সেই রাতের দুঃসহ স্মৃতির কথা এই প্রতিবেদকের কাছে বর্ণনা করেছেন তিনি। এসআই ফারুক বলেন, ‘তখন আনুমানিক রাত পৌনে ৯টা। গুলশানের এসি রফিক স্যার ওয়্যারলেস সেটে কিছু একটা সমস্যা হচ্ছে বলে জানান। একটু পরেই গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সিরাজুল ইসলাম আমাকে ফোন করেন। বলেন, কিলো ৮১ কোথায় আছো? আমি বলি, স্যার, আমি গুলশান দুই নম্বরে ওয়েস্টিনের পেছনে আছি। ওসি বলেন, তুমি এখনই মুভ করো, লেকভিউ ক্লিনিকে যাও। দেখো সেখানে কিছু একটা সমস্যা হচ্ছে।’
আমি ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বললাম। আমিসহ ফোর্স গিয়ে তাকে টেকআপ করলাম। ওই ব্যক্তি আমাকে বললেন, স্যার আমি (আব্দুর রাজ্জাক রানা) জাপানি নাগরিকের ড্রাইভার। ভেতরে কে বা কারা দেশি-বিদেশি নাগরিক জিম্মি করছে। লোকজনকে গুলি করে মারতেছে। আমি দৌঁড়ায়া এই পর্যন্ত আসছি। আর যেতে পারছি না। আমাকে বাঁচান স্যার। আমি ওকে ধরে পাশে নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম।’
রানাকে যখন উদ্ধার করছিলেন পুলিশ কনস্টেবলরা তখন এসআই ফারুক অস্ত্র হাতে পজিশন নিচ্ছিলেন। দুজন কনস্টেবল ও দুজন আনসার সদস্য এবং একজন ড্রাইভারসহ এসআই ফারুক হলি আর্টিজানের সামনে পৌঁছান। তখন রাত কটা বাজে নির্দিষ্ট করে বলতে পারছিলেন না তিনি।
জঙ্গিরা গ্রেনেড নিক্ষেপের পর আহত দুজন কনস্টেবল একটি ভবনের গ্যারেজে এবং এসআই ফারুকসহ অপর দুজন ১০ তলা আরেকটি ভবনের গ্যারেজে আশ্রয় নেন। চালক গাড়িটি দ্রুত পেছনের দিকে নিয়ে যায়। এসআই ফারুক তার সঙ্গীদের ফায়ার করার নির্দেশ দেন। আহত এক কনস্টেবলের শটগান নিয়ে নিজেও গুলি করেন।
ফারুক বলেন, ‘বিল্ডিংয়ের আড়াল থেকে শটগান দিয়ে ফায়ার করা শুরু করলাম। ওপাশ থেকে দুজন ফায়ার করতেছে। এপাশ থেকে আমি ফায়ার করতেছি। জঙ্গিরা তখন গেটের প্রায় বাইরে চলে আসছে। একপাশে তিনজন আরেক পাশে দুজন। আমি ফায়ার করতে থাকলে ওরা আবার গেটের ভেতরে ঢুকে দেয়ালের আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালো। সেখান থেকে তারা গুলি করতেছে। আমিও চাইছিলাম যে কোনোভাবে তাদের আটকিয়ে রাখতে। যাতে বেরিয়ে যেতে না পারে।’
জঙ্গিদের পালানো ঠেকাতে গিয়ে প্রথম দফা গ্রেনেড হামলায় আহত হন ফারুক। তার পায়ে স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু গুরুত্ব দেননি। জঙ্গিরা হলি আর্টিজানের ভেতরে ঢুকে গেলে তিনি চালককে আহত দুই কনস্টেবলকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দেন। তিনি বলেন, ‘আমি ইনজুরড, কিন্তু সেটা খেয়াল করি নাই। আমার এক কলিগ জয়নাল বললেন, ফারুক ভাই আপনার তো পায়ে রক্ত। পরে দেখি আমার পায়ে স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয়েছে। বুলেটপ্রুফ জ্যাকেটে একটা স্প্লিন্টার আটকে আছে। আমি বললাম, সমস্যা নাই। ওসি (সিরাজুল ইসলাম) স্যার বললেন যে, তুমি থাকো। তোমার সাহস আছে।’
রাত সাড়ে ১০টার আগেই ঘটনাস্থলে পৌঁছান ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। হলি আর্টিজানের মূল ফটকের বাম দিকের ভবনের নিচে অবস্থান নিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা। এরই মধ্যে সোয়াট টিমের সদস্য ও র্যামব যোগ দিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ডেকে কমিশনার বলেন, ‘আমাদের তো রিকভারের জন্য কিছু করতে হবে, যাতে বিদেশিদের না মারতে পারে। লাইফ সেভ করাটাই আমাদের উদ্দেশ্য। তখন হলি আর্টিজানের ভেতরে কিছুটা নীরব। গুলির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।
এসআই ফারুক বলেন, ‘আমরা যখন মূল দরজায় ঢুকে হলি আর্টিজানের রাস্তার গেটটা খুলতে গেছি তখন একটা বিকট শব্দ হয়। একটা গ্রেনেড এসে বিস্ফোরিত হয়। ওরা হলি আর্টিজানের হলরুমের গেটের কাছ থেকে গ্রেনেডটা ছুঁড়েছে। আমাদের মাঝখানে এসে গ্রেনেড পড়লো। আমরা ৩০-৩৫ জন ইনজুরড হলাম। আমার পেছনে সালাউদ্দিন স্যার পড়েছিলেন। এসআই সুজন কুমার কুণ্ডু, এসআই নুরুজ্জামান, সোয়াট সদস্যসহ আমরা ৪-৫ জন সেখানে পড়েছিলাম। আমার হাঁটুর বাটিটা ভেঙে চার খণ্ড হয়েছিল। শরীরে ২০-২৫টা স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয়েছে। আমি পা তুলতে পারছিলাম না। র্যাশবের একজন মেজর, উনি আমাকে কাঁধে তুলে নিলেন। উনি আর এসআই জয়নাল আমাকে ধরে বাইরে নিয়ে আসেন। পরে গাড়িতে তুলে ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে যায়। আমি গাড়িতে সেন্স হারিয়ে ফেলি। ইউনাইটেডে নেওয়ার আগে আমার অনেক রক্ত ঝরেছে। আর কিছুক্ষণ ওখানে থাকলে হয়তো আমিও মারা যেতাম।’
প্রসঙ্গত, ১৯৯৬ সালে কনস্টেবল হিসেবে যোগ দেন ফারুক। ২০১৫ সালে এসআই হিসেবে পদোন্নতি পান। তার গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের সদর থানার পারচন্দ্র দীঘলিয়ায়। তার বাবা সিদ্দিকুর রহমান শেখ একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।
আরও পড়ুন-
অবিন্তা নেই, বেঁচে আছে তার স্বপ্ন
তুমি কোথায়, গুলশানে জঙ্গি হামলা!
দুর্বিসহ স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন তারা
এসি রবিউলের সন্তানদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত
শরীরে স্প্লিন্টার নিয়ে বেঁচে আছেন এডিসি আব্দুল আহাদ
গুলশান হামলায় নিহতদের স্মরণে অনুষ্ঠান নিয়ে দূতাবাসগুলোয় সতর্কতা
হলি আর্টিজানে হামলার পরিকল্পনা রাজশাহীতে, কৌশল নির্ধারণ গাইবান্ধায়, চূড়ান্ত অপারেশন প্ল্যান ঢাকায়
/এনএল/এসটি/