প্রবাসী শ্রমিকদের উগ্রবাদে জড়ানোর প্রবণতা নেই: গবেষণা

নিজের ও পরিবারের ভাগ্য বদলাতে প্রবাসে যাওয়া শ্রমিকদের মধ্যে ধর্মীয় উগ্রবাদে জড়ানোর প্রবণতা নেই। নতুন এক গবেষণায় উঠে এসেছে এমন তথ্য।

মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে কাজ করতে গিয়ে বাংলাদেশিরা উগ্রবাদে জড়িয়েছেন এমন ঘটনা নেই বললেই চলে। প্রবাসীদের বেশিরভাগ বিশ্বাস করেন, রাজনীতিক, তরুণ নেতৃত্ব ও নাগরিক সমাজের মাধ্যমে সমাজ ও দেশের ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।

বৃহস্পতিবার (২৪ নভেম্বর) রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে ‘উগ্রবাদ ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন: বাংলাদেশ পরিপ্রেক্ষিতে এর বাস্তবতা’ শীর্ষক এ গবেষণার বিষয়টি তুলে ধরা হয়। ব্র্যাকের সহযোগিতায় গবেষণাটি করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সাহাব এনাম খান।

সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, কুয়েত, কাতার, লিবিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত দেশে ফেরা ৪০০ প্রবাসীর ওপর গবেষণাটি পরিচালনা করা হয়েছে। গত এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কুমিল্লা, টাঙ্গাইল, চট্টগ্রাম, ঢাকা ও মুন্সীগঞ্জে পরিচালিত হয়েছে গবেষণাটি।

প্রতি বছর গড়ে প্রায় পাঁচ থেকে ছয় লাখ লোক বিদেশে যায়। রেমিটেন্স প্রদানের মাধ্যমে তারা দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা রাখে। পাশাপাশি প্রতি বছর গড়ে ৫০ থেকে ৬০ হাজার বাংলাদেশি চাকুরি হারানোসহ নানা কারণে দেশে ফিরে আসে।

মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে কাজ করতে গিয়ে বাংলাদেশিরা উগ্রবাদে জড়িয়েছেন এমন ঘটনা নেই বললেই চলে। তবে জঙ্গি সংগঠনগুলোকে সমর্থন করার অভিযোগে ২০১৫ ও ২০১৬ সালে দুই দফায় ৩২ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠায় সিঙ্গাপুর। অন্য কোনও দেশ থেকে সেভাবে এমন ঘটনা শোনা যায়নি। তবে কোটি বাংলাদেশি যেহেতু বিদেশে কাজ করেন এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী আয় বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কাজেই বিষয়টি নিয়ে একটা গবেষণা জরুরি ছিল।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে ড. সাহাব বলেন, গবেষণার ফলাফলে বাংলাদেশি প্রবাসী শ্রমিকদের মধ্যে ধর্মীয় উগ্রপন্থার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থা এমন যে মানুষ উগ্রবাদের দিকে ঝোঁকে না। বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকদের উগ্রবাদে না জড়ানোর আরেকটি বড় কারণ, দৃঢ় পারিবারিক বন্ধন ও পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধ। তাদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষ নিজেদের আর্থিক দুরাবস্থা দূর করতে এবং জীবনমান উন্নয়নের স্বপ্ন নিয়ে বিদেশে যায়। ফলে যে অর্থ ও সম্পদের জন্য তারা বিদেশে কাজ করে, অর্জন করে- তা হারানোর ভয় তার মধ্যে থাকে; ফলে তারা উগ্রপন্থার দিকে যায় না।

প্রবাসে ধর্মীয় পরিচয়ের চাইতে দেশের পরিচয় দিতেই বাংলাদেশি শ্রমিকরা বেশি স্বস্তিবোধ করেন বলে জানান এই গবেষক। তিনি বলেন, বাংলাদেশি শ্রমিকদের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশকেই আমরা দেখেছি, তারা নিজেদের ধর্মীয় পরিচয়ের আগে বাঙালি পরিচয়কে প্রাধান্য দেয়। পাশাপাশি সমাজ ও দেশে পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রেও ৯৪.২ শতাংশ কোনও উগ্রপন্থাকে সমর্থন না করে রাজনীতিবিদ, তরুণ নেতৃত্ব ও নাগরিক সমাজের মাধ্যমে পরিবর্তন আসবে বলে মনে করে। মাত্র ৫.৮ শতাংশ মনে করে, ধর্মীয় নেতাদের মাধ্যমে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে।

বিভিন্ন সময়ে প্রবাসীদের অর্থ উগ্রপন্থায় ব্যবহৃত হওয়ার অভিযোগটিও এই গবেষণায় যাচাই করা হয়েছে বলে অনুষ্ঠানে জানানো হয়। গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, পরিবারের কাছে অর্থ পাঠানোর বাইরে দাতব্য কাজে অর্থ ব্যয় করেন ৪৪. ৮ শতাংশ প্রবাসী। গবেষণায় উত্তরদাতাদের ২.৩ শতাংশ তাদের অর্থ ধর্মীয় কাজে দান করেন।

প্রবাসী শ্রমিকদের মধ্যে উগ্রবাদের প্রবণতা না থাকলেও কিছু ঝুঁকির কথা তুলে ধরেন অধ্যাপক সাহাব। উগ্রবাদ ও ধর্ম চর্চা- এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য বোঝার জন্য যে শিক্ষা ও দক্ষতার দরকার, তার যথেষ্ট অভাব আছে বলে মনে করেন তিনি। সেই সঙ্গে সামাজিক বৈষম্য, বঞ্চনা, অর্থনৈতিক আগ্রাসন, নিরাপত্তাহীনতা, কম বেতন ইত্যাদি থেকে সৃষ্ট হতাশাজনক পরিস্থিতির কথাও উল্লেখ করেন তিনি।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণের যে প্রয়োজনীয়তা আছে, সেই প্রসঙ্গে অধ্যাপক সাহাব বলেন, “গবেষণাটিতে আমরা দেখেছি উত্তরদাতাদের মধ্যে ১৭.৬ শতাংশ সামাজিক মাধ্যমে ধর্মীয় জ্ঞান শেয়ার করছেন। আশঙ্কার বিষয় হলো- আমাদের প্রবাসীদের ডিজিটাল সাক্ষরতা কম। ফলে অনেক ভুল ও উস্কানিমূলক তথ্য তাদের হাত ধরে ছড়িয়ে পড়ে। এতে কেউ কেউ ভুল করে ফেলতে পারেন।”

গবেষণায় ৯টি সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। যার মধ্যে আছে- শ্রমিকদের বিদেশে পাঠানোর আগেই সংশ্লিষ্ট দেশের আইন ও নিয়মকানুন জানানো, রেমিটেন্সের যথাযথ ব্যবহার সম্পর্কে ধারণা দেওয়া, দূতাবাসের মাধ্যমে অভিবাসীদের নিয়মিত খোঁজ রাখা, তাদের অভিযোগের দ্রুত সমাধান করা এবং সামাজিক মাধ্যমে উগ্রবাদী মতবাদ শনাক্তকরণে অনলাইনে জোর নজরদারি করা।

২০১৬ সালের শুরুতে সিঙ্গাপুরে জঙ্গি সন্দেহে আট বাংলাদেশিকে আটক করা হয়েছে। যারা স্বদেশে ফিরে হামলার ছক এঁটেছিলেন বলে দাবি করেছিল দেশটির সরকার। সেই প্রসঙ্গ টেনে ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচি বিভাগের প্রধান শরিফুল ইসলাম হাসান বলেন, এটি খুবই স্পর্শকাতর একটি বিষয়। সিঙ্গাপুর উগ্রবাদের অভিযোগে অভিবাসী ফিরিয়ে দিলে আমাদের অনেক জায়গা থেকে শুনতে হয়েছে, আসলেই বাংলাদেশি প্রবাসীরা এমন কাজে জড়িত কি না। ফলে এই গবেষণাটি করা খুব দরকার ছিল। কেননা, প্রবাসীদের আয় আমাদের দেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে নিযুক্ত সিঙ্গাপুরের কনসাল শিলা পিল্লাই বলেন, বাংলাদেশে থেকে আমাদের শ্রমিক নেওয়া অব্যাহত থাকবে। তবে তাদেরকে যথাযথ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সামাজিক মাধ্যমের অবাধ ব্যবহার এবং ধর্মীয় পরিচয় তাদের যেকোনও সময় বিপথে নিয়ে যেতে পারে।

উগ্রবাদ ঠেকাতে ধর্মীয় নেতারা যাতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখেন, সেই আহ্বান জানিয়ে অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক (এসবি প্রধান) মনিরুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ ষষ্ঠ বৃহৎ জনশক্তি রফতানিকারক দেশ। তাই বাইরে প্রবাসীদের ছোট নেতিবাচক ঘটনাও দেশের সুনাম ক্ষুণ্ন করতে পারে এবং জনশক্তি রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

তিনি বলেন, ধর্মের নামে উগ্রপন্থা আমরা মোটেই সহ্য করবো না। সামাজিক মাধ্যম ও ইন্টারনেটে ধর্মপ্রচার ও উগ্রবাদী বার্তার মাঝে আমরা স্পষ্ট লাইন টেনে দিতে চাই। এক্ষেত্রে ধর্মীয় নেতাদেরকে ইতিবাচক ভূমিকা রাখার জন্য আমরা উদ্বুদ্ধ করে যাচ্ছি।