২৫ টাকায় গরিব রোগীদের লেপারস্কোপিক সার্জারি!


শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল (ছবি: সংগৃহীত)





আর্থিক দিক থেকে অসচ্ছল রোগীদের সর্বনিম্ন ২৫ টাকা খরচে লেপারস্কোপিক সার্জারি করছে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। আর এ কারণে এখানে রোগীদের ভিড় দিন দিনই বাড়ছে। এই হাসপাতালটি এখন লেপারস্কপিক সার্জারির অ্যাডভান্স স্টেজ পার করছে বলে জানিয়েছেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. পি, কে, সাহা।
রোগী মিনারা বেগমের (৫০) বাড়ি টঙ্গীতে। সেখানে তার মূত্রনালীসংক্রান্ত সমস্যা দেখা দেয়। চিকিৎসক তাকে অস্ত্রোপচারের জন্য বলেন। ভাগিনার মাধ্যমে তিনি শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন।
এখানে চিকিৎসকরা তার লেপারস্কপিক সার্জারি করেছেন। মাত্র একদিন পরই বাড়ি যাওয়ার অনুমতি পেয়েছেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘সরকারি হাসপাতাল তো আমাগো গরিব গো লাইগ্যা। এই হাসপাতাল না থাকলে তো আমার মরা লাগত।’
ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া থেকে পিত্তথলির পাথর নিয়ে এই হাসপাতালে ভর্তি হন দিনমজুর মো. আবুল কাশেম (৩০)। চিকিৎসকরা এখানে লেপারস্কপির মাধ্যমে তার পিত্তথলির পাথর অপসারণ করেছে।
তিনি বলেন, স্থানীয় থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক তাকে এই হাসপাতালে পাঠান।
হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, লেপারস্কপিক সার্জারি, মিনিমালি ইনভ্যাসিভ সার্জারি (এমআইএস), ব্যান্ডএইড সার্জারি অথবা কি হোল সার্জারি নামেও পরিচিত। সাধারণত এই অস্ত্রোপচার করার জন্য শরীরে দশমিক পাঁচ থেকে ১ দশমিক পাঁচ সেন্টিমিটার ছিদ্র করতে হয়।
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, ১৯০১ সালে প্রথম জার্মানির বিজ্ঞানী জর্জ কেলিং একটি কুকুরের লেপারস্কপিক সার্জারি করেন। ১৯১০ সালে সুইডেনের হ্যানস ক্রিশ্চিয়ান জ্যাকোবাইস মানুষের শরীরে প্রথম লেপারস্কপিক সার্জারি করেন। এরপর ধীরে ধীরে এই চিকিৎসা বিজ্ঞান অনেকদূর এগিয়েছে। দেশের অন্যান্য সরকারি হাসপাতালেও এই চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু থাকলেও এই হাসপাতালের চিকিৎসকরা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে রোগীদের এই চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন।
হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমাদের হাসপাতালের অধিকাংশ পেটের অস্ত্রোপচার লেপারস্কপিক সার্জারির মাধ্যমে করা হয়, অর্থাৎ উন্মুক্ত না করেই এই অস্ত্রোপচার করা হয়। আমাদের এখানে লেপারস্কপির অনেক ভালো ভালো সার্জন আছেন এবং আপনারা এও জানেন আমরা দুইবার ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স করেছি আমাদের এই হাসপাতালে। আমাদের এখানে ১০টি অস্ত্রোপচার কক্ষ আছে যেখানে লেপারস্কপিক সার্জারি হয়।
ড্রাই ল্যাবে পি. কে. সাহা

তিনি বলেন, সাধারণ সার্জারি এবং লেপারস্কপি সার্জারির মধ্যে অনেক তফাৎ। আমাদের লেপারস্কপি হচ্ছে পেট না কেটে সার্জারি করা। পেটের ভেতরে কিডনি, লিভার, পাকস্থলী, কোলন, স্টোমাক, রেক্টাম- এই জিনিসগুলো আছে। তাই পেট না কেটে যদি লেপারস্কপি করি তাহলে ইনফেকশন হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে। রোগীদেরও হাসপাতালে খুব অল্প সময় থাকতে হয়। একজন রোগী অস্ত্রোপচার করে পরের দিন চলে যেতে পারে। পেটে ছোট্ট দুই তিনটা ছিদ্র থাকে। সাধারণ অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ১০ দিন রোগীকে হাসপাতালে থাকতে হয়।
হাসপাতালের সার্জন (ক্যাজুয়ালটি) ডা. আ স ম ফরহাদুল হাসান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমরা রোগীর সব ডায়াগনোসিস করি বহির্বিভাগে। ফলে, রোগীকে বেশি সময় ব্যয় করতে হয়। ডায়াগনসিসে লেপারস্কপি করতে হবে বোঝা গেলে আমরা রোগীকে নির্দিষ্ট তারিখ দিই। এইদিনে রোগী হাসপাতালে এসে ভর্তি হয় এবং তারপর তার সার্জারি হয়। এতে করে রোগীর সময় ও অর্থ দুটোই বাঁচে।
সার্জারী বিশেষজ্ঞ ও অ্যাডভান্সড লেপারস্কপিক সার্জন ও বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. পি, কে, সাহা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, গত ১০ বছর ধরে সার্জারি বিভাগে লেপারস্কপি করছি। আমরা এখন অ্যাডভান্স স্টেজে লেপারস্কপি করি। আমাদের এখানে এফসিপিএস, এমএস করা শিক্ষার্থীরা লেপারস্কপি শিখছে। আমাদের দেশের অর্থনীতি অনেক এগিয়ে গেছে। আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমাদের লেপারস্কপিটা বিশ্বমানে নিয়ে যাওয়া। সাধারণ অস্ত্রোপচারে শুধু একজন চিকিৎসক অন্যজনের সঙ্গে কাজ করতে পারে। কিন্তু,লেপারস্কপির ক্ষেত্রে ক্যামেরার মাধ্যমে আমরা কাজ করি। তরুণ চিকিৎসকরা এই চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পর্কে শিখছে। আমি মনে করি, এই সার্জারি গরিব মানুষের জন্য হওয়া উচিত।
তিনি বলেন, সাধারণ মানুষের ধারণা, লেপারোস্কপি দিয়ে শুধু গল ব্লাডারের অপারেশন করা হয়। আসলে বিষয়টি তা না। লেপারোস্কপি দিয়ে পেটের ভেতরে যা আছে তার সবকিছুই অস্ত্রোপচার করা যায়। আমাদের এই সেন্টারে সব ধরনের লেপারোস্কপি করি। আমাদের বিচারে দেশের গরিব মানুষরা যেন এই চিকিৎসা সেবা পায় তারা যেন এটাকে অ্যাফোর্ড করতে পারে। সেটা আমরা চাই।
সার্জারি বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. রাজীব দে সরকার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এখানে রোগী মাত্র ১০ টাকার টিকেট কেটে বহির্বিভাগে দেখায়। যদি তাকে ভর্তি করার প্রয়োজন পড়ে তাহলে ভর্তি হতে ১৫ টাকা লাগে। ফ্রি বেডে যেসব রোগী ভর্তি থাকে তাদের অনেকের টেস্ট ফ্রি করে দেওয়া হয়। তাছাড়া অস্ত্রোপচারের জন্য সরকারি নিয়ম অনুযায়ী কোনও অস্ত্রোপচার চার্জ রোগীকে দিতে হয় না। যার কারণে কখনও কখনও মাত্র ২৫ টাকাতেই রোগীর লেপারস্কপিক সার্জারি সম্পন্ন হয়। যারা অবস্থাপন্ন এবং পেয়িং বেড বা কেবিনে থাকে সেইসব রোগীদের ক্ষেত্রে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সব ধরনের চার্জ দিতে হয় এবং সরকারি নিয়ম অনুযায়ী তাদের অস্ত্রোপচারের জন্য ৫০০ টাকা দিতে হয়।
ডা. আ স ম ফরহাদুল হাসান বলেন, আমাদের এটিতো সরকারি হাসপাতাল। এখানে ওটি (অস্ত্রোপচার কক্ষ) চার্জ নেওয়া হয় না। তারপরও সরকারি মেডিক্যাল কলেজে অনেক কিছু কিনতে হয়। ব্যান্ডেজ খারাপ হলে কিনতে হয়। বাইরে থেকে কেনাকাটা করার জন্য কোনও কোনও সময় রোগীদের পকেট থেকে কিছু অর্থ যায়। তবে, আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করি রোগীদের জন্য যা যা বরাদ্দ আছে তার পুরোটাই সাপ্লাই দেওয়ার।
রাজীব দে সরকার বলেন, আমাদের এখানে রোগীর সেবার বিষয়টি ভালোভাবে দেখভাল করা হয়। আমাদের রোগীর জন্য আরও বেড দরকার। আরও দক্ষ কর্মী দরকার। তাহলে আমরা আরও রোগীদের সেবা দিতে পারবো।
অধ্যাপক ডা. পি, কে, সাহা বলেন, আমি এখন থেকেই তৃতীয় ইয়ারের স্টুডেন্টদের থেকেই লেপারস্কপিক সার্জারি শেখাচ্ছি। আমি চাই, এই সার্জারি ব্যবস্থা থানা কমপ্লেক্স পর্যন্ত পৌঁছে যাক। তাহলে দেশের রোগীদের সময়, অর্থ ও ঝুঁকি সবকিছুই কমবে।