সুস্থ থাকতে কণ্ঠের যত্ন নেওয়া জরুরি

বিশ্ব কণ্ঠ দিবস

দেখা যায় না মোটেও, অথচ এর অস্তিত্ব ছাড়া অসম্পূর্ণ জীবন। অতি গুরুত্বপূর্ণ এই যোগাযোগ যন্ত্রটির নাম কণ্ঠ। মানুষে মানুষে যোগাযোগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম এটি। একজন মানুষের ব্যক্তিত্ব কেমন তার অনেকটাও নির্ভরও করে কণ্ঠের ওপর। মনের ভাব প্রকাশে সবচেয়ে কার্যকরী মাধ্যম এই কণ্ঠকে যে যতটা কাজে লাগাতে সক্ষম হন তার সাফল্যও আসে ততটাই। তাই নিজের সুস্থ থাকার পাশাপাশি প্রতিদিন কণ্ঠস্বরেরও যত্ন প্রয়োজন। অকারণ চিৎকার যেমন কণ্ঠস্বরকে নষ্ট করে দেয় তেমনই গলার যত্ন না নিলে বাসা বাঁধতে পারে রোগ ব্যাধিও। কণ্ঠের এই যত্ন নেওয়ার বিষয়টিকে সামনে আনতে আজ ১৬ এপ্রিল তাই বিশ্বজুড়ে পালন করা হচ্ছে ‘বিশ্ব কণ্ঠ দিবস’, সচেতনতা বাড়াতে বাংলাদেশেও দিনটি পালন হয় গুরুত্ব দিয়ে।

ভোরের আজানের শব্দে ঘুম ভাঙে অনেকের। কারও ঘুম ভাঙে ফেরিওয়ালার ডাকে। অনেকেই আছেন–যেখানেই থাকেন সময় পেলেই গান শুনতে চান। বাসায় বাবা-মায়ের আদেশ উপদেশ, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের পড়ানো, কর্মক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের কাজ উপস্থাপনা (প্রেজেন্টেশন), বিশেষ কারও মনোযোগ আকর্ষণ—সারাদিনে যত ধরনের কাজ আছে,সংসারে-কর্মক্ষেত্রে যত বিনোদন, যতো প্রার্থনা, যত অভিব্যক্তি, যত উপভোগ—তার বেশিরভাগই শব্দ নির্দেশিত। রাগ, হাসি, ক্ষোভ, কান্না সব কিছুর সঙ্গে মিশে আছে শব্দ। আর শব্দের উৎসস্থল হচ্ছে গলায় থাকা বাগযন্ত্র, মাধ্যম হচ্ছে কণ্ঠ।    

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অন ডিফনেস অ্যান্ড আদার কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডার (এনআইডিসিডি) এর তথ্যানুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে ২৯ ভাগ বা প্রায় ৭৫ লাখ মানুষ জীবনে কোনও না কোনও সময় কণ্ঠের সমস্যায় ভুগে থাকেন।  এতে যে কর্মক্ষমতা নষ্ট হয় তার অর্থ মূল্য প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার। বছরে প্রতি ১৩ জনে ১ জন এই সমস্যায় পড়েন। নারীরা এবং ছেলে শিশুরা এই সমস্যায় বেশি আক্রান্ত হন। যুক্তরাষ্ট্রের শিশুদের ৮-৯ ভাগ শিশু কণ্ঠের সমস্যায় ভুগে। এদের মধ্যে পাঁচ ভাগ শিশুর উচ্চারণের জটিলতা রয়েছে।

দেশটির একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক নেলসন রয়ের এক গবেষণায় দেখা যায়, সেখানে শিক্ষকদের ১১ ভাগই কণ্ঠের সমস্যায় ভুগছেন। শিক্ষক ছাড়া অন্য পেশার জন্য এই হার ৬ দশমিক দুই ভাগ। ২০ ভাগ শিক্ষক কণ্ঠ জটিলতায় চাকরি হারিয়েছেন। 

অন্যান্য জরিপে দেখা যায়, দেশটির ৪৬ দশমিক শূন্য নয় ভাগ কণ্ঠশিল্পী, ৪৫ ভাগ কলসেন্টারের কর্মী কণ্ঠের সমস্যার কারণে কর্মক্ষেত্রে  ক্ষতিগ্রস্ত হন।

তবে যুক্তরাষ্ট্রে কণ্ঠের ওপর এমন জরিপ ও গবেষণা থাকলেও এ বিষয়ে বাকি বিশ্বের তেমন একটা তথ্য পাওয়া যায় না। বাংলাদেশেও কণ্ঠের ওপর সুনির্দিষ্ট গবেষণা এখনও হয়নি। তবে কণ্ঠদিবস পালন এ বিষয়ে বিশ্বজুড়েই প্রতিবছরেই সচেতনতা আনছে।

১৯৯৯ সালে ব্রাজিলে প্রথম ১৬ এপ্রিল বিশ্ব কণ্ঠ দিবস পালিত হয়। আর ধারণাটি লুফে নেওয়ায় ২০০২ সাল থেকেই বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালিত হচ্ছে। দিবসটি উপলক্ষে এ বছরের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘বি কাই- উইথ ইয়োর ভয়েস।’  দেশে বিএসএমএমইউসহ বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের নাক, কান ও গলা বিভাগ দিবসটি উদযাপন করছে।

অটোল্যারিংগোলজি-হেড অ্যান্ড নেক সার্জারি বিভাগের চিকিৎসকরা বলছেন, বাংলাদেশে এখনও পর্যন্ত কণ্ঠস্বরের সমস্যাগুলো নিয়ে কেউ তেমনভাবে গবেষণা করেনি। তবে, আমরা সাধারণ নাগরিকদের কণ্ঠস্বরের যত্ম নেওয়ার ক্ষেত্রে সচেতনতাকে গুরুত্ব দিচ্ছি।

বিশ্ব কণ্ঠ দিবসের পোস্টার

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও মিটফোড হাসপাতালের নাক কান গলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা.মনিলাল আইচ লিটু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,কণ্ঠকে শুধুমাত্র যোগাযোগের প্রধান উপায় ভাবলে ভুল হবে। বাক্যের ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে কণ্ঠের ওঠানামা আমাদের ব্যবহার করা শব্দের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আপনার কথা কী প্রভাব সৃষ্টি করবে তার ৩৮ ভাগ নির্ভর করে কণ্ঠের ওঠানামার অপর। আর তাই দৈনন্দিন সাংসারিক বা কর্মক্ষেত্রে কথাবার্তার জন্য ভালো কণ্ঠের গুরুত্ব অনেক বেশি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) এর অটোল্যারিংগোলজি- হেড অ্যান্ড নেক সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. এ এইচ এম জহুরুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, কণ্ঠ যোগাযোগের জন্য, জীবন-যাপনের জন্য এমনকি জীবিকা অর্জনের জন্যও প্রয়োজন। আইনজীবী,শিক্ষক,কণ্ঠশিল্পীসহ প্রত্যেক মানুষেরই সুন্দর কণ্ঠ প্রয়োজন। সে কারণে আমরা কণ্ঠস্বরের নিয়মিত যত্ম নিতে বলি।যত্ম নেওয়ার পাশাপাশি কোনও ধরনের উপসর্গ দেখা দিলে সেটার জন্য চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।আবার রোগ হয়ে গেলে সেটার জন্য চিকিৎসা আছে। কিছু টিউমারাস কন্ডিশন আছে যেগুলোর জন্য সার্জারি লাগে।

তিনি বলেন, জোরে কথা না বলা, কণ্ঠের অপব্যবহার, অতিরিক্ত ব্যবহার এগুলো থেকে দূরে থাকতে হবে। আমরা দেখি যে, অনেক ছোট শিশু বিশেষ করে কোরআনের হাফেজ যারা এদেরকে বোধহয় জোরে পড়তে বলে। এদের জোরে পড়ার কারণে আমরা ভয়েসের ভোকাল কর্ডে প্রবলেম দেখতে পাই। দীর্ঘদিন জোরে পড়লে কণ্ঠে নডিউল হয়। সেটি প্রাথমিক অবস্থায় আসলে বড় হয় না। রোগ বেড়ে গেলে টিউমার হলে সেটা সার্জারি করে ফেলতে হয়। যেহেতু কণ্ঠস্বর যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম তাই আমরা এটির যত্ম নেওয়ার জন্য বলি।

কণ্ঠের ঠিকমতো যত্ম না নিলে কী ধরনের সমস্যা হতে পারে জানতে চাইলে ডা. মনিলাল আইচ লিটু বলেন, কণ্ঠের ঠিকমতো যত্ম না নিলে কণ্ঠনালীর প্রদাহ, কণ্ঠস্বরের অতি ব্যবহারের কারণে পলিপ, নডিউল বা সিস্ট, রক্তক্ষরণ সৃষ্টি হওয়া এবং কন্ঠনালীর ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। 

অধ্যাপক ডা. মনিলাল আইচ লিটু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, কণ্ঠ ভালো রাখতে এর যত্ম নেওয়ার বিকল্প নেই। এজন্য সবার আগে দরকার সচেতনতা। অনেকেই জানে না যে তাদের পেশার জন্য সুস্থ ও সুন্দর কণ্ঠ কতটা জরুরি।নিজের কণ্ঠ নিজে শুনতে হবে,যেন কোনও সমস্যা তাড়াতাড়ি আন্দাজ করা যায়। সমস্যা ৩ সপ্তাহের বেশি থাকলে নাক কান গলা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। কণ্ঠের সুস্থতার জন্য প্রতিদিন অন্তত দুই লিটার পানি পান করতে হবে। অতি উচ্চ বা পরিবর্তিত স্বরে কথা বলা যাবে না। অ্যালকোহল, কফি, চা, কোমল পানীয় শরীরের কোষে পানি শূন্যতা ঘটায়। তাই খেলে অল্প পরিমাণে খেতে হবে।

তিনি বলেন, ধূমপান এবং অ্যালকোহল, তামাক, গাঁজা, পান খাওয়াসহ অন্যান্য নেশা সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলতে হবে। ঘুমাতে যাওয়ার কমপক্ষে ২ ঘণ্টা আগে খাওয়া শেষ করতে হবে এবং অল্প আহার করতে হবে।  ফোনে বেশিক্ষণ কথা বলা যাবে না। অপ্রয়োজনে বারবার গলা পরিষ্কার বা কাশি দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। উড়োজাহাজে চলাচলের সময় বাতাস শুষ্ক থাকে। এসময় কফি, চা, কোমল পানীয় এড়িয়ে চলতে হবে এবং প্রতি ঘণ্টায় কমপক্ষে ৮ আউন্স পানি পান করতে হবে। অনেক সময় গলা শুকনা থাকলে অথবা মিউকাস জমে থাকলে আমরা জোরে কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করার চেষ্টা করি যা অত্যন্ত ক্ষতিকর। এজন্য প্রথমে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে কিছুক্ষণ ধরে রাখতে হবে এবং শ্বাস ছাড়ার সময় আস্তে শব্দ করে ছাড়তে হবে।

এছাড়াও তিনি বলেন, এলার্জি বা ঠাণ্ডার সমস্যায় এন্টিহিস্টামিন ঔষধ ব্যবহার করা যাবে না। সম্ভব হলে এগুলো এড়িয়ে স্টেরয়েড স্প্রে নাকে ব্যবহার করতে হবে। স্থানীয় চেতনানাশক যথেচ্ছ ব্যবহার করা যাবে না। ধোঁয়া, ধুলা, দূষিত বাতাস এড়িয়ে চলতে হবে। কণ্ঠশিল্পীদের গান গাওয়ার সময় শারীরিক, মানসিক অবসাদ মুক্ত থাকতে হবে। এসময় হাল্কা গরম পানি য়ে গড়গড়া করতে পারেন। সেইসঙ্গে নিয়মিত ব্যায়াম এবং পর্যাপ্ত ঘুমাতে হবে।