সপ্তম শ্রেণির বইয়ে ফেসবুক, টুইটার

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বইসময়ের সঙ্গে সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তির প্রতিদিনই উন্নয়ন ঘটছে। তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণেই দূর-দূরান্তের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ সহজ থেকে সহজতর হচ্ছে। বর্তমানে অনলাইন জগতে সামাজিক যোগাযোগের অন্যতম জনপ্রিয় দুটি মাধ্যম ফেসবুক, টুইটার। এগুলো ছাড়াও রয়েছে আরও কিছু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। বিশ্বব্যাপী মানুষের নিত্যদিনের অনলাইনে সামাজিক যোগাযোগের বহুল ব্যবহৃত মাধ্যম হয়ে ‍উঠেছে এগুলো। তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রযাত্রার এ ছোঁয়া লেগেছে দেশের মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যবইয়েও। সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি’ বইয়ে উঠে এসেছে ফেসবুক, টুইটারসহ জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর কথা। এগুলোর মাধ্যমে মানুষ কিভাবে পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে তার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলোর মাধ্যমে পণ্যের বিজ্ঞাপন, কাজের খবর, এমনকি সামাজিক আন্দোলন সংগঠিত করার কাজও হচ্ছে।’

আগামী ১ জানুয়ারি পাঠ্যপুস্তক উৎসবের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেবে সরকার। এ বছরের মতো ২০১৮ সালের ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি’ বইয়েও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর পরিচিতি তুলে ধরা হয়েছে।

ফেসবুক, টুইটারসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের তথ্যফেসবুক কর্তৃপক্ষের নিয়ম অনুযায়ী,১৩ বছরের কম বয়সীরা ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে না। তবে পৃথিবীর কিছু দেশে ১৩ বছর  আবার কোনও দেশে ১৪ বছরের সীমারেখা রয়েছে। এ হিসেবে সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবইয়ে ফেসবুক ব্যবহারে উৎসাহ দেওয়া যেতে পারে বলেই মনে করেন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ মোস্তফা জব্বার। তার মতে, ফেসুবকসহ প্রযুক্তি বিষয়ে অনেক কিছুই তাদের জানা উচিত। বরং আরও ছোট শিশুদের ফেসবুক ব্যবহার করা উচিত বলে মনে করেন তিনি। মোস্তফা জব্বার এ বইটির অন্যতম লেখক।

শিশুদের প্রযুক্তি থেকে দূরে না রাখার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কেবল সপ্তম শ্রেণি নয়, বরং কোনও শিশু যখন কথা বলা শুরু করে, আঙুল দিয়ে মোবাইল ফোনের স্ক্রিন স্পর্শ করতে পারে, সেদিন থেকেই শিশুদের মোবাইল ফোন ব্যবহার করা উচিত। তাদের প্রযুক্তির ব্যবহার শেখা উচিত।’

তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি কোনও যুক্তি পাই না, শিশুদের মোবাইল ফোন কেন ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না! ফেসবুক ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না কেন! যারা এর বিরোধিতা করেন, তারা নিজেরা ব্যবহার করেননি তো, তাই শিশুদেরও ব্যবহার করতে দিতে চান না। ওরা প্রযুক্তি প্রতিবন্ধী, তাই নতুন প্রজন্মকেও প্রযুক্তি প্রতিবন্ধী বানাতে চান বলেই তারা এমনটি বলেন। তবে শিশুরা যদি ফেসবুক অথবা প্রযুক্তির অপব্যবহার করে, সেটি দেখার দায়িত্ব অভিভাবক ও তার আশপাশের সবার।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রথম শ্রেণির বাচ্চারা যে প্রোগ্রামিং তৈরি করছে, তা দেখে তো আমরা অবাক হচ্ছি। তাকে কেন প্রযুক্তির সঙ্গে মিশতে দেবো না? তাছাড়া, পজিটিভ-নেগেটিভ দুটি বিষয়ই থাকে মানছি, কিন্তু নেগেটিভের আশঙ্কায় পজিটিভ জিনিসটাকে তার কাছ থেকে দূরে কেন রাখতে হবে? আমি মনে করি, সপ্তম শ্রেণির বাচ্চারা অনেক বড়। তাদের ফেসবুকসহ প্রযুক্তির অনেক বিষয় শেখা উচিত।’

সপ্তম শ্রেণির ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি’ বইটির ‘প্রাত্যহিক জীবনে তথ্য ও প্রযুক্তি’ অধ্যায়ের ১৪ ও ১৫ নম্বর পৃষ্ঠায় শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলা হয়েছে, ‘তোমার প্রাইমারি স্কুলের যে বন্ধুটির সাথে তোমার দীর্ঘদিন দেখা হয় না, যে কিনা এখন হয়তো অস্ট্রেলিয়াতে থাকে, তাকেও তুমি এখানে খুঁজে পেতে পারো। তুমি যখনই তোমার প্রোফাইলে কোনও তথ্য প্রকাশ করবে, সঙ্গে সঙ্গে তা তোমার বন্ধুদের পেজের একটি বিশেষ জায়গায় ভেসে উঠবে। তুমি তোমার মনে ভাব প্রকাশ করতে পারবে যা ফেসবুকে ‘স্ট্যাটাস’ নামে পরিচিত।’ এতে আরও বলা হয়েছে, ‘তোমার বন্ধুদের সবাইকে ফেসবুক মনে করিয়ে দেবে তোমার জন্মদিন কবে।!সবাই তখন তোমাকে শুভেচ্ছা জানাতে পারবে। কেবল তোমার ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ নয়। এখন এই সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলোর মাধ্যমে পণ্যের বিজ্ঞাপন, কাজের খবর, এমন কি সামাজিক আন্দোলন সংগঠিত করার কাজও হচ্ছে।’

ফেসবুকসহ অন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন টুইটার, গুগলপ্লাস, লিঙ্কডইন, জোপ্পা’র ঠিকানাগুলোও বইটিতে উল্লেখ করা হয়েছে। অবশ্য বইটিতে প্রযুক্তি ব্যবহারের কিছু ক্ষতিকর দিক উল্লেখ করে সতর্ক থাকতেও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

শিশুদের মোবাইল ফোন, ফেসবুক ব্যবহার নিয়ে অভিভাবকদের পাশাপাশি অনেক বিশেষজ্ঞের মধ্যেও উদ্বেগ রয়েছে। সম্প্রতি প্রায় দেড় লাখ শিশু-কিশোরের ওপর সমীক্ষা চালিয়ে কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক জানিয়েছেন, মোবাইল ফোন শিশুদের মানসিক বৃদ্ধির পরিবর্তে মনসংযোগে ব্যাঘাত ঘটায়। এ কারণে শিশুদের মোবাইল ফোন ব্যবহারে সতর্ক করেছেন তারা।

গত ১২ অক্টোবর এক আদেশে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মোবাইল ফোন নিয়ে শ্রেণিকক্ষে প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি)।ওই আদেশে বলা হয়, ‘মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কিছু শিক্ষক-শিক্ষার্থী মোবাইল ফোন নিয়ে শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করছে। এতে শ্রেণিকক্ষে শিখন-শেখানো কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে এবং শিক্ষার্থীরা শ্রেণির কার্যক্রমে মনোযোগী হতে পারছে না। এটা অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেত।’ এতে আরও বলা হয়, শ্রেণিকক্ষে কার্যকরী পাঠদান ও শিখন-শেখানো কার্যক্রম ‘শিক্ষার্থীবান্ধব ও গতিশীল করতে’ মোবাইল ফোনের ওপর এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।

মোবাইল ফোনে আসক্তির ফলে শিশুদের যে ক্ষতি হতে পারে, তার ব্যাখ্যা দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ কামরুজ্জামান মজুমদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শিশুরা মোবাইল ফোনে আসক্ত হয়ে পড়লে তারা এর মধ্যে আটকে যায়, অর্থাৎ ‘ক্যাপটি’তে প্রবেশ করে। তাদের মনোযোগ কেবল মোবাইল ফোনকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে। ফলে মোবাইল ফোনের বাইরেও যে তাদের অনেক কিছু শেখার আছে– সেটা বাধাগ্রস্ত হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা বলি, বাচ্চারা শেখে ইন্টার‍্যাকশনের মাধ্যমে। কিন্তু মোবাইল ফোনের সঙ্গে ইন্টার‍্যাকশনের সিস্টেমটা হলো একতরফা। ফলে মোবাইল ফোনটি যখন তার কাছে দেওয়া হয়, তখন সে একটি জায়গাতেই আটকে পড়ে। সে হয় গেমস খেলে অথবা অন্য কিছু করে। এতে সে আনন্দ পেয়ে যায়। এভাবে এ আসক্তি থেকে সে আর বের হতে পারে না। এ কারণেই তার ক্ষতিটা হয়। তার মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। চোখের সমস্যাও দেখা দিতে পারে।’

‘প্রাত্যহিক জীবনে তথ্য ও প্রযুক্তি’ শীর্ষক ওই অধ্যায়ের শেষ অংশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভূমিকা তুলে ধরতে গিয়ে তিউনিসিয়া, মিসর ও লিবিয়ার সরকারবিরোধী আন্দোলনকে ‘সামাজিক বিপ্লব’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

যদিও এই আন্দোলনগুলো সরাসরি সামাজিক বিপ্লব নয় বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. আশা ইসলাম নাঈম। তিনি বলেন, ‘যেকোনও আন্দোলনের পেছনেই সমাজের সাধারণ মানুষের ভূমিকা থাকে। সেই আন্দোলনটি যদি হয় রাজনৈতিক কোনও উদ্দেশ্যে, তাহলে সামাজিক আন্দোলনটিই রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ নেয়। তিউনিসিয়া, মিসর, লিবিয়ার আন্দোলনগুলোর পেছনে সামাজিক বিপ্লব ছিল, তেমনি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। ফলে এটাকে সোশিও-পলিটিক্যাল (সামাজিক-রাজনৈতিক) বিপ্লব বলা হয়। পাঠ্যবইটিতে যে তথ্য দেওয়া আছে তা রীতিমতো ভুল।’