গুলশান দুই থেকে এক শ’ গজ উত্তরে সড়কে এগোতেই হাতের বায়ে র্যাংগস আর্কেড ভবন। এই ভবনের দোতলায় পাঁচশ বর্গফুট জায়গায় ছোট আকারে চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি চালু করা হয়েছে বেকারি। ১০টি টেবিলে ২০ জনের বসার ব্যবস্থা। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে এই প্রতিবেদক হলিতে যখন যান, তখন টেবিলে দুই দম্পতিকে দেখা গেল খাবার খেতে। একটু পর তারা চলে গেলে এলেন চার তরুণ। আধঘণ্টার মধ্যে দেখা গেল এক বিদেশি দম্পতিকে। সবাই যার যার মতো খাবার খেয়ে চলে যাচ্ছেন। সাংবাদিক শুনে কথা বলতে রাজি হলেন না কেউ।
নতুন এই হলি আর্টিজানের সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা শাহরিয়ার আহমেদ বলছিলেন, ‘বিকাল থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ভিড় হয় বেশি। আগের মতোই বিদেশিরা ভিড় করেন বেশি। তবে আগের তো সেই পরিবেশ নেই। সবুজ লন নেই। তবু আমরা আমাদের সাধ্য মতো সার্ভিস দেওয়ার চেষ্টা করি।’
নতুন এই হলি আর্টিজানে দেখা গেল, শাহরিয়ারের আরও দুই সহকর্মী আকাশ ও সুহিনকে। তারাও জঙ্গি হামলার দিন আগের সেই সেই রেস্তোরাঁর ভেতরে জিম্মি ছিলেন। আকাশ বলেন, ‘নতুন এই বেকারি সন্ধ্যার দিকে জমজমাট হয়ে ওঠে। বিদেশিরা আসেন। তবে একটা ঘটনা যেহেতু ঘটে গেছে। আমরা সবসময় সতর্ক থাকি।’
তিনি বলেন, ‘ঘটনার দিন তারা কয়েকজন সকাল পর্যন্ত ছোট্ট একটা বাথরুমে আটকা ছিলেন। সকালে জঙ্গিরা তাদের ডেকে নিয়ে অনেক কথা বলে। পরে বেহেশতে যাচ্ছে বলে তাদের ভেতরে রেখেই বেরিয়ে যায়। আর সেই মুহূর্তেই শুরু হয় অপারেশন।’ সেদিনের স্মৃতি মনে পড়লে এখনও শরীর শিউড়ে ওঠে জানিয়ে আকাশ বলেন, ‘আমরা সাধারণত সেই ভয়াবহ স্মৃতি মনে করতে চাই না। নতুন জীবন পেয়েছি। এটাই আমাদের বড় পাওয়া।’
বৃহস্পতিবার দুপুরে হলি আর্টিজান বেকারিতে খেতে আসা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ক্রেতা বলেন, ‘হলির পাউরুটি-কেক অনেক সুস্বাদু। একারণে মাঝেমধ্যেই এখানে আসি। একটা ঘটনা ঘটেছে তাই বলে যে আসা যাবে না, তা তো নয় ।’ ওই ক্রেতা বলেন, ‘এখানে পরিবেশটা আগের মতো প্রাণচাঞ্চল্য নেই ঠিকই, তবুও ভিড় থাকে অনেক। এক বছরের ঘটনা তো, সবার সেই স্মৃতির কথা মনে পড়ে বলে সবাই চুপচাপ খেয়ে চলে যায়।’
আগের সেই হলি আর্টিজানে সুনসান নীরবতা
গত বছরের ১ জুলাই গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কের শেষ মাথায় হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গিরা যে হামলা চালিয়েছিল, সেই বাড়িটি এখন সুনসান নীরবতা বিরাজ করছে। একই কমপ্লেক্সের বিপরীত দিকে লেকভিউ ক্লিনিক, কিন্তু ক্লিনিকে গত এক বছরে আগের তুলনায় রোগীর সংখ্যা কমে গেছে। পুলিশের ক্রাইম সিন হিসেবে তালাবদ্ধ থাকার পর গত বছরের ১৪ নভেম্বর বাড়িটি মালিক সাদাত মেহেদীর কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। সেদিন থেকেই ভবন সংস্কারের কাজ শুরু করেন তিনি। সাদাত মেহেদী জানিয়েছেন, বাড়িটি আবারও বসবাসের উপযোগী করে তুলছেন। সেখানে পরিবার নিয়ে থাকবেন তিনি।
গত বৃহস্পতিবার বিকালে ৭৯ নম্বর সড়কের শেষ মাথায় হলি আর্টিজানে গিয়ে দেখা গেল, লেকভিউ ক্লিনিক ও হলি আর্টিজান বেকারি মূল কমপ্লেক্সে দায়িত্ব পালন করছেন দু’জন নিরাপত্তাকর্মী। এদের একজন আকতার ও আরেকজন নুরুজ্জামান জানালেন, বাড়ির কাজ এখনও শেষ হয়নি। কাজ চলছে, ভেতরে প্রবেশ নিষেধ। যদিও মাস কয়েক আগে এই প্রতিবেদক ভবনের ভেতরের প্রতিটি কক্ষে ঘুরে দেখেছেন। জঙ্গি হামলার পর অপারেশন থান্ডারবোল্টে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া ভবনটি সংস্কার চলছিল তখনও।
উল্লেখ্য, গত বছরের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালায় জঙ্গিরা। এতে নিহত হয় তিন বাংলাদেশি নাগরিকসহ ২০ জন। অন্যদের মধ্যে ৯ জন ইতালির, ৭ জন জাপানের এবং একজন ভারতীয়। এছাড়া জঙ্গিদের হামলার শুরুতেই তাদের আক্রমণে দুই পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হন। রেঁস্তোরার ভেতরে রাতভর জিম্মি ছিলেন অন্তত ২৪ জন, যাদের প্রায় ১১ ঘণ্টা পর পরদিন সকালে সেনা কমান্ডো পরিচালিত অপারেশন থান্ডারবোল্টের সময় উদ্ধার করা হয়। এছাড়া রাতের বিভিন্ন সময় উদ্ধার করা হয় আরও অন্তত ৭ জনকে। অপারেশন থান্ডারবোল্টের পর রেঁস্তোরা থেকে ৫ জঙ্গিসহ ৬ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এছাড়া পালাতে গিয়ে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আরেক রেস্তোরাঁকর্মী। এ ঘটনায় গুলশান থানায় দায়ের হওয়া মামলাটি কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট তদন্ত করছে।
এনএল/এপিএইচ/