‘একটা শব্দ শুনলাম, মুহূর্তেই ওলট-পালট’

পঙ্গু হাসপাতালে মহিন মিয়ারাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালের (পঙ্গু হাসপাতাল) দ্বিতীয় তলার একটি ওয়ার্ডে বাম পায়ে ব্যান্ডেজ নিয়ে শুয়েছিলেন মহিন মিয়া। পাশে থাকা শিশুটির হাতে অ্যালবো ব্যাগ ঝোলানো। পাশে গিয়ে কথা বলতে চাইলে আগ্রহ দেখালেন তার শাশুড়ি আমিনা বেগম। কিন্তু কথা বলে উঠলেন কসবায় দুই ট্রেনের সংঘর্ষে আহত মহিন নিজেই। জানালেন, এই দুর্ঘটনায় মারা গেছে তার দুই বছর দুই মাস বয়সী মেয়ে, এই মুহূর্তে অপারেশন টেবিলে রয়েছেন স্ত্রী। আর আহত ছেলেকে পাশে নিয়ে শুয়ে আছেন নিজেই। আর্তনাদ করে বললেন, ‘আমার পরিবার একেবারে শেষ হয়ে গেল...।’
নিজেকে সামলে নিয়ে গার্মেন্টস কর্মী মহিন মিয়া জানালেন, স্ত্রী নাজমা আর দুই সন্তানকে নিয়ে চট্টগ্রামে থাকেন তারা। ছুটিতে গত আট নভেম্বর হবিগঞ্জে গ্রামের বাড়িতে যান। সেখান থেকে ফেরার পথে দুর্ঘটনার কবলে পড়েন। সোমবার (১১ নভেম্বর) দিবাগত রাত ৩টার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার মন্দবাগ রেলস্টেশনে তূর্ণা নিশীথা ও উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে অন্তত ১৬ জন নিহত ও শতাধিক মানুষ আহত হয়। এদেরই একজন মহিন মিয়া।
তিনি বলেন, আমার মেয়েটা ঘটনাস্থলেই মারা গেছে। ছবিতে দেখলাম, মাথার পেছন দিয়ে রক্ত আসছে, আমার ছোট্ট মেয়েটা না জানি কত ব্যথা পেয়েছে, কিন্তু কিছুই তো বলতে পারেনি। ‘আহারে আমার মেয়েটা’ বলে চিৎকার করে ওঠেন তিনি।
পাশ থেকে মহিনের শাশুড়ি আমিনা বেগম জানালেন, তার মেয়ে জানে না, তার দুই বছর দুই মাসের মেয়ে সোহা মনি বেঁচে নেই। অপারেশন থিয়েটার থেকে ফিরে আসার পর যখন মেয়েকে খুঁজবে তখন তাকে কী বলবেন সেটাই এখন ভাবছেন তিনি।
হোসেন আলীদুর্ঘটনার বিষয়ে কিছু মনে আছে কিনা জানতে চাইলে মহিন মিয়া বলেন, ‘কিছুই দেখিনি। শুধু এতটুকু জানি, একটা শব্দ শুনছি, বিদ্যুৎ চলে গেছে, মুহূর্তেই গাড়ি ওলট-পালট। চোখের পলকে সব শেষ। এরপর আর কিছু বলতে পারি না। পরে জ্ঞান ফিরেছে, কিন্তু সেটা কতক্ষণ পর আমি বলতে পারবো না। কেবল এখন আবছা আবছা মনে আছে, একদল লোক টাইনা টাইনা যাত্রীদের তুলছিল। আমি তখন চিৎকার দিয়ে বললাম, ভাই আমারে বাঁচান। ওরা টান দিল, কিন্তু তখন বুঝলাম পা কিছুর সঙ্গে আটকে আছে।পরে তারা সেগুলো সরায়ে আমাকে উঠাইছে। ছেলেটাও পাশে ছিল, ওরে একবার কেবল ধরলাম, আর কিছু বলতে পারবো না।’
একই হাসপাতালের আরেক ওয়ার্ডে নাকে-মুখে শুকিয়ে যাওয়া রক্ত নিয়ে শুয়ে আছেন আবুল কালাম। তার দুই পায়েই ব্যান্ডেজ, রক্ত দেওয়া হয়েছে। চট্রগ্রামের এ ব্যবসায়ী সেখানে যাওয়ার পথে দুর্ঘটনার শিকার হন। তিনি বলেন, ‘আমরা ঘুমের মধ্যে ছিলাম। কেমন একটা শব্দে ঘুম ভাঙলে কেবল শুনলাম, আল্লাহ বাঁচাও। তার কিছু সময় পরেই আমার দুই পা আর হাত কিছু একটার সঙ্গে আটকে গেল। পরে কে জানি আইসা আমারে টাইনা বাইর করলো। আমি চিৎকার করতেছিলাম। শুনতে পেলাম, এখানে একজন আটকে গেছে, এই মানুষটারে ধরো। তারপর তারা এসে বাইর করছে।’ তিনি বলেন, ‘পুরো ট্রেনের মানুষই ঘুমাচ্ছিল, সজাগ থাকলে হয়তো একটু বাঁচার চেষ্টা করতো, কিন্তু সে সুযোগ আমরা পাইনি।
সুমিআবুল কালামের সঙ্গেই চট্রগ্রাম যাচ্ছিলেন হোসেন আলী। সেখানকার এক অফিসে দারোয়ানের কাজ করেন তিনি। ৭৫ বছরের হোসেন আলীর মাথায় আর দুই পায়ে ব্যান্ডেজ। কিছুক্ষণ পর পর চিৎকার করে উঠছেন তিনি। কিছু মনে আছে কিনা জানতে চাইলে বললেন, ‘জানি না, আমি কিচ্ছু জানি না’।
ট্রেন দুর্ঘটনায় আহতদের কেউ কেউ পঙ্গু হাসপাতালের নতুন ভবনেও রয়েছে-এমন খবর পেয়ে ছয়তলায় গিয়ে দেখা যায়, একটি ওয়ার্ডে ঘুমাচ্ছে ইমন। ১৮ বছরের ইমন চট্রগ্রামে লেখাপড়া করেন। তার ফুফাতো ভাই আনীম জানালেন, দুর্ঘটনার পর দীর্ঘ সময় পার হলেও কিছুই বলছে না সে। কেবল মাঝে মাঝে ব্যথায় চিৎকার করে উঠছে।
বড় বোন সুমী, ছোট বোন মীম, মা জাহেদা বেগম, বড় ভাই সুমন এবং দাদুর সঙ্গে শ্রীমঙ্গল থেকে চট্রগ্রাম যাচ্ছিলেন ইমন। মা জাহেদা বেগম ঘটনাস্থলেই নিহত হন। তার মামা মোহাম্মদ আলী বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, গত বৃহস্পতিবার মারা যান ইমনের বাবা মো. মোসলেম উদ্দীন । তার দাফন শেষে চট্রগ্রামে ফিরছিলেন তারা। আলাদা বগিতে থাকায় রক্ষা পেয়েছেন ইমনের বড় ভাই সুমন। ছোট বোন মীমকে নেওয়া হয়েছে সিএমএইচে (সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল)। বড় বোন সুমী ও তার মা রয়েছেন পঙ্গু হাসপাতালে।