খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এর কোনও সঠিক হিসাব নেই বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা ধারণা করেন, এই সংখ্যা ২০-এর বেশি নয়। তবে এই প্রতিবেদকের অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্য মতে, এই সংখ্যা পঞ্চাশের বেশি। আর বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের গণনায় ধরলে এ সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়ে যাবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা কিছু নাম পেয়েছি। তবে এই সংখ্যা ২০ এর বেশি নয়। এদের বেশিরভাগই নিহত হয়েছে বলে আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি, যারা এখনও ইরাক-সিরিয়ায় আছে, তারা কোনোভাবেই দেশে প্রবেশ করতে পারবে না। কারণ, তাদের নামের তালিকা আমাদের ইমিগ্রেশন পয়েন্টগুলোতে দেওয়া আছে। তাদের ব্ল্যাক লিস্টেড করা হয়েছে। ইমিগ্রেশন পুলিশও এ বিষয়ে খুব সতর্ক রয়েছে। বিশেষ করে ইরাক-সিরিয়া বা এরকম কোনও দেশ থেকে যারা বাংলাদেশে আসছে তাদের বিষয়ে আমরা খুবই সতর্ক রয়েছি।’
মনিরুল ইসলাম আরও বলেন, ‘ আইএস-এ যোগ দেওয়া বাংলাদেশি জঙ্গিদের দেশে ফেরা সহজ নয়। ফলে তারা দেশে ফিরে জঙ্গি কার্যক্রম সংগঠিত করতে পারে, এরকম কোনও আশঙ্কা নেই। একজন মাত্র তরুণ যে সিরিয়ায় যুদ্ধ করতে গিয়েছিল, আদর্শিক মতবিরোধের কারণে সে ফিরে এসেছে। দেশে আসা মাত্রই আমরা তাকে গ্রেফতার করেছি। সে বর্তমানে কারাগারে রয়েছে।’
২০১৫ সালের ১১ নভেম্বর একটি গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠানের মালিক কাজী সাইফুদ্দিন ইয়াহিয়াকে গ্রেফতার করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। আদালতে তার দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এবং পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ইয়াহিয়া বলেন, ‘২০১৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে সন্তানকে উত্তরার পিস ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে আনা-নেওয়ার সময় পরিচয় হয় সাইফুল্লাহ ওজাকির সঙ্গে। ওজাকি তখন বাংলাদেশে অবস্থান করছিলেন। ওজাকি একদিন তাকে মুহিব নামে এক তরুণের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দেন। পরবর্তীতে মুহিব স্কলারশিপ নিয়ে জাপানে যান।’
সিলেট ক্যাডেট কলেজ থেকে পাশ করা ও পরবর্তীতে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডোর সদস্য থাকা অবস্থায় স্বেচ্ছায় অবসর নেওয়া মুহিব জাপানে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধারণা, ওজাকি তাকে মোটিভেটেড করে সিরিয়ায় পাঠিয়ে দিয়েছে। কাজী সাইফুদ্দিন ইয়াহিয়ার জবানবন্দিতে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ‘২০১৪ সালের মাঝামাঝি ওজাকি যখন আবার বাংলাদেশে আসে, তখন তার মাধ্যমে গাজী সোহান নামে এক তরুণের সঙ্গে পরিচয় হয়। গাজী সোহানও আইএসের হয়ে যুদ্ধ করতে সিরিয়া গিয়েছিল। পরে সেখান থেকে দেশে ফেরার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়ে বর্তমানে কারাবন্দি রয়েছে সে। ওজাকির মাধ্যমেই নজিবুল্লাহ আনসারীও সিরিয়ায় যায় বলে ইয়াহিয়া পুলিশকে জানিয়েছেন।’
ইয়াহিয়ার ভাষ্য, ‘সিরিয়ায় শরণার্থীদের খাদ্য কিনে দেওয়ার কথা বলে ওজাকি তার কাছ থেকে ৭৫ হাজার টাকা নিয়েছিল। সে বাংলাদেশে অনেক লোকের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ এবং অনেককেই সিরিয়ায় আইএসের হয়ে যুদ্ধ করতে পাঠিয়েছিল।’
গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট একটি প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, অন্তত ৩৮ জন বাংলাদেশি নাগরিক বিভিন্ন দেশ হয়ে আইএসের পক্ষে যুদ্ধ করতে বিভিন্ন সময়ে সিরিয়ায় প্রবেশ করেছে। এর মধ্যে ১৩ জন সিঙ্গাপুর, ৯ জন তুরস্ক, সাত জন মালয়েশিয়া, চার জন আরব-আমিরাত, দু’জন জাপান ও একজন করে কাতার, ইরান এবং সৌদি আরব হয়ে সিরিয়ায় প্রবেশ করেছে।
সিরিয়ায় অবস্থানকারী বাংলাদেশির মধ্যে ধানমন্ডির বাসিন্দা জুবায়েদুর রহিম দেশত্যাগ করে ২০১৪ সালের ২০ জানুয়ারি। জুবায়েদুর রহিম ঢাকার ইউরোপিয়ান স্ট্যান্ডার্ড স্কুলে পড়াশোনা শেষে মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজিতে পড়তো। ঢাকা থেকে সে তেহরান হয়ে সিরিয়ায় প্রবেশ করে। ওই বছরেরই ৫ নভেম্বর ডা. আরাফাত হোসেন তুষার ইস্তাম্বুল হয়ে সিরিয়া যায়। ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে আইএসের হয়ে যুদ্ধ করতে ইরাকে চলে যায় নজিবুল্লাহ আনসারী। একই বছর ২৩ এপ্রিল তুরস্ক হয়ে সিরিয়া যায় তাহিমদ রহমান সাফি।
পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর জামিনে থাকা জঙ্গি জুন্নুন শিকদার দেশ ছাড়ে ২০১৫ সালের ২০ এপ্রিল। ২০১৫ সালের ৮ জুলাই সিরিয়ার উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়ে ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বাসিন্দা ইব্রাহীম হাসান খান। তার সঙ্গে তার ভাই জুনায়েদ হাসান খানও দেশ ছেড়ে সিরিয়া চলে যায় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। ২০১৫ সালের কোনও এক সময় সিরিয়ার উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়ে কলাবাগানের বাসিন্দা আশরাফ মোহাম্মদ ইসলাম ও আসাদুল্লাহ গালিব।
অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী এটিএম তাজউদ্দিন ঢাকা থেকে সর্বশেষ ২০১৩ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তুরস্কের ইস্তাম্বুলে যায়। এরপর থেকেই পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে সে। পরবর্তীতে জানা যায়, এটিএম তাজউদ্দিন সিরিয়ায় গিয়ে আইএসে যোগ দিয়েছে। তাজউদ্দিনই বর্তমানে সিরিয়ায় বসে বাংলাদেশের নিও জেএমবির কর্মকাণ্ড তদারক করছে বলে একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
এছাড়া বহুল আলোচিত খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা ডা. রোকন উদ্দিন খন্দকার, তার স্ত্রী নাঈমা আক্তার ও দুই মেয়ে রেজোয়ানা রোকন, রমিতা রোকন এবং জামাতা সাদ কায়েস সিরিয়ার উদ্দেশ্যে ২০১৫ সালের ১০ জুলাই দেশ ছেড়ে যায়। অন্যদের মতো তারাও তুরস্ক হয়ে সিরিয়ায় প্রবেশ করে। প্রায় একই সময়ে স্ত্রী রিদিতা রাহেলা ও শিশু সন্তানকে নিয়ে সৌদি হয়ে সিরিয়ায় চলে যায় ব্যারিস্টার এ কে এম তাকিউর রহমান। ঢাকার কাঁঠালবাগানের বাসিন্দা দুই ভাই মাইনউদ্দিন শরীফ ও রেজোয়ান শরীফ তাদের পরিবার নিয়ে মালয়েশিয়া হয়ে সিরিয়া চলে গেছে বলে গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের ধারণা। এছাড়া আলামিন মোল্যা, সফিউল আলম, মেহেদী হাসান, শাহরিয়ার খাঁন ওরফে শাজাহান, মাকসুদ ও এমদাদুল হক বিভিন্ন দেশে গিয়ে নিখোঁজ রয়েছে। নিখোঁজ হওয়ার আগের আচরণ বিশ্লেষণ করে গোয়েন্দারা ধারণা করছেন, তারাও সিরিয়ায় গিয়ে আইএসের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে।
এর বাইরে ২০১৫ সালের জুলাইয়ে লন্ডনে থেকে সিলেটে ফিরে মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান নামে এক ব্যক্তি তার স্ত্রী মিনারা খাতুন, মেয়ে রাজিয়া খানম, ছেলে মোহাম্মদ জায়েদ হোসেন, তৌফিক হোসেন, আবিল কাশেম ও তার স্ত্রী সাইদা খান, ছালেহ হোসাইন ও তার স্ত্রী রোশনারা বেগম এবং তাদের তিন শিশু সন্তানসহ ১২ জন একসঙ্গে তুরস্ক হয়ে সিরিয়া চলে যায়।
আমেরিকার বিমান হামলায় সিরিয়ার রাক্কায় লন্ডন প্রবাসী সাইফুল ইসলাম সুজনের মৃত্যুর পর আরও কিছু বাংলাদেশি নাগরিকের নাম প্রকাশ হয়েছে। এরাও বিভিন্ন সময়ে আইএসের হয়ে ইরাক-সিরিয়ায় গিয়ে যুদ্ধরত অবস্থায় নিহত হয়। এর মধ্যে বিডিআর বিদ্রোহে নিহত এক সেনা কর্মকর্তার ছেলেও রয়েছে, তার নাম আশিকুর রহমান জিলানী।
আইএসের মুখপত্র দাবিক-এর ১৪তম সংখ্যায় জিলানীকে আবু জান্দাল আল বাঙালি নামে পরিচয় দিয়ে তার মৃত্যুর খবর প্রকাশ করা হয়। ২০১৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তুরস্কে একটি সেমিনারে যোগ দেওয়ার কথা বলে দেশ ত্যাগ করে এমআইএসটির প্রকৌশল বিভাগের এই ছাত্র। ২০১৫ সালের ৫ জুন ইস্তাম্বুল হয়ে সিরিয়ায় প্রবেশ করে চট্টগ্রামের বাসিন্দা নিয়াজ মোর্শেদ। ওই বছরের শেষের দিকে অক্টোবরে যুদ্ধরত অবস্থায় মারা যায় আবু মরিয়াম আল বাঙালি নাম নেওয়া এক যুবক। বাংলাদেশ থেকে সাইপ্রাস গিয়েছিল তাজ রহমান নামে আরেক এক যুবক। সাইপ্রাস থেকে ফিনল্যান্ড গিয়ে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে সে। পরবর্তীতে ফিনল্যান্ড প্রবাসী স্ত্রী সামিয়া ও সন্তানকে নিয়ে চলে যায় সিরিয়ায়। গত ১১ মে তাজের একটি ছবি প্রকাশ করে আইএসের খবরাখবর বাংলায় অনুবাদকারী আত-তামক্বীন মিডিয়া। তাজকে আবু ঈসমাইল আল বাঙালি উল্লেখ করে ইরাকের নিনওয়া প্রদেশে তার মৃত্যুর খবর জানানো হয়।
ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা জানান, এই চার বাংলাদেশি ছাড়াও আবু দুজানা আল বাঙালি নামে এক যুবকের মৃত্যুর খবর তারা জানতে পেরেছিলেন। আইএসের প্রোপাগান্ডা প্রচারকারী আল ফুরাত মিডিয়ায় আবু দুজানার মৃত্যুর খবর প্রচারিত হয়। ইরাকের কোনও একটি জেলে বন্দি থাকা অবস্থায় মোটিভেটেড হয়েছিল সে। তবে তার বিস্তারিত পরিচয় জানাতে পারেননি তিনি। ২০১৬ সালের ১৬ এপ্রিল আত-তামকীন মিডিয়া আবু দুজানা আল-বাঙালির এই খবর প্রকাশ করে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ এর প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) এ এন এম মুনীরুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ওপেন সোর্স থেকে পাওয়া যেসব তথ্য আমাদের কাছে রয়েছে তাতে বাংলাদেশ থেকে আইএসে যোগ দেওয়া তরুণের সংখ্যা ৩০ এর আশেপাশে হবে। তবে এখন আইএসে যোগ দেওয়া তরুণের সংখ্যা কমে এসেছে। কারণ, আইএস ধীরে ধীরে তাদের টেরিটরি বা দখল নেওয়া জায়গাগুলো হারাচ্ছে। এজন্য ২০১৪ বা ২০১৫ সালে আইএস যোদ্ধা হিসেবে রিক্রুট করার যে প্রবণতা দেখা গিয়েছিল সেই প্রবণতা আপাতত এখন আর দেখা যাচ্ছে না।’
নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা এই বিশ্লেষক বলেন, ‘তবে একটি বিষয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, সেটা হলো ইরাক-সিরিয়া থেকে তারা অন্যান্য দেশে মুভ করার চেষ্টা করছে।’ ইন্দোনেশিয়ার একটি খবর উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ফিলিপাইনে যে হামলাগুলো হচ্ছে সেখানে বাংলাদেশি নাগরিক রয়েছে বলে তারা দাবি করছে। এরকম যদি হয় তাহলে আবারও সেই প্রবণতা কিন্তু বাড়তে পারে।’
/এপিএইচ/টিএন/আপ-এসএনএইচ/