অপরিকল্পিত নগরায়নে দায়ী সমঝোতার রাজনীতি

পরিকল্পনা সংলাপ

সমঝোতার রাজনীতি, প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও দুর্নীতিবাজ আমলাদের কারণে দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনা ঠিক থাকছে না। স্বার্থের কারণে সঠিক পরিকল্পনাতে চলছে সার্জারি। ফলে দেশজুড়ে যে নির্মাণযজ্ঞ চলছে, তা পরিণত হচ্ছে ইট-কংক্রিটের জঞ্জালে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) ও নগর উন্নয়নে সাংবাদিক ফোরাম, বাংলাদেশ আয়োজিত ‘নগর উন্নয়ন পরিকল্পনায় সাংবাদিকতার ভূমিকা’ শীর্ষক সংলাপে এই অভিমত উঠে এসেছে। শনিবার (১০ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর বাংলামোটর সংলগ্ন প্ল্যানার্স টাওয়ারে বিআইপি সম্মেলন কক্ষে এই সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়।

সংলাপ অনুষ্ঠানে সভাপত্বি করেন– বিআইপির সহ-সভাপতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন– বিআইপির সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান। অনুষ্ঠানে মূল ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন– ডেইলি স্টারের সিনিয়র রিপোর্টার তৌফিক আলী।

ধারণাপত্রে ঢাকা শহরের বাসযোগ্যতা হারানোর পেছনের কারণ হিসেবে সরকারের সঠিক পরিকল্পনার অভাব, সঠিক পরিকল্পনাগুলোকে কেটেছিঁড়ে তছনছ করা, বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভাবশালীদের সঙ্গে সরকারের জনস্বার্থবিরোধী আপসরফাকে দায়ী করা হয়।

পরিকল্পনা সংলাপ

মূল ধারণাপত্রে তৌফিক আলী বলেন, ‘৯৫ পরবর্তী সময় উন্নয়নের নামে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হয়েছে। সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা সমঝোতার রাজনীতি করে ভূমির ব্যবহার পরিবর্তন করে হাউজিং কোম্পানিগুলোকে লাভবান করেছে।’

সংলাপে অংশ নিয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ ও সাংবাদিকরা জানান, দেশের উন্নয়নে সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও দ্রুত বাস্তবায়নে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে। তারা বলেন, বর্তমানে দেশজুড়ে যে নির্মাণযজ্ঞ চলছে, তা অনেকক্ষেত্রেই অপরিকল্পিত। পরিকল্পনার অভাবেই আজ ঢাকা বসবাসের অযোগ্য নগরীতে পরিণত হয়েছে। এখনই এ ব্যাপারে সোচ্চার না হলে রাজধানীর মতো পুরো দেশও ইট-কংক্রিটের জঞ্জালে পরিণত হবে, বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। এক্ষেত্রে সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়নে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে। কারণ অপরিকল্পিত উন্নয়নকাজ থেমে নেই।

নগর বিষয়ক প্রতিবেদকরা মতবিনিময় অনুষ্ঠানে রাজধানীতে রেল যোগাযোগ বৃদ্ধি, শহরের বিকেন্দ্রীকরণ, যোগাযোগ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন, খাল-নদী-জলাশয় রক্ষাসহ বিভিন্ন পরমার্শ দেন। তারা বলেন, তুরাগ-বালু-বুড়িগঙ্গা-ধলেশ্বরী নদীর পানির মান ঠিক না করে অর্ধশত কিলোমিটার দূর থেকে রাজধানীতে পানি আনার জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে। অথচ ওই টাকা দিয়ে এসব নদীকে ভাল করে নগরীতে পানি সরবরাহ করা সম্ভব ছিল। এতে রাজধানীর চারপাশের নদীগুলোও বাঁচত। অথচ নদীগুলোকে ধ্বংস করে মেঘনা-পদ্মা থেকে পানি আনার প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে। রাজধানীর জলাশয়-খালগুলোকে একের পর এক ধ্বংস করা হচ্ছে। অনৈতিকভাবে একের পর এক প্রভাবশালীদের আবাসন কোম্পানির অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে।

পরিকল্পনা সংলাপ

অনুষ্ঠানে বিআইপির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক গোলাম রহমান বলেন, ‘একসময় বুড়িগঙ্গার পানি হাতে নিয়ে পান করা যেত। এখন সেই বুড়িগঙ্গার পাশ দিয়ে নাকে রুমাল চেপে হাঁটতে হয়।’ তিনি ঢাকা শহরের ওপর চাপ কমানোর জন্য স্থানীয় সরকার পর্যায়ে নগরায়নের পরামর্শ দেন।

সভাপতির বক্তব্যে আখতার মাহমুদ বলেন, ‘সরকারি যে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা হয়, সেগুলো কতটা সফলতা পেল সে বিষয়ে কোনও অডিট হয় না। এগুলো অডিটের আওতায় এনে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।’

বিআইপি’র সহ-সভাপতি মো. ফজলে রেজা সুমন বলেন, ‘ঢাকাকে বাঁচাতে হলে আর্জেন্ট পদক্ষেপ প্রয়োজন। এক্ষেত্রে আইনকে কাজে লাগাতে হবে। যে পরিকল্পনা নেওয়া হয় তা ঠিক না রেখে প্রকল্প ভিন্ন আঙ্গিকে বাস্তবায়ন করা হয়। তিন দশমিক তিন শতাংশ হারে নগারায়ন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগামী তিন দশকে ঢাকায় বসবাসকারী তিন গুণ বেড়ে যাবে। ফায়দা লুটবে ভূমি ব্যবসায়ীরা। প্রভাবশালী ব্যবসায়ী, দুর্নীতিবাজ আমলা ও সমঝোতার রাজনীতি অপরিকল্পিত নগরায়নের জন্য দায়ী।’

অনুষ্ঠানে বিআইপি ও নগর উন্নয়ন সাংবাদিক ফোরামের পক্ষ থেকে নগর বিষয়ক প্রতিবেদনের ওপর কয়েকটি ক্যাটাগরিতে সেরা রিপোর্টের পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। প্রতি বছরের ৮ নভেম্বর নগর পরিকল্পনা দিবসে এ পুরস্কার দেওয়া হবে বলে জানানো হয়।

মতবিনিময় সভায় বক্তব্য দেন নগর উন্নয়ন সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি অমিতোষ পাল, সাধারণ সম্পাদক মতিন আব্দুল্লাহ প্রমুখ।