পাকিস্তানি গ্রেনেড, জড়িত দেশি-বিদেশি জঙ্গি সংগঠন

ঘটনাস্থলে পড়ে আছে একটি অবিস্ফোরিত গ্রেনেডদেশের স্মরণকালের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জঙ্গি হামলা ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা। এই হামলায় ব্যবহৃত গ্রেনেডের উৎস পাকিস্তান। আর সরবরাহকারীও পাকিস্তানের নাগরিক। এছাড়া, হামলার সঙ্গে জড়িত রয়েছে বাংলাদেশ ও প্রতিবেশী চার দেশের (ভারত, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, মিয়ানমার) সক্রিয় সাতটি জঙ্গি সংগঠন। বহুল আলোচিত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার ২২৫ জন সাক্ষী, ২০ জন সাফাই সাক্ষী ও গ্রেফতার ১২ আসামির জবানবন্দি পর্যালোচনায় এসব তথ্যই বেরিয়ে এসেছে। 

জঙ্গি সংগঠন হিজবুল মুজাহিদিন, তেহরিক-ই-জিহাদি ইসলামি, লস্কর-ই-তৈয়বা, জয়েশ-ই-মোহাম্মদ, হরকাতুল মুজাহিদিন, হরকাতুল জিহাদ ও রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও  )-এর   মতো সংগঠনের সঙ্গে জড়িত নেতাকর্মীরা গ্রেনেড হামলা, পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আর এই সংগঠনগুলো পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই ) নিয়ন্ত্রিত বলে মামলার তদন্তে উঠে এসেছে। 
তিন জঙ্গি মাওলানা আব্দুস সালাম, মুফতি হান্নান ও পাকিস্তানি নাগরিক মাজেদ ভাটশেখ হাসিনাকে হত্যার টার্গেট করে গ্রেনেড হামলায় সরাসরি অংশ নেয় ১২ জন। তাদের হাতে ছিল ১৫টি গ্রেনেড। এর মধ্যে ১৩টি আওয়ামী লীগের সমাবেশ স্থলে নিক্ষেপ করে জঙ্গিরা। একটি ছাড়া বাকি সবগুলো গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়। 
মামলার অভিযোগপত্রে গ্রেনেডের উৎস সম্পর্কেও স্পষ্ট  উল্লেখ রয়েছে। আসামি আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ শাখার নেতা মুফতি আব্দুল হান্নান মুন্সী, আব্দুল মালেক ওরফে গোলাম মোহাম্ম জিএম ও মাওলানা আব্দুল সালাম এবং পাকিস্তানভিত্তিক হরকাতুল মুজাহিদিন নেতা আব্দুল মাজেট ভাটের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতেও গ্রেনেডের উৎস হিসেবে পাকিস্তান এবং সরবরাহকারী হিসেবে পাকিস্তানের নাগরিকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। 
বাদল নামে ভুয়া পরিচয়ে পাসপোর্ট তৈরি করে মাওলানা তাজউদ্দিনঅভিযোগপত্র ও জবানবন্দি থেকে জানা যায়— বাংলাদেশ ও ভারতে জঙ্গি কর্মকাণ্ড পরিচালনার মিশন নিয়ে ২০০০ সাল থেকেই বাংলাদেশে যাতায়াত শুরু করে কাশ্মিরভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন হিজবুল মুজাহিদিনের নেতা আব্দুল মাজেদ ভাট ওরফে ইউসুফ ভাট ও তেহরিক-ই-জিহাদিল ইসলামি (টিজেআই) নেতা মুজাফফর শাহ। তাদের দেখভালের দায়িত্ব পালন করে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুর ছোটভাই হিজবুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ শাখার নেতা মাওলানা তাজউদ্দিন ও হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি আব্দুল হান্নান মুন্সী। আর মুজাফফর শাহ ও মাজেদ ভাটের সূত্রেই পাকিস্তান থেকে চট্টগ্রামে গ্রেনেড আসে। পরে ওই গ্রেনেড ঢাকা ও ঢাকার বাইরে সরবরাহ করা হয়। ২১ আগস্টসহ  দেশের বিভিন্ন  স্থানে সংঘটিত হামলায় পাকিস্তান থেকে আনা এই গ্রেনেডগুলোই ব্যবহার করা হয়। 
মামলার নথিপত্র বলছে, অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন— বিএনপির ছয় ও জামায়াতের এক নেতা। এছাড়া, ডিজিএফআই-এর  সাবেক দুই কর্মকর্তা, এনএসআই’র সাবেক তিন কর্মকর্তা, পুলিশের সাবেক আট  কর্মকর্তা, একজন পরিবহন ব্যবসায়ী, এক পাকিস্তানি নাগরিক ও আইএসআই নিয়ন্ত্রিত সাতটি আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের ৩০ নেতাকর্মী। অন্য মামলায় সাজাপ্রাপ্ত তিন আসামির ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় বর্তমানে এ মামলার আসামির সংখ্যা ৪৯। 
গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহতাবস্থায় রাস্তায় পড়ে আছেন মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আইভি রহমান

মামলার নথিপত্র থেকে জানা যায়, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে সংঘটিত এ হামলায় ছিচকে সন্ত্রাসী জজ মিয়াকে ঘটনার অন্যতম হোতা হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা হয়। আর বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির তদন্তও ছিল নামকাওয়াস্তে। 
২০০৮ সালের ১১ জুন ২২ জনকে আসামি করে এ মামলার প্রথম অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। আর ২৯ অক্টোবর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় বিচার কাজ। পরের বছর ৩ আগস্ট রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত। ২০১১ সালের ৩ জুলাই আরও ৩০ জনকে আসামি করে সম্পূরক অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়। পরের বছর ১৮ মার্চ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্যদিয়ে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে আবারও বিচার শুরু হয়। 
২০০৪ সালে ১ এপ্রিল চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধার হয়। এই মামলাসহ আরও অনেক মামলায় জড়িতরাও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলারও আসামি। সব মামলা চলমান থাকায় দ্রুত বিচার সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষে মামলাটির প্রধান কৌঁসুলি সৈয়দ রেজাউর রহমান। তবে মামলার বিচারিক প্রক্রিয়া ও তদন্ত নিয়ে সন্তুষ্ট হন আসামি পক্ষের আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া।

আরও পড়ুন:

পাকিস্তানে পরিকল্পনা, ঢাকায় বাস্তবায়ন

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা: আসামিদের রক্ষায় যেভাবে আলামত নষ্ট করা হয়