মা নেই, তবুও মাকেই খুঁজছে মুরাদ

পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শিশু মুরাদঈদের কেনাকাটা শেষ করে মা ও দাদার সঙ্গে সিএনজিতে চড়ে বাড়ি ফিরছিল আট বছর বয়সী মুরাদ। পথেই সিএনজির সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় বিপরীত দিক থেকে আসা একটি কাভার্ড ভ্যানের। তাতে ঘটনাস্থলেই নিহত হন মুরাদের দাদা ও সিএনজিতে থাকা এক প্রতিবেশী এবং কার্ভাড ভ্যান ও সিএনজির চালক। দুর্ঘটনায় আহত হন মুরাদের মা। হাসপাতালে নেওয়ার পথেই মৃত্যু হয় তারও। মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনায় আহত মুরাদেরও ডান পা কেটে ফেলতে হয়েছে। পঙ্গু হাসপাতালের বেডে শুয়ে এখন সে কেবলই খুঁজছে তার মাকে। শিশু মুরাদের মামা মোজাম্মেল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাচ্চাটা সারাদিন কেবল মাকে ডাকছে। মায়ের কাছে যেতে চাওয়া ছাড়া আর একটি কথাও বলে না। মুরাদ জানেই না যে ওর মা আর নেই।’
গত শনিবার (২৪ জুন) লাকসাম থানার মুদাপুরগঞ্জে এই দুর্ঘটনা ঘটে। ওই দিন থেকেই পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মুরাদ। বৃহস্পতিবার (২৯ জুন) সেখানে গিয়ে কথা হয় মুরাদের মামা মোজাম্মেল হকের সঙ্গে। মুরাদের বেডের পাশের বেডে বসে মোজাম্মেল বলেন, ‘ঈদের কেনাকাটা করতে বের হয়েছিল বুবু (মুরাদের মা)। সঙ্গে মুরাদ ও তার দাদা ছিল। কিন্তু সেই কেনাকাটা শেষে আর বাড়ি ফিরতে পারলো কই?’
শিশু মুরাদের পাশে চিকিৎসক ও স্বজনমোজাম্মেল হক বলেন, ‘সেদিন রাতেই মুরাদকে নিয়ে আসা হয় পঙ্গু হাসপাতালে। পরদিন (ঈদের আগের দিন) রাতে মুরাদের অপারেশন হয়, চিকিৎসকরা তার ডান পা কেটে ফেলতে বাধ্য হন। মুরাদের সৌদি প্রবাসী বাবা দুর্ঘটনার কথা শুনে সেদিন রাতেই দেশে চলে আসেন। কিন্তু তিনিই বা আর কী করতে পারবেন। ছেলেটার পা তো আর ফিরে পাবেন না।’ বলতে বলতেই কেঁদে ফেলেন মোজাম্মেল হক।
হাসপাতালে মোজাম্মেলক হকের সঙ্গে ছিলেন তার স্ত্রী রেহানা আক্তার। তিনি বলেন, ‘ছেলেটা এখনও জানে না ওর মা-দাদা বেঁচে নেই। এত চঞ্চল ছেলেটা এখন একদম চুপ হয়ে গেছে। প্রয়োজন ছাড়া একটি কথাও বলে না। অথচ ওর কথার জন্য ঘরে টেকা যেত না।’
রেহানা আরও বলেন, ‘মুরাদের বড় ভাই শিহাব, ওর বয়স ১২ বছর। কিন্তু শিহাব আর মুরাদের সঙ্গে ফোনেও কথা বলছে না। শিহাব আমাদের বলে, মুরাদের সঙ্গে কথা বললেই তো শুধু মাকে খোঁজে। কিন্তু মাকে কোথা থেকে খুঁজে দেবো। মা তো আর নেই।’
মুরাদের বেডের পাশে অবস্থান করে দেখা যায়, মুরাদ কোনও কথাই বলছে না। কেবল বড় বড় চোখে চারিদিকে তাকিয়ে আছে। বেশিরভাগ সময়ই তার দৃষ্টিটা পাশে রাখা টেবিল ফ্যানের দিকে। এত মানুষ তার কাছে আসছে, তার ছবি তুলছে, তার কাছে গিয়ে মাথায় বুলিয়ে দিচ্ছে— কোনোকিছুতেই যেন তার কোনও আগ্রহ নেই। মুরাদের কাছে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা অবস্থানকালে কেবল একবারই তাকে পানি চাইতে দেখা গেল মামির কাছে।
স্বজনরা ডাকলেও এখন খুব একটা সাড়া দেয় না মুরাদমোজাম্মেল হক জানান, গ্রামের স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে মুরাদ। তিনি বলেন, ‘ঈদে নতুন পোশাক পরতে হয়— এটুকু বোঝার পর থেকেই ঈদ এলেই নতুন জামার বায়না ধরতো মুরাদ। এবারও রোজার শুরু থেকেই নতুন পোশাকের বায়না শুরু হয় তার। সেই ঈদের পোশাক কিনতে গিয়েই ছেলেটা তার মা-দাদাকে হারালো। আর কোনোদিন মায়ের কাছে নতুন পোশাকের আবদার করতে পারবে না।’ অশ্রুসজল চোখে তিনি বলেন, ‘সঙ্গে নিজের এক পা হারিয়ে সারাজীবনের জন্য পঙ্গুই হয়ে গেল ছেলেটা।’
মুরাদের মামি রেহানা জানালেন, দুর্ঘটনায় মুরাদের মা ও দাদার মৃত্যুর পাঁচ দিন পূর্তিতে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছেন মুরাদের বাবা।
জাতীয় অর্থপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল) চিকিৎসক ডা. শুভ প্রসাদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা চিকিৎসকরা এসব ঘটনার সঙ্গে পরিচিত। কিন্তু এই বাচ্চাটার ঘটনায় আমরাও শোকাহত। এত অল্প বয়সে মাকে হারালো, নিজের পা-ও হারালো। কিন্তু ওকে বাঁচিয়ে রাখতে পা কেটে ফেলা ছাড়া আমাদের কোনও উপায় ছিল না।’

আরও পড়ুন-

অ্যান্টিবায়োটিকের মরণ ফাঁদ!

এবার ঈদের ছুটিতে অন্যান্যবারের চেয়ে বেশি রোগী সেবা পেয়েছেন

/টিআর/