার তোড়জোর
খুনিকে দেশে ফেরত পাঠানোর কেবিনেট অনুমোদন পাওয়ার পর ঢাকায় প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়। বিমান বাহিনীর একটি রাশিয়ান আন্তোনভ-৩২ প্লেন ব্যাংককে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। এ জন্য ইয়াংগুনের কাছ থেকে ওভার-ফ্লাইট অনুমতিও নেওয়া হয়। প্রথম যে তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছিল সেটি বদলানো হয় এবং প্লেনটির জন্য পুনরায় ওভার-ফ্লাইট অনুমোদন নেওয়া হয়। বিষয়টির গোপনীয়তা এত বেশি ছিল যে উড়োজাহাজটির পাইলট নৌশাদুল হকও (সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হকের ভাই) জানতেন না তার ব্যাংকক যাওয়ার মূল কারণ কী।
সাবেক রাষ্ট্রদূত আকরামুল বলেন, ‘বিষয়টি গোপন রাখার জন্য বলা হয় ঢাকা থেকে ব্যাংককে প্রশিক্ষণ মিশনের জন্য প্লেন পাঠানো হচ্ছে।’
হাই ভ্যালু প্রিজনার
বজলুল হুদাকে ফেরত পাঠানোর আগের দিন রাষ্ট্রদূতকে ভোরে জেলারের অফিসে থাকার অনুরোধ করা হয়। রাষ্ট্রদূত বলেন, “আমি অনেক সকালে ঘুম থেকে উঠে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলাম। আমার স্ত্রীও জানতেন না আমি কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি। সকাল সাতটার দিকে জেলখানায় পৌঁছালে আমাকে অনেক কাগজ দেওয়া হয় সই করার জন্য। সই করার পর ‘হাই ভ্যালু প্রিজনার’ হিসেবে বজলুল হুদাকে আমার কাছে হস্তান্তর করা হয়।”
কনভয়
বজলুল হুদাকে একটি কনভয়ের মাধ্যমে বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই কনভয়ের কয়েকটি গাড়িতে মেশিনগান স্থাপন করা ছিল এবং গোটা কনভয়টিতে কমান্ডোরা অংশগ্রহণ করেন। বজলুল হুদাকে একটি গাড়িতে বসানো হয় এবং সাইরেন বাজিয়ে কনভয়টি বিমানবন্দরের দিকে রওনা দেয়।
রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘কমান্ডোদের ওপর কড়া নির্দেশ ছিল, রাস্তায় কোনও প্রতিবন্ধকতা পেলে সেটাকে উপড়ে ফেলতে। আমরা দোরমন্ট বিমানবন্দরের রানওয়ে পার হয়ে এয়ারফোর্স বেইজে সরাসরি পৌঁছে যাই। সেখানে আব্দুল কাহার আখন্দের কাছে বজলুল হুদাকে বুঝিয়ে দিই। প্লেনে ওঠার পরে বজলুল হুদাকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়।’
আমার মনে আছে, প্লেনে ওঠার আগে বজলুল হুদা আমাকে বলেছিল, ‘তোমার সঙ্গে আমার ঢাকায় দেখা হবে। আমি বলেছিলাম ওকে, কোনও অসুবিধা নেই।’