বাড়ির সামনে গলির বাঁকে রিকশার পাদানিতে চুপচাপ বসে আছে আনুমানিক ছয় বছরের একটি শিশু। নাম কী জানতে চাইলে জড়ানো কণ্ঠে বলে— ‘আফরোজা’।
এই রিকশা কার, রিকশাওয়ালা কোথায় গেছে বলতে পারো? শিশু আফরোজার মুখে ফুটে ওঠে এক চিলতে হাসি। সে বলে, ‘বাবা মাংস আনতে গেছে।’
এবার রিকশাওয়ালাকে খোঁজার পালা। শিশুটিকে আবারও তার বাবার নাম জিজ্ঞাসা করতেই বলে, ‘বছির’।
শারমিন জানালেন, ঈদের আগের দিন শুক্রবার (৩১ জুলাই) বছির রিকশা চালিয়ে মাত্র ২০০ টাকা উপার্জন করেছেন। তার আগের দিন বৃহস্পতিবার আয় হয়েছে ১০০ টাকা। আর বুধবার ঘরে এনেছিল মাত্র ৩০টা। আজ ঈদের দিন ভাড়ায় রিকশা না চালিয়ে স্বামী-স্ত্রী তাদের দুই সন্তানকে নিয়ে মাংসের খোঁজে বের হয়েছেন। দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত দুজনে মিলে তিন কেজির মতো মাংস সংগ্রহ করতে পেরেছেন। শারমিনের ভাষ্য—এই মাংস তাদের দুদিনের খাবারের জন্য যথেষ্ট হলেও ঘরে কোনও জমানো টাকা নেই। তাই বাড়তি কিছু মাংস পাওয়া গেলে সেটা বিক্রি করে চাল আর মসলা কেনা যাবে বলে জানান তিনি।
আফরোজা স্কুলে যায় কিনা জানতে চাইলে শারমিন বলেন, ‘সংসারই তো চলছে না স্কুলে দেবো কীভাবে?’ কথা বলতে বলতেই বড় সন্তান আফরোজাকে রিকশায় বসিয়ে রেখে ছোট সন্তান ইব্রাহিমকে কোলে নিয়ে আবারও লাইনে গিয়ে দাঁড়ান শারমিন। একটু পরপরই এভাবে এসে রিকশায় বসে থাকা শিশু সন্তান আফরোজাকে দেখে যাচ্ছেন, আবার দৌড়ে গিয়ে লাইনে সিরিয়াল ঠিক রাখছেন শারমিন। আর বছির? তিনি নড়াচড়া ছাড়াই ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন লাইনে—কোরবানির মাংসের অপেক্ষায়।
শারমিন জানান, তার জন্ম বিক্রমপুরে। বছিরের বাড়ি বরিশালে। ১০ বছর আগে তাদের বিয়ে হয়েছে। মোহাম্মদপুরের সোনমিয়ার টেকে ভাড়া বাসায় থাকেন। বাসা ভাড়া আড়াই হাজার টাকা। রিকশা চালিয়ে সংসার চালাতে কোনও সমস্যাই হতো না তাদের। কিন্তু করোনার কারণে এখন তাদের সংসার চলে না। তাই আফরোজাকে আগামী জানুয়ারিতে স্কুলে দেওয়ার চিন্তাভাবনা থাকলেও তা হবে না বলে জানান শারমিন।
বছির ছাড়াও আরও দুজন রিকশাওয়ালা মাংসের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা রয়েছেন। অপর রিকশাচালক খবির এসেছেন হেমায়েতপুর থেকে।
মোহাম্মদপুর শিয়া সমজিদের মোড়ে সংগ্রহ করা কোরবানির মাংসের বাজার বসে। এবার দেখা গেছে, বাজার বলতে ব্যাগ নিয়ে কিছু নারী-পুরুষ মাংস বিক্রির জন্য দাঁড়িয়েছেন। তবে বিক্রেতার চেয়ে ক্রেতার সংখ্যা তিনগুণেরও বেশি।
তবে সংগ্রহ করা এই মাংস কিনে নিয়ে যারা ব্যবসা করতেন, এবার তাদের অনেকেই আসেননি। প্রতিবছর ঈদের দিন গরিব মানুষের সংগ্রহ করা মাংস কিনে বিক্রি করেন ভ্যানচালক মাসুম। তিনি এবারও এসেছেন। মাসুম জানালেন—ভালো মাংস ৬০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছি। সারা বিকালে মাত্র ২ হাজার টাকা লাভ করেছি। অন্যান্য বছর ঈদের দিন ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা আয় হতো। এবার মাংসই পাচ্ছি না।
রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার লালমিয়া গরু কাটার জন্য এসেছিলেন। সাত জনে মিলে তিনটি গরু কেটে মোট পেয়েছেন ১৭ হাজার টাকা। আর যা মাংস পেয়েছেন তাও বিক্রি করছেন শিয়া মসজিদ মোড়ে।
হেমায়েতপুরের চান হাউজিংয়ের মো. মাসুম এবং ভোলার সেলিম সরদার ও তার ছেলে সোহাগ গরু কাটতে গিয়ে যে মাংস পেয়েছিলেন, তা বিক্রি করে দিয়েছেন। সেলিম সরদার বলেন, ‘অন্যবারের চেয়ে এবার মানুষ কোরবানি দিয়েছে কম। এ কারণে মাংসও পেয়েছি কম। তবে বেশ চড়া দামেই বিক্রি করেছি।’