রানা প্লাজা ধসের তিনবছর পর উদ্ধার কাজে অংশ নেওয়া অপ্রশিক্ষিত উদ্ধারকারীদের অধিকাংশের জীবন এখন কাটছে এভাবেই। ভবন ধসে নিহত শ্রমিকের লাশের গন্ধ মিলিয়ে গেছে। কিন্তু বিকৃত সেসব লাশ যেনও আটকে আছে উদ্ধারকর্মীদের চোখে। এখনও তারা অর্ধগলিত মরদেহের গন্ধে উতলা হয়ে ওঠেন। তীব্র যন্ত্রণায় অনেকেই হারিয়েছেন মানসিক ভারসাম্য।
রানা প্লাজা ধসের পর জনবল ও প্রয়োজনীয় উপকরণের অভাবে ব্যহত হতে থাকে সরকারি উদ্ধার কাজ। উদ্ধারে ধীরগতি দেখে ন্যূনতম অভিজ্ঞতা না থাকার পরও উদ্ধার কাজে অংশ নেন সাধারণ মানুষ। আটকে পড়া শ্রমিকদের জীবন বাঁচানোর তাগিদে তারা ঝুঁকি নিয়ে ঢুকেছেন ধ্বংসস্তুপের ভিতরে। হাত-পা কেটে হলেও বের করে এনেছেন আহত শ্রমিকদের। পচা লাশের গন্ধ উপেক্ষা করে সন্ধান করেছেন জীবিতের।
রফিক মিয়ার বয়স পঁয়ত্রিশের কাছাকাছি। হালকা-পাতলা দেহের গড়ন। পেশায় রাজমিস্ত্রী। দৈনিক মজুরিতে কাজ করে যা আয় হতো তা দিয়েই দিন চলত রফিকের। বৃদ্ধ মা, তিন সন্তান আর স্ত্রী নিয়েই ছিলো তার সংসার। যেদিন কাজ পেতেন না সেদিন রিকশা চালাতেন। কিন্তু রানা প্লাজা বদলে দিলো রফিকের জীবন। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকালে সাভারের চাপাইন মহল্লার একটি বাড়িতে কাজ করছিলেন তিনি। লোকমুখে শুনতে পান রানা প্লাজা ভেঙে পড়ার খবর। দুপুরের পর কাজ ফেলে ছুটে যান রানা প্লাজায়। কোনও চিন্তা না করেই ঝাঁপিয়ে পড়েন আহতদের উদ্ধারে।
আরও পড়ুন: ‘জয়কে হত্যাচেষ্টার ষড়যন্ত্রে জড়িত আরও ৩ বাংলাদেশি’
রফিকের পরিবারের সদস্যরা জানান, ১৪ মে উদ্ধারকাজ পুরোপুরি শেষ হওয়ার পর বাড়িতে আসেন রফিক। কিন্তু রাতে ঘুমাতে পারেন না। হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়লেও ঘুমের ঘোরে চিৎকার করে ওঠেন, ‘এই জায়গায় লাশ আছে, ব্যাগ আনেন, কাপড় আনেন।’ দিনের বেলায় ঘুরেফিরে আবার চলে যান রানা প্লাজার সামনে। কিছুদিন এভাবে চলার পর পুরোপুরি অসুস্থ হয়ে পড়েন। সবসময় শুধু লাশ খোঁজেন। একপর্যায়ে তাকে ঢাকার শেরে বাংলানগরের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়।
ভবন ধসের তিনবছর পার হলেও এখনও সেই স্মৃতি ভুলতে পারেননি বাদল। চোখের সামনে প্রায়ই ভেসে ওঠে হাত-পা কাটা মরা, পচা, গলা লাশ। তখন থেকেই তার মানসিক রোগের শুরু। স্ত্রী-পুত্র নিয়ে বাদল এখনও বসবাস করেন সাভারের রাজফুলবাড়িয়ায়। বাদলের চোখে তীব্র সমস্যা, তাই কোনও কাজই করতে পারেন না। কর্মহীন বাদলের সংসার চলে এখন স্ত্রীর উপার্জিত অর্থে।
বাদল বলেন, রানা প্লাজা উদ্ধারের সময় আমাদের বীরের মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আজ আমাদের না খেতে পেয়ে মরতে হচ্ছে, ওষুধ কেনার টাকা জোগাড় করতেও পারছি না। অথচ তিন বছরেও আমাদের পাশে এসে কেউ দাঁড়াননি।
ফুয়াজ আলী (৪০)। ইট-বালুর ব্যবসা করতেন। স্ত্রী সন্তান নিয়ে সুখের সংসার ছিল তার। ভবন ধসের খবর পেয়ে ছুটে আসেন তিনি। আহত মানুষের আহাজারি দেখে কোনওকিছু না ভেবেই উদ্ধার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। রানা প্লাজার পাশের ভবনের একটি সুড়ঙ্গ দিয়ে প্রবেশ করেন ভেতরে। মুহূর্তের মধ্যে অর্ধমৃত এক শ্রমিককে কাঁধে তুলে নিয়ে ভবন থেকে বেরিয়ে আসেন। এরপরই মানুষ উদ্ধারের নেশায় পেয়ে বসে তাকে। শুরু থেকে শেষদিন পর্যন্ত একটানা কাজ করে গেছেন। দুই হাতে উদ্ধার করেছেন শতাধিক জীবিত ও মৃত মানুষ। এরপর ফিরে গেছেন নিজের সংসারে। কিন্তু ততদিনে উদ্ধার কাজের বীভৎস স্মৃতি তার বুকের মাঝে শিকড় গেড়েছে। দিন-রাত ঘুমাতে পাড়েন না। খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়ে একপর্যায়ে পুরোপুরি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফোসকা পড়ে সারা দেহে জন্ম নিয়েছে অসংখ্য কালো দাগ। উন্নত চিকিৎসার অভাবে সারানো যাচ্ছে না তা।
আব্দুর রহমান ওরফে তোতা মিয়া (৩০)। সাভারের একটি এনজিওতে মাঠকর্মী হিসেবে কাজ করতেন। ভবন ধসের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে আর দর্শকের কাতারে থাকতে পারেননি, ঝাঁপিয়ে পড়েন আহতদের উদ্ধারে। টানা চালিয়ে গেছেন উদ্ধার কাজ। এরপর থেকেই মানসিক সমস্যায় ভুগতে থাকেন। ঠিকমতো কাজ করতে না পারার কারণে এনজিওর চাকরিও চলে যায় একদিন। এরপর থেকে কাটাচ্ছেন বেকার জীবন!
ঠিক এভাবেই ভবন ধসের দিন থেকে শুরু করে শেষদিন পর্যন্ত উদ্ধার কাজ করেছেন মুহিদ, মাহবুবা পারভীন, মোহাম্মদ সামছুল হক বাবু, আবুল কালাম আজাদ, হাসান মাহমুদ ফোরকান, জিন্নাতুল ইসলাম, দারোগা আলী, রাসেল আলম, মো. রফিক মিয়াসহ শত শত সাধারণ মানুষ। সরকারিভাবে উদ্ধার কাজ শেষে ১৫০ জন উদ্ধার কর্মীর নামের একটি তালিকা তৈরি করা হয়। কিন্তু সে তালিকাও যেন হারিয়ে গেছে। তিনবছর পার হলেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনও খোঁজই নেওয়া হয়নি। যাদের জন্য নিশ্চিত মৃত্যুকূপ থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন প্রায় আড়াই হাজার শ্রমিক, সেই তাদের উদ্ধারে এখন কোথাও কেউ নেই।
আরও পড়ুন: ইউপি নির্বাচনের প্রার্থী ভারতে জালনোট চক্রের হোতা!
/এমও/এপিএইচ