রোহিঙ্গা নিবন্ধনে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনকে সম্পৃক্ত করতে হবে: আসক

 

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সংবাদ সম্মেলন (ছবি: কক্সবাজার প্রতিনিধি) বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনকে সম্পৃক্ত করার আহ্বান জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। সংস্থাটির মতে, রোহিঙ্গা নিবন্ধন কার্যক্রমে আন্তর্জাতিক কোনও সংঠনকে যুক্ত না করলে পরবর্তী সময়ে রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। রোহিঙ্গা নিবন্ধন কার্যক্রম পরিদর্শন শেষে সোমবার (১৮ সেপ্টেম্বর) সকালে কক্সবাজার প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে এই আহ্বান জানানো হয়।

সংবাদ সম্মেলনে আসকের সমন্বয়ক আবু আহমেদ ফয়জুল কবির লিখিত বক্তব্যে বলেন, ‘পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, এখনপর্যন্ত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পরিকল্পিতভাবে নির্দিষ্ট স্থানে রাখা হচ্ছে না।  তাদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণেও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। শরণার্থীদের অনেকেই উখিয়া-টেকনাফ ছেড়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে।’ তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের আলাদা করে যেহেতু চিহ্নিত করা সম্ভব হচ্ছে না, সেজন্য দারিত্বরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষেও তাদের শনাক্ত করা কষ্টকর হয়ে উঠছে। এই জটিলতা নিরসনে রোহিঙ্গাদের বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশনের জন্য যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা সময়োপযোগী ও জরুরি।’

আবু আহমেদ ফয়জুল কবির বলেন, ‘বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশনে দায়িত্বরত বিজিবি কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মাত্র তিন হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীর নিবন্ধন সম্পন্ন হয়েছে। আসক মনে করে, বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনকে সম্পৃক্ত না করলে পরবর্তী সময়ে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া শরণার্থীদের  বিশাল একটি অংশ শিশু, যাদের নিবন্ধন করা হচ্ছে না। এসব শরণার্থী শিশুর অনেকেরই বাবা-মা মিয়ানমারে হামলায় নিহত হওয়ায় তারা বিচ্ছিন্নভাবে বা আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে বাংলাদেশে এসেছে। এ কারণে এসব শিশুকে নিবন্ধন করা না হলে তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। অন্যদিকে, নো-ম্যান্স ল্যান্ডে অবস্থানরত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর একাংশও অত্যন্ত উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। নো-ম্যান্স ল্যান্ডে অবস্থানরত শরণার্থীরা পর্যাপ্ত খাদ্য ও আনুষঙ্গিক সুবিধা যথাযথভাবে পাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোরও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করে আসক।’

লিখিত বক্তব্যে আবু আহমেদ ফয়জুল কবির আরও বলেন, ‘মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে চলছে সে দেশের সামরিক বাহিনী ও রাষ্ট্রযন্ত্রের বর্বর হামলা। রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর ওপর নির্বিচারে গুলি চালানো হচ্ছে, তাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া ধর্ষণ করা হচ্ছে রোহিঙ্গা নারীদের। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীরা প্রাণ বাঁচাতে নিজেদের বাড়িঘরসহ সর্বস্ব পরিত্যাগ করে যে যেভাবে পারে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। রাইফেলের গুলিতে, সীমান্তে পেতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে, সমুদ্র ও নদী পার হতে গিয়ে নৌকা ডুবিতে প্রাণ হারাচ্ছে নারী, শিশুসহ অসহায় মানুষ। সীমান্তের এ পারে এসে তারা আশ্রয় খুঁজে বেড়াচ্ছে। ইতোমধ্যে শরণার্থীর সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ ছাড়িয়ে গেছে।’

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমার সরকারের সাম্প্রতিক হামলা ‘জাতিগত নিধন’, ও ‘গণহত্যা’র চূড়ান্ত পর্যায়ে পড়ে। এর মাধ্যমে মিয়ানমার সরকার মানবাধিকার রক্ষার সব ধরণের আন্তর্জাতিক নীতির চূড়ান্ত লঙ্ঘন করছে। একইসঙ্গে বাংলাদেশের সঙ্গে রোহিঙ্গা বিষয়ক দ্বিপক্ষীয় চুক্তির শর্তও অমান্য করছে। এই বর্বর জাতিগত নিধনের প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশে। সৃষ্টি হয়েছে এক নিদারুণ মানবিক বিপর্যয়ের। এমতাবস্থায় বাংলাদেশ তার মানবিক দায়িত্ব পালন থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারে না। বাংলাদেশ সরকার অসহায়, নির্যাতিত রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিতে যে মানবিক পদক্ষেপ নিয়েছে, তা প্রশংসনীয়। একইসঙ্গে প্রথম দিন থেকেই নির্যাতিত এই জনগোষ্ঠীর প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে কক্সবাজার জেলার স্থানীয় মানুষ। বিভিন্ন গণমাধ্যম, স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো মানবিক মূল্যবোধকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়িয়েছে।

মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর এই বর্বরোচিত হামলার শুরু থেকেই এর নানা দিক আসক পর্যবেক্ষণ করে আসছে বলে জানান আবু আহমেদ ফয়জুল কবির। তিনি বলেন, ‘আসক উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছে, রোহিঙ্গাদের বিশাল একটি অংশ এখনও শরণার্থী শিবিরে জায়গা না পেয়ে বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থান করছে। এসব শরণার্থীর অধিকাংশই নারী, শিশু ও বৃদ্ধ।  যাদের রাস্তায় খোলা আকাশের নিচে মানবেতর দিনযাপন করতে হচ্ছে। ইতোমধ্যে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাদের শিশুদের একটি অংশ পোলিও, হাম, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে।  সামগ্রিকভাবে শরণার্থীদের জন্য চিকিৎসা সেবার পরিসর যথাযথ নয়।’

আবু আহমেদ ফয়জুল কবির আরও বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে সরকারের মানবিক অবস্থান ও সদিচ্ছা থাকার পরও শরণার্থী ব্যবস্থাপনায় সমন্বয়হীনতা বিদ্যমান। আমাদের প্রত্যাশা, সরকার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ের দ্রুত শরণার্থী ব্যবস্থাপনায় সব ধরনের সমন্বয়হীনতা কাটিয়ে উঠবে।’

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, মিয়ানমার সরকারের এই পরিকল্পিত ‘জাতিগত নিধন’ ও ‘গণহত্যা’ বিষয়টির বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করতে হবে। এছাড়া গণহত্যার বিষয়ে জাতিসংঘ তদন্ত  কমিশন গঠন করে মিয়ানমার সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে ‘কফি আনান কমিশন’-এর সুপারিশ বাস্তবায়নে জাতিসংঘের মাধ্যমে মিয়ানমারকে চাপ দিতে হবে। মিয়ানমারের সামরিক, বেসামরিক, কারাগার ও ডিটেনশন সেন্টারগুলোয় আটক ও নিখোঁজ রোহিঙ্গাদের বিষয়ে জাতিসংঘের মাধ্যমে অনুসন্ধানের করে তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। মানবাধিকার ও গণমাধ্যমকর্মীদের মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে স্বাধীনভাবে তথ্যানুসন্ধান করার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন আসক-এর নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজা, সিনিয়র উপ-পরিচালক নীনা গোস্বামী ও রওশন জাহান পারভীন।

আরও পড়ুন: রোহিঙ্গা যুবকরা কোথায়?