বুধবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর বেসিস মিলনায়তনে ‘প্রশ্নফাঁস বিপর্যয়, কারণ অনুসন্ধান ও প্রযুক্তিগত সমাধান’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে আইটি বিশেষজ্ঞরা এসব কথা বলেন। বৈঠকটি যৌথভাবে বাংলাদেশ আইসিটি জার্নালিস্ট ফোরাম, জাগো ফাউন্ডেশন, পরিবর্তন চাই ও ঢাকা ইউনিভার্সিটি আইটি সোসাইটি আয়োজন করে। গোলটেবিল বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন বিডিজবস-এর প্রতিষ্ঠাতা ও বেসিসের সাবেক সভাপতি ফাহিম মাশরুর।
বৈঠকের শুরুতেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের সম্ভাব্য ধাপ ও ফাঁসরোধের প্রযুক্তিগত কিছু যুক্তি তুলে ধরে বক্তব্য রাখেন বন্ডস্টেইন লিমিটেডের প্রধান শাহরুখ ইসলাম।
তিনি বলেন, ‘প্রশ্নপত্র প্রণয়নের পর ট্রাংকে বা প্যাকেটে সিলগালার পরিবর্তে প্রযৌক্তিক কোনও বাক্সে ঢুকাতে হবে এবং ওই বাক্সে যে তালা থাকবে, তা পরীক্ষা শুরুর আধা ঘণ্টা আগে ছাড়া খুলবে না। কেউ খোলার চেষ্টা করলেও বোর্ড কর্তৃপক্ষ বা মন্ত্রণালয়ের কাছে অটোমেটিক এলার্ম বা মেসেজ চলে আসবে। কোন জায়গা থেকে বাক্স খোলার চেষ্টা করা হয়েছে সেই স্থান, সময়সহ অন্যান্য সব তথ্য পৌঁছে যাবে। যদিও এটা একটু ব্যয়বহুল।’
অন্য আরেকটি সমাধান তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘প্রতিটি কেন্দ্রে প্রিন্টার রেখে বোর্ড অথবা মন্ত্রণালয় থেকে কমান্ড দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষার ঠিক আধা ঘণ্টা আগে প্রশ্নপত্র প্রিন্ট হবে। এক্ষেত্রে প্রশ্নপত্র পরিবহনের ঝামেলা নেই। অটোমেশন পদ্ধতিতে কম্পিউটারের কমান্ড অনুযায়ী প্রশ্নপত্র প্রণয়ন হবে পরীক্ষা শুরুর আগ মুহূর্তে, সুতরাং ফাঁস হওয়ারও সম্ভাবনা নেই। কিন্তু এটাও বেশ ব্যয়বহুল হবে। তবে বর্তমানে প্রশ্নপত্র পরিবহনে যত ব্যয় হয়, তার চেয়ে খুব বেশি ব্যয় হবে না।’
বিজনেস অটোমেশনের এমডি জাহিদুল হাসান মিতুল বলেন, ‘আমরা প্রশ্নফাঁসের পাশাপাশি বেশ কিছু অনিয়ম খেয়াল করেছি। কারও কারও রেজাল্ট পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে, কারও কারও সার্টিফিকেট পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে, মার্কশিট পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। এটা কীভাবে সম্ভব? এর মানে শুধু প্রশ্নফাঁসই নয়, অন্যান্য বেশ কিছু জায়গাতেই অনিয়ম দুর্নীতি চলছে। সেগুলোরও লাগাম ধরতে হবে।’
বেসিসের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও Champs21-এর প্রতিষ্ঠাতা রাসেল টি আহমেদ বলেন, ‘আমি মনে করি, প্রশ্নপত্র যখন প্রণয়ন হবে, তখনই ডিজিটাল কোনও ভোল্টে বা সার্ভারে ঢুকবে। আর প্রশ্নপত্র প্রণয়নে কোনও হাতের ছোঁয়া থাকবে না। প্রশ্নপত্র প্রণয়ন হবে সফটওয়্যারের মাধ্যমে। সিস্টেম কমান্ড দিলেই প্রশ্নপত্র প্রণয়ন হয়ে যাবে। ’
ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র নিজের সন্তানকে পেতে অভিভাবক নিজে সহযোগিতা করেন—এর সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘আমাদের অভিভাবকদের ওপরেই আঙ্গুল তোলা উচিত। অভিভাবকরা নিজেরাও এই প্রশ্নপত্র ফাঁসের ওপর প্রভাব তৈরি করছেন।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইটি সোসাইটি’র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আল ইমরান বলেন, ‘বর্তমানে যে প্রশ্নফাঁস হচ্ছে তাতে শিক্ষকসহ কর্তৃপক্ষের যেমন দায়িত্বে অবহেলা রয়েছে, তেমনি প্রযুক্তির অপব্যবহারও রয়েছে। ফলে প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের শিক্ষক, অভিভাবকদেরও সচেতন হতে হবে। যেসব শিক্ষার্থী টাকার বিনিময়ে প্রশ্নপত্র পেয়ে পরীক্ষা দিচ্ছে, তাদেরকে শাস্তি দেওয়াসহ তাদের অভিভাবকদেরও শাস্তির আওতায় আনা উচিত। কারণ, প্রশ্নপত্র পেতে মোটা অংকের টাকার জোগান দিচ্ছে অভিভাবক নিজেই।’
শিক্ষা ও শিশু রক্ষা সংগঠনের কর্মী রাখাল রাহা বলেন, ‘বিভিন্ন পরীক্ষায় শতভাগ পাশ দেখাতে গিয়ে সরকারই নানা পথ অবলম্বনের মাধ্যমে ফাঁক-ফোকর তৈরি করেছে। পরীক্ষার খাতায় নম্বর বেশি দেওয়ার নির্দেশনাসহ পাশ করিয়ে দেওয়ার জন্য পরীক্ষকদের নানা সময় নির্দেশনা দিয়েছে এই সরকারই। এভাবেই শিক্ষাকে একের পর এক ধংসের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। আর এখন চলছে প্রশ্নফাঁসের মহোৎসব। এটাকে ঠেকাতে হলে সংশ্লিষ্ট সবার মূল্যবোধের জাগরণ ঘটাতে হবে।’
ন্যাসেনিয়া’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক শায়ের আহমেদ বলেন, ‘আমরা হয়তো প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে প্রশ্নফাঁস রোধ করতে পারবো। কিন্তু চলমান পরীক্ষায় আরও কিছু পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতে বাকি রয়েছে। এর মানে কি সবগুলো পরীক্ষাতেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হবে। এক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক একটি ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব, যাতে করে প্রশ্নফাঁসের প্রভাব কিছুটা কমানো যায়, যেমন— সরকারই নিজ উদ্যোগে তারই মন্ত্রণালয়ের কয়েকজনকে নিয়ে একটি দল গঠন করবে, যারা হোয়াট্সঅ্যাপসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আইডি খুলে প্রচুর পরিমাণ ভুয়া প্রশ্ন ছড়িয়ে দেবে। রিয়েল প্রশ্নের মাঝে ভুয়া প্রশ্ন ছেড়ে দিলে, পরীক্ষার্থীরা দ্বিধায় পড়ে যাবে। তখন এর প্রভাব কমে আসবে।’
বক্তারা আরও বলেন, প্রশ্নফাঁস রোধে প্রযুক্তির ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে অপরাধীদের শনাক্তকরণ, আইনের কঠোর প্রয়োগ ও শাস্তি, দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ করেই এই বিপর্যয় সামাল দিতে হবে।
অনুষ্ঠানে তুলে ধরা প্রস্তাবনাগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বোর্ড কর্তৃপক্ষ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে পেশ করার ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত হয়I
বৈঠকে আরও বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ আইসিটি জার্নালিস্ট ফোরাম (BIJF) এর সহ-সভাপতি নাজনীন আহমেদ, পরিবর্তন চাই-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ফিদা হক, প্রেনার ল্যাব-এর প্রতিষ্ঠাতা আরিফ নিজামী, জাগো ফাউন্ডেশন-এর প্রতিষ্ঠাতা করভি রাকসান্দ প্রমুখ।