গেলো অক্টোবরের প্রথম দিকে সরকার বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। প্রথম দফায় ৪১ বীরাঙ্গনার নাম ঘোষণা করা হয়েছে। এ তালিকায় নাম নেই মাছুদা খাতুনের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজ হাতে এ ‘বীর মুক্তিযোদ্ধাকে’ পুরস্কৃতও করেছিলেন। তারপরও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি মেলেনি তার।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নেতা ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, কুষ্টিয়ার চার বীরাঙ্গনার নাম মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্তির জন্য মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল। কুমারখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, নারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও মহিলা পরিষদের কর্মকর্তাসহ পাঁচ সদস্যের কমিটি তদন্ত করে এ প্রতিবেদন পাঠানো হয়। এ তালিকার দ্বিতীয় নম্বরে ছিলেন মাছুদা। কিন্তু সরকার ঘোষিত প্রথম বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় তার নাম ওঠেনি। বরং ওঠেছে আরেক নাম- মজিরন নেসা। যিনি বীরাঙ্গনা ছিলেন বলে কোনও তথ্য নেই।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানান, কুমারখালীর হাশিমপুরে থাকেন মাছুদা। ৭১-এ স্থানীয় দালালরা তাকে তুলে দিয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে।
স্বাধীনতার স্বাদ বলতে মাছুদা যা পেয়েছেন তা হলো সীমাহীন অপমান, লাঞ্ছনা ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য। ১৯৯২ সালে গণআদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার অপরাধে ১০ বছর একঘরে হয়ে ছিলেন তিনি।
মাছুদা খাতুন বলেন, ‘আমি গণআদালতে সাক্ষ্য দিয়েছিলাম। জাহানারা ইমামের সঙ্গে বীরাঙ্গনাদের অধিকার আদায়ে কাজ করেছি। অথচ আমার স্থান হয়নি তালিকায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক বাহিনীর নির্যাতন সয়েছি। স্বাধীনতার পর উপহাস করেছে জামায়াত-শিবির। আর এখন উপহাসের পাত্র হলাম সরকারের কাছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যুদ্ধের পর থেকে অনেক কষ্ট করেছি। ১৯৯৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেদিন বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন, পা ছুঁয়ে সালাম করেছিলেন, সেদিন সব দুঃখ-কষ্ট ভুলে গিয়েছিলাম। মনে হয়েছিল আসলেই আমি মানুষ। আমি দেশের জন্য কিছু করতে পেরেছি।’ তার দাবি, আর্থিক সাহায্য নয়, মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম চাই। মাথা উঁচু করে মরতে চাই।
মাছুদার ছেলে লালন বলেন, ‘মা বীরাঙ্গনা হওয়ার কারণে নানাভাবে সমস্যায় পড়তে হয়েছে। অথচ তালিকায় নাম নেই মা’র।’
কুমারখালীর নাতুড়িয়ার মুক্তিযোদ্ধা খেতাব পাওয়া মজিরন নেসা বলেন, প্রশাসনের তদন্ত দলের সঙ্গে তার দেখা হয়নি। ঢাকার এক এনজিও তার কাছ থেকে কাগজপত্র নিয়ে যাওয়ার পর তালিকায় নাম ওঠে। তবে তিনি দাবি করেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি নিজ বাড়িতে হানাদার বাহিনীর সহিংসতার শিকার হন।
তার স্বামী ওয়াসেল আলী শেখ জানান, তিনি মাঠে কাজ করছিলেন। এসময় সংবাদ পান তার ঘরে পাক বাহিনী ঢুকেছে।
এ প্রসঙ্গে কুমারখালীর বাসিন্দা কুষ্টিয়া জেলা মুক্তিযুদ্ধ ইউনিট কমান্ডের সদস্য এসএম আবু আহসান বরুন বলেন, ‘আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি। একজন নারী সেসময় নির্যাতনের শিকার হলে অবশ্যই জানতাম। ওই এলাকায় খোঁজ নিয়েছি, ব্যাপারটি কেউ জানে না।’
কুমারখালী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সহকারী কমান্ডার ও দফতর সম্পাদক সোহরাব উদ্দিন বলেন, এ ঘটনায় বীরাঙ্গনাদের হেয় এবং সরকারের ভাবমূর্তি চরম ক্ষুণ্ন হয়েছে।
কুমারখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাহেলা আক্তার বলেন, ‘আমরা তদন্ত করে মাছুদা খাতুনের নাম পাঠিয়েছিলাম। তালিকায় নাম থাকলেও কেন তাকে বাদ দেওয়া হয়েছে তা বলতে পারি না। মজিরন নেছা বীরাঙ্গনা কিনা- এ বিষয়েও কমিটির কাছে সুনির্দিষ্ট কোনও তথ্য নেই।’
কুষ্টিয়া জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার রফিকুল আলম টুকু বলেন, ‘মজিরনের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিপ্রাপ্তি আমাদেরও বিস্মিত করেছে। আমাদের কাছে বীরাঙ্গনা হিসেবে যাদের নাম রয়েছে তারা হচ্ছেন-কুমারখালীর গুলজান, এলেজান, মোমেনা ও মাছুদা। জাহানারা ইমামের গণআদালতে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে আমরা এ চারজনকেই কুষ্টিয়া থেকে নিয়ে গিয়েছিলাম। সেদিন ঢাকায় গণআদালতে অসীম সাহস দেখিয়েছিলেন তারা।
/এসটি/এএইচ/