ব্যবসা হাতছাড়া হওয়ার ভয়েই সরানো হয় না কেমিক্যাল গোডাউন

অগ্নিকাণ্ডের পর চকবাজারের দৃশ্যব্যবসা হাতছাড়া হওয়ার ভয়েই ঘনবসতিপূর্ণ পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল গোডাউন সরাননি ব্যবসায়ীরা। এক্ষেত্রে বাড়ির মালিকদের বেশি ভাড়া পাওয়ার লোভও ভূমিকা রেখেছে। এছাড়া কেমিক্যাল গোডাউনের বিষয়ে আইন প্রয়োগে সরকারের শিথিলতা ও ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর উদাসীনতাও দায়ী। কেমিক্যাল ব্যবসায়ীরা বলছেন, শত বছরের ঐতিহ্য ছেড়ে ব্যবসা সরানোর ঝুঁকি নিতে চান না তারা।
কেমিক্যালের জন্য বিখ্যাত বন্দর হিসেবে পরিচিত পুরান ঢাকা বা মিডফোর্ট এলাকা। তুলনামূলক কম দামে সব ধরনের কেমিক্যাল পাওয়া যায় এখানে। নগদ টাকায় লেনদেনের কারণে মিডফোর্ট, চকবাজার, মৌলিভীবাজার,আরমানিটোলা এলাকায় গড়ে উঠেছে শত শত কেমিক্যাল কারখানা। বেসরকারি এক হিসেবে দেখা গেছে, পুরান ঢাকায় ২৫ হাজার কেমিক্যাল বা রাসায়নিক দাহ্য বস্তুর গুদাম আছে। এর মধ্যে ১৫ হাজার রয়েছে বাসা বাড়িতেই।
পুরান ঢাকার নিমতলীতে রাসায়নিকের গুদামে ২০১০ সালের ৩ জুন অগ্নিকাণ্ডে ১২৪ জন নিহত হয়। ওই ট্র্যাজেডির পর অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত কমিটির সুপারিশের অন্যতম ছিল আবাসিক এলাকা থেকে রাসায়নিকের কারখানা ও গুদাম সরিয়ে নেওয়া। এজন্য ১৭টি সুপারিশ করা হয়। তবে ভয়ঙ্কর রাসায়নিকের গুদাম ও প্লাস্টিকের কারখানা আজও সরেনি। যে কারণে গত বুধবার (২০ ফেব্রুয়ারি) আবারও অগ্নিকাণ্ড ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সাবেক উপদেষ্টা মঞ্জুর আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রথমত প্রশাসনের অবহেলার কারণে কেমিক্যাল কারখানা ও কেমিক্যাল গোডাউন ঢাকার বাইরে সরানো যায়নি। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোও তৎপর ছিল না। বেশি টাকার লোভে স্থানীয়রা জেনেশুনে বাসা বাড়িতে ঝুঁকিপূর্ণ কেমিক্যাল কারখানা বা গোডাউন ভাড়া দেয়।’ মূলত চ্যালেঞ্জে পড়ার আশঙ্কাতেই শত বছরের ঐতিহ্য ছেড়ে এখান থেকে ব্যবসায়ীরা যেতে চান না বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, ‘যত ব্যবসায়িক মূল্যই থাকুক না কেন, এভাবে চলতে পারে না। মানুষের জীবন আগে, পরে ব্যবসা।’
হাজী ওয়াহেদ ম্যানশনের গুদামে রাখা কেমিক্যালএ প্রসঙ্গে সায়েন্টিফিক কেমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য গোলাম কিবরিয়া বলেন, ‘ব্যবসা হারানোর ভয়ে পুরান ঢাকা ছাড়ছেন না সেখানকার কেমিক্যাল ব্যবসায়ীরা। মিডফোর্ট এলাকায় মূলত ঘরে বসে নগদ টাকার ব্যবসা হয়। প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার কেমিক্যাল বিক্রি করেন সেখানকার ব্যবসায়ীরা। তাদের কোনও মার্কেটিং করতে হয় না। কিন্তু অন্যত্র গেলে তাদের এই ব্যবসা হাতছাড়া হতে পারে। নতুন করে মার্কেটিং করতে হবে। নতুন করে গ্রাহক তৈরি করতে হবে।’
২০১০ সালে নিমতলী ট্র্যাজেডির পর তদন্ত কমিটির সুপারিশে রাজধানীর রাসায়নিক কারখানা ও গুদাম কেরানীগঞ্জে সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এজন্য 'বিসিক কেমিক্যাল পল্লী' প্রকল্পও হাতে নেয় সরকার। আট বছর পর ২০১৮ সালের অক্টোবরে তা একনেকের অনুমোদন পায়। ২০১ কোটি ৮১ লাখ টাকায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)। চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি এ প্রকল্পের পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তবে এখনও জমি অধিগ্রহণসহ প্রকল্প এলাকায় কোনও কাজ শুরু করতে পারেনি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কেমিক্যাল ব্যবসায়ী বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা তাদের কারখানা ও গুদাম কেরানীগঞ্জে নিয়ে গেলেও ক্রেতারা সেখানে যেতে চাইবে না। কারণ ইতোমধ্যে টিকাটুলি, মতিঝিলসহ রাজধানীর অন্যান্য এলাকা থেকেও কেমিক্যাল সংগ্রহ করতে পারছেন ক্রেতারা।’
অবশ্য কেমিক্যাল ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত সবাইকে কেরানীগঞ্জে নিয়ে যেতে পারলে তবেই সুফল পাওয়া যাবে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা। কারণ যারা মিডফোর্ট থেকে যাবে, ক্রেতারা তার কাছেই যাবে। কেরানীগঞ্জ যাবে না। উদাহরণ হিসেবে তারা বলেন, নিমতলী ট্র্যাজেডির পর বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী কেরানীগঞ্জে গেলেও পরে তাদের সেখানে রাখা যায়নি। আবার পুরান ঢাকায় ফিরে এসেছেন তারা।
এ প্রসঙ্গে এফবিসিসিআই’র সাবেক সহসভাপতি ও বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, কেরানীগঞ্জে শুধু পাঠালেই তো হবে না। সেখানে যাতে থাকতে পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি উল্লেখ করেন, আমরা দফায় দফায় বৈঠক করে কেমিক্যাল কারখানা সরানোর বিষয়ে ৩৮ দফা সুপারিশ করেছি। তিনি মনে করেন, কেমিক্যাল গোডাউন অবশ্যই কেরানীগঞ্জে নিয়ে যেতে হবে।
এফবিসিসিআই সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, ‘ব্যবসার ক্ষতি হলেও কেমিক্যাল কারখানা ও গোডাউন কেরানীগঞ্জে নিয়ে যেতে হবে। তিনি উল্লেখ করেন, ইতোমধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ ২২টি কেমিক্যাল প্রতিষ্ঠানকে শনাক্ত করা হয়েছে যারা যেকোনও সময় দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। তিনি আরও বলেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে কেমিক্যাল কারখানা কেরানীগঞ্জে নিয়ে যেতে হবে এটাই শেষ কথা। কারণ এতো ঘনবসতি এলাকায় কোনোভাবেই এই ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসা করা যাবে না। মানুষের জীবন আগে।